নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন প্রসিদ্ধ ছান্দসিক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিক । তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা থাকলেও সময়ের ভাবনায় খানিক বিস্মৃত। ঐতিহাসিক প্রবোধচন্দ্র সেন প্রথম জীবনে বাংলা ছন্দের সমলোচনা করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। অধ্যাপক সেন প্রায় ষাট বছর ধরে বাংলা ছন্দের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা ও পরিভাষা সৃষ্টি করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত 'ছান্দসিক' অভিধায় ভূষিত হন। প্রবোধচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের'ছন্দ' গ্রন্থটি সম্পাদনা করে বাংলার বিদগ্ধ মহলে সমাদৃত হয়েছিলেন। অধ্যাপক সেন শিক্ষা,ইতিহাস, সমাজ, বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রসাহিত্য বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান অনস্বীকার্য। অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা-য় কবির জন্ম।
১৯২৭ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি' বিষয়ে এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। ১৯৩২-৪২ অবধি বাংলাদেশের খুলনার দৌলতপুর কলেজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৪২ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাভবনের রবীন্দ্র-অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন, তারপর অধ্যক্ষ হন। ১৯৬৫ এ অবসর গ্রহণ করার পরপরই বিশ্বভারতীর সম্মানসূচক এমেরিটাস প্রফেসর পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
প্রাবন্ধিক ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ: :-
'বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান', 'ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ',
'ছন্দ-পরিক্রমা', 'ছন্দ জিজ্ঞাসা', 'বাংলা ছন্দ-সমীক্ষা', 'বাংলা ছন্দচিন্তার ক্রমবিকাশ','ছন্দ সোপান', 'বাংলা ছন্দ-সাহিত্য', 'বাংলা ছন্দের রূপকার রবীন্দ্রনাথ', 'নতুন হৃদ পরিক্রমা', 'বাংলা ছন্দশিল্প ও ছন্দচিন্তার অগ্রগতি'।
বস্তুতঃ গ্রন্থগুলি বাংলা ছন্দের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল একসময় করেছিল। বর্তমান সময় ও সমাজে বাংলা ছন্দের যে রীতিনীতি ও পদ্ধতি প্রচলিত তা কিন্তু ঐতিহাসিক প্রবোধচন্দ্র সেন-মহোদয়ার মূল্যায়ন কেন্দ্রীক।
প্রবোধচন্দ্র সেনের ভারত-ইতিহাস চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ''বাঙলায় হিন্দু রাজত্বের শেষ যুগ'', ''রামায়ণ ও ভারত সংস্কৃতি'', ''ভারতাত্মা কবি কালিদাস'' ইত্যাদি গ্রন্থ এবং অধ্যাপক সেনের এ ধরনের বহু প্রবন্ধে সুগভীর ইতিহাসবোধের আত্মীক পরিচয় মেলে ধরে। অধ্যাপক সেন ''ভারতাত্মা কবি কালিদাস'' পুস্তকে'র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রদত্ত "বঙ্কিম পুরস্কার" লাভ করেছিলেন ।
🍂
আরও পড়ুন 👇
ঐতিহাসিক সেনের ''বাংলার ইতিহাস সাধনা'', গ্রন্থটি বাংলা ভাষার 'হিস্টিরিয়োগ্রাফি'র প্রথম বই হিসেবে সম্মানীত। ''ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ'', ''রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা'', ''ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত'', ''ইচ্ছামন্ত্রের দীক্ষাগুরু রবীন্দ্রনাথ'' প্রভৃতি গ্রন্থে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রসাহিত্যের সমালোচনা করে যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। সাহিত্যসেবক প্রবোধচন্দ্র সেনের বুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার অনুরাগ ও শ্রদ্ধার পরিচয় ''ধর্মবিজয়ী অশোক'' ও ''ধম্মপদ-পরিচয়'' গ্রন্থে। তাঁর এইসব গ্ৰন্থের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের সঙ্গে স্বদেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন এর ''আধুনিক বাঙলা ছন্দ'' প্রবন্ধে গদ্যকবিতার ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : -
“গদ্যকবিতার ভাষাকে বলা যায় 'স্পন্দমান (Rhythmic) গদ্য'; আর সাধারণ গদ্য হচ্ছে নিস্পন্দ গদ্য। অবশ্য কোনো গদ্যই একেবারে স্পন্দনহীন নয়, তবে স্পন্দন পরায়ণতা সাধারণ গদ্যের বৈশিষ্ট্য নয় বলেই তাকে নিস্পন্দ বলা যায়। যেমন জগতের কোনো বস্তুই একেবারে তাপহীন নয়, তথাপি যেসব বস্তুর তাপ আমাদের অনুভূতিতে ধরা পড়ে না সেগুলিকে আমরা তাপহীন বলেই গণ্য করি।"
ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন মহোদয় কে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানিক "ডি.লিট" প্রদান করেছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য প্রফুল্ল স্মৃতি পুরস্কার,১৯৬৯, কেশবচন্দ্র গুপ্ত স্মৃতি পুরস্কার,১৯৭৫,১৯৮০তে দেশিকোত্তম লাভ করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক,ছন্দ ও গবেষক হিসেবে তাঁর দায়বদ্ধতার স্বাতন্ত্র্য বৈদগ্ধ্যে এবং পরিবেশন নৈপুণ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার কথা থাকলেও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments