সপ্তদশ পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল
কেশীঘাট বৃন্দাবনের বৃহত্তম ঘাট। এছাড়াও বালক কৃষ্ণ কেশীদৈত্যকে বধ করার পরে এই ঘাটে এসে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। জল খুব একটা যে বেশি আছে তা নয়, সর্বাধিক বুক পর্যন্ত জল। তবে নদীগর্ভ বেশ প্রশস্ত প্রায় এক কিলোমিটার বিস্তৃত। জল বলতে দুটি ধারা - একটি ঘাটের কাছে, আরেকটি মধ্যখানে। বাকি সবটা জুড়ে শুধু বালি আর বালি। প্রতিদিন শতশত পুণ্যার্থী তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ঘাটের কাছের এই অগভীর জলধারায় স্নান করে সমস্ত পাপ স্খালন করছেন। বৃন্দাবন মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে কেশীঘাটে স্নান করে গোবিন্দদেবের মন্দিরে যেয়ে প্রণাম করার কথা। এই কেশীঘাট অনেকটা জায়গা জুড়ে। বিরাট ঘাটের উপরেই কয়েকটি মন্দির আছে। পাশেই বেশ বড় বড় কিছু বাড়ি। সমস্ত জায়গাটাই বাধানো, নদীগর্ভ থেকে বেশ উঁচু ঘাট। উপর থেকে সিঁড়ি নেমে গেছে যমুনায়। আমরা যখন এসে পৌছালাম তখন দেখতে পাচ্ছি যমুনা নদীকে আরতি করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমরা সত্বর একজন পান্ডাকে ধরে এই কেশীঘাটের সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনী জানতে চাইলাম। পান্ডা বললেন ‘যদিও আরতির সময় হয়ে এসেছে তবুও আপনারা বঙ্গাল থেকে এসেছেন বলে সংক্ষেপে বলছি’। এখানে উল্লেখ করা যায় যে বৃন্দাবনে ভাষার কোন সমস্যা নেই কারণ প্রত্যেকেই এখানে বাংলা ভাষা জানেন এবং বলতে পারেন ও বুঝতেও পারেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
কবি চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নৌকাবিলাসের যে কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে সেখানে এই কেশীঘাটের কথা বলা হয়েছে। আমরা বললাম ‘আপনি সংক্ষেপে সেই কাহিনী আমাদের শোনান’। তিনি বললেন “একদিন গোপীনীরা মথুরা থেকে দুধ, মাখন প্রভৃতি বিক্রী করে যমুনা তীরে এসে দেখলেন তাদের কানাই যমুনাতে নৌকা নিয়ে বসে আছেন। এমন সময়ে যমুনার জলে তুফান উঠলো। তুফান উঠতে দেখে রাধারানীর মন উৎকণ্ঠায় ভরে গেল কারণ কিভাবে বাড়ি ফিরবেন। গোপীগণ তখন কানাইকে বললেন 'তুমি আমাদের যমুনার ওপারে পৌঁছে দাও'। কৃষ্ণ বললেন 'খালি হাতে তো আমি তোমাদের পার করে দিতে পারব না তার জন্য পারানির কড়ি লাগবে। প্রত্যেকের জন্য তিনগুণ পন গুনে নেব'। বৃন্দা বললেন ‘আমাদের কাছে তো পারানির কড়ি নেই তার বদলে তোমাকে বনমালা গেঁথে গলায় পরিয়ে দেবো’। শ্রীকৃষ্ণ বললেন ‘তা হবে না। তোমাদের এই বনমালা গলায় পরে বিনা পয়সায় নিয়ে যেতে পারবো না’। ললিতা তখন হেসে বললেন ‘তুমি তো বাপু ব্রজের ঘরে ঘরে ননী চুরি কর আর মাঠে মাঠে গোচারণ করো। আবার সুযোগ পেলে গোপিনীদের পরনের কাপড় চোপড় থেকে তাদের মনটি পর্যন্ত চুরি করে নাও। কিন্তু এগুলো তো আমরা জানি, কিন্তু তুমি কবে থেকে আবার নৌকোর দাঁড় বাইতে শুরু করলে’? শ্রীকৃষ্ণ বললেন ‘তোমাদের কথার চাতুরীতে আমি ভুলছি না। সহজ কথা পারানির কড়ি পেলে তবেই আমি নৌকায় করে ওপারে পৌঁছে দেবো’। এমন সময়ে মাথার উপরে মেঘ গর্জন করে উঠল, শুরু হল ঝড়, যমুনা উন্মাদিনী রণরঙ্গিনীর মতন নৃত্য করতে লাগলো। গোপিনীদের এলো খোপা খসে পড়ল, ঝড়ে তাদের বস্ত্রাঞ্চল উড়তে লাগলো। আকুল নয়নে যমুনার দিকে তাকিয়ে বৃন্দা বললেন ‘একান্তই যদি পারানির কড়ি না পেলে পৌঁছে দেবে না তাহলে আমাদের এই অঙ্গের ভূষণ অলঙ্কারগুলি খুলে দিচ্ছি তাই নিয়ে আমাদের পার করে দাও’। শ্রীকৃষ্ণ সেই কথা শুনে বললেন ‘তোমাদের অলঙ্কারগুলি নেওয়ার পরে তোমরা ব্রজধামে যেয়ে বলবে, আমি তোমাদের অলঙ্কারগুলি চুরি করেছি। অতএব অলঙ্কার নিয়ে আমি পার করতে পারব না। একমাত্র রাধারানীকে নিয়ে যদি তোমরা নায়ে চেপে বসো তাহলে আমি পার করে দেবো’। যে মুহূর্তে রাধারানীকে নিয়ে গোপিনীরা নৌকাতে উঠলেন সেই মুহূর্তে জাদুবলে যেন দুর্যোগ মিলিয়ে গেল। ক্ষুব্ধ যমুনা শান্ত হয়ে গেলেন, আকাশ মেঘ মুক্ত হয়ে চন্দ্রের উদয় হলো, স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় নীল যমুনা নীলকান্ত মনির মত চকচক করতে লাগলো। তখন শ্রীকৃষ্ণ প্রেম নিবেদন করে রাধারানীকে বললেন 'তোমার আমার যে প্রেম সেই প্রেম আমরা জগৎজনে বিলিয়ে দিতে চাই আমাদের এই নিষ্কাম প্রেম। তুমি আদ্যাশক্তি মহামায়া - তুমি কায়া, আমি তোমার ছায়া। তোমার আমার এই প্রেম হেমনিকেষিত নিষ্কাম প্রেম।' শ্রীকৃষ্ণের এই প্রেমপূর্ণ রসালাপ শুনে গোপিনীগণেরাও বিমোহিত হয়ে গেলেন। নৌকাবিলাস অংশে শ্রীকৃষ্ণ যে প্রেমপূর্ণ স্বরে রাধারানীকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন তা হলো এই রূপ।'শুন রাই ব্রজেশ্বরী, শ্রীপদ সম্পদ করি, তব প্রেমে জীর্ণ তরী লয়ে যাব পার। তব প্রেম বিনাপনে, বিলাই জগৎজনে, মহাজন মূলধন তুমি সে আমার। আদ্যাশক্তি মহামায়া, তুমি কায়া আমি ছায়া, তুমি গেহ, তুমি দেহ, তুমি সে জীবন। যখন যেখানে বাস, জেনো তব ক্রীতদাস, রেখো পায় কৃপাকণা করি বিতরণ'। অবশেষে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদেরকে বিনা পারানিতে গোকুলে পৌঁছে দিলেন। সংক্ষেপে এই হল নৌকাবিলাস অংশে কেশীঘাট সম্বন্ধে তত্ত্বকথা”। এইকথা বলে তিনি আরতি শুরু করলেন। আমরা মিনিট পাঁচেক আরতি দর্শন করে দ্রুত পদক্ষেপে পরবর্তী ঘাট ইমলিতলার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গোপীনাথ মন্দির থেকে সামান্য দূরে ইমলিতলা মন্দির। পথের পাশে একটি ছোট দরজার উপরে বাংলায় লেখা 'হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে'। ব্রজ মন্ডলের প্রায় প্রত্যেক মন্দিরেই এই নাম কীর্তন (তারকব্রহ্ম নাম) বাংলায় লেখা আছে। এই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যাবে ছোট্ট একটি বাঁধানো আঙিনা। ওই আঙিনার মাঝখানে একটি কুঁয়ো আর তিন দিকে ঘর। আঙিনার উপরে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। হয়তোবা বানরের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা। এই আঙিনা থেকে একটি পথ বেরিয়ে যমুনা তীরে ইমলিতলা বা ইমলিতলা ঘাট। ইমলি মানে তেঁতুল। যমুনা তীরে পাথর বাঁধানো এক ফালি প্রান্তরের মাঝখানে একটি তেঁতুল গাছ আছে। গাছের গোড়াটি শ্বেতপাথরে বাঁধানো। বেদীর উপরে একজোড়া চরনচিহ্ণ এবং নীচে লেখা আছে বাংলায়, 'প্রাতে বৃন্দাবনে কৈল চীর ঘাটে স্নান। তেতুলি তলাতে আসি করিল বিশ্রাম'। আমরা ইমলিতলা ঘাটের নিকটে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আশ্রমে যেয়ে দোতলায় উঠে আশ্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত মোহান্তের কাছে ইমলিতলা ঘাটের মাহাত্ম্য জানতে চাইলাম।
( পরবর্তী অংশ অষ্টাদশ পর্বে)
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments