জ্বলদর্চি

সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য (শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক, পাঁশকুড়া) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৯
সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য (শিক্ষক, আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

"দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না। ধুতি সাদা থানের যত্নে কোঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তার বাঁ কাঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু ভাগ করা; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে....." (শেষের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 

সহজেই অনুমেয় কার কথা বলা হয়েছে। যাইহোক, আরেক ধুতি পরা বাঙালির কথা এখন বলতে চাইছি। তিনি গুরু বংশের সন্তান। বাবা পণ্ডিত অশ্বিনী কুমার ভট্টাচার্য ছিলেন কাব্যব্যকরণতীর্থ। সংস্কৃত সাহিত্যের বুৎপত্তি অগাধ। নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পূজার্চনা করেন, পুঁথিপাঠ করেন। এহেন বংশের সন্তান হয়ে হাঁড়িঝামা স্কুলে প্রথম স্থান পেয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হলেন রঘুনাথবাড়ি রামতারক উচ্চ বিদ্যালয়ে। কিন্তু তিনি তো ব্রাম্ভণ পণ্ডিত বাড়ির সন্তান। পুঁথি চর্চা করেন। সাধারণের চেয়ে আলাদা। কোনও রকমে দিন চলে যায়। সাত্বিক আহার আর বিদ্যাচর্চার মধ্যে ডুবে থাকা নির্লোভ নিরাসক্ত এবং নিরাকার মানসিকতার মানুষের পরিবারের একজন। বেশভূষাতেও তাই তার ছাপ থাকবেই। স্বভাবতই বাবার হাত ধরে অতি সাধারণ পাঁচি কাপড়ের ধুতি পরে হাজির হলেন বিদ্যালয়ে। তখন হাতে গোনা যে কজন ধুতি পরে ক্লাস করতো, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। সবাই জানতো পণ্ডিত মশাইয়ের বাড়ির ছেলে। ধুতি পরাই দস্তুর। সেই ধুতি তিনি আজও ছাড়েননি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়তেও পড়াকালীন এই বিশেষ বাঙালি পোশাকের কদর এবং যত্ন করে গিয়েছেন চরম লালিত্যে। বর্তমানের হাল ফ্যাশনের যুগেও তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছেন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে। ভাসিয়ে দেননি গতানুগতিক ধারার সাথে। শিক্ষকতা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপন করেছেন প্রাচীন গুরুকুলের স্বাদ বিতরণের মাধ্যমে। সাধারণ হয়েও সকলের মননে এবং স্মরণে হয়ে থেকেছেন অসাধারণ। 

সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য। পাঁশকুড়ার আঞ্চলিক ইতিহাস, সংস্কৃতি, লোকসমাজ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, রাজকাহিনীর চর্চাকারী এক অন্যতম প্রোথিতযশা ব্যক্তিত্ব। একাধারে ছিলেন শিক্ষক। অন্যদিকে লোকসংস্কৃতির নিবিড় গবেষক। চাকরি জীবন থেকে অবসরের পরেও থেমে নেই তাঁর অনুসন্ধান পিপাসা। তাঁর হাতের কলমের গতিশীল হাঁটাচলা। থামেনি তাঁর মস্তিষ্কের প্রক্ষালন প্রক্রিয়া। তাঁর নিজস্ব অনুভূতিতেই ধরা পড়েছে তাঁর কাজের কথা -- "পাঁশকুড়াকে নিয়ে আমরা ভীষণ গর্ব অনুভব করি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বৃহত্তম ব্লক আমাদের পাঁশকুড়া। এখানকার প্রাচীন ইতিহাস আছে। আছে কাশীজোড়া রাজবংশ। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেবদেউল আছে আমাদের পাঁশকুড়াতেই। এখানে আছে অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে বড়ো মহাবিদ্যালয় পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ। আছে তিনটি শতাব্দীপ্রাচীন উচ্চ বিদ্যালয়। এখানেই জন্মেছেন তিনজন প্রখ্যাত সংগ্রামী। এখানকার অনেকেই একসময়ে জাতীয় শিক্ষকের সম্মানও পেয়েছেন। পাঁশকুড়াতেই আছে অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদও। সমীক্ষাকালে এলাকায় এমন কয়েকটি পরিবারের সন্ধান পেয়েছি যাঁরা আজও ঐতিহ্য পরম্পরাকে রক্ষা করে চলেছেন"। 

১৯৫৯ এর ১৫ ই ফেব্রুয়ারি পদ্মাবতী দেবীর কোল আলো করে অষ্টবাটিকা গ্রামে (আটবেড়িয়া) জন্মগ্রহণ করেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। তিনি উল্লেখ করেছেন নিজের 'আটবেড়িয়া' গ্রামের প্রকৃত নাম হল 'অষ্টবাটিকা'। যা তিনি নিজের বাড়ির দেওয়ালে নামফলকেও খোদিত করে রেখেছেন। এখানে একসময় আটটি বাটি বা বংশ তথা ভট্টাচার্য, সী, কর, পট্টনায়ক, মিশ্র, মাইতি, আদক এবং ঢাং রা বসতি গড়েছিল। তাঁদের উত্তরসুরিরা আজও রয়েছে এখানে। এই আট বাটি বা বংশের নামের ভিত্তিতেই গ্রামের নামকরণ হয় অষ্টবাটিকা। 

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৫ সালে সংস্কৃত সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯৮৮ তে পিজিবিটি পাস করেন। এরপর যুক্ত হন শিক্ষকতার পেশায়। প্রথমে বারুইপাড়া রাখাল বিদ্যাপীঠে শুরু হয় পাঠদান কাজ। এরপর হুগলি কোদাপুরা আদিবাসী মিশন হাইস্কুল, ওদোলচুয়া বোড়াই হাইস্কুল হয়ে ১৯৯১ থেকে শালকিয়া বি এম বিদ্যামন্দিরে শিক্ষকতা করেন ২০১৯ পর্যন্ত। শিক্ষকতা চলাকালীনই বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। আপাতত অবসর জীবন হলেও ধুতি পরা এই শিক্ষক কিন্তু তাঁর অন্বেষণ থামাননি। 

অকপটে জানিয়ে দেন তাঁর কাজের গতিপথের দিকদিগন্ত। সুলুক সন্ধান। তাঁর কথায়, "নিজের এলাকাকে ভালোভাবে জানবার অদম্য আগ্রহ নিয়ে একদিন তন্নিষ্ঠ ক্ষেত্রসমীক্ষাকে ভিত্তি করে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার কাজ শুরু করেছিলাম। বেশ কয়েক বছরের নিরন্তর প্রয়াসে পর্যায়ক্রমে লিখতে সক্ষম হয়েছি পরগনা কাশীজোড়া, ষোড়শ জনপদকথা, পাঁশকুড়া পরিক্রমা এবং পাঁশকুড়ার জনপদ নামে চারটি আঞ্চলিক ইতিহাসের বই। বাকপ্রতিমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এইসব বই এলাকাবাসীর কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং স্বল্পকালের মধ্যে নিঃশেষ হওয়ায় প্রকাশক হরপ্রসাদ সাহু মহাশয় পাঁশকুড়াকে নিয়ে আরও বই লেখার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ করতে থাকেন। আমার পূর্বপ্রকাশিত বইগুলির পাঠকেরা আমাকে পরবর্তী বই লেখার জন্য নিরন্তর উৎসাহিত করেছেন"। তাঁর লেখক হয়ে ওঠার সিঁড়িতে দৃপ্ত পদচারণা শুরু 'বন্দে সংস্কৃতম' বই লেখার মাধ্যমে। এরপর 'মেধাবী রঙের আলো', 'পরগনা কাশীজোড়া', 'ষোড়শ জনপদকথা', 'পাঁশকুড়া পরিক্রমা', 'পাঁশকুড়ার জনপদ', 'পাঁশকুড়া গৌরব' বইগুলি লিখে ফেলেছেন। প্রতিটি বই আসলে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক বর্ধিষ্ণু জনপদ পাঁশকুড়ার লুক্কায়িত এবং অনালোচিত ও অনালোকিত ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। যথেষ্ট করিৎকর্মাসুলভ ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং অনুসন্ধিৎসু মনের সফল প্রয়াস ছিল এই বইগুলি। খুব শিগগিরই প্রকাশিত হতে চলেছে ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতিকে নিয়ে লেখা 'শাশ্বত ভারতী'। 

মহিষাদলের বিখ্যাত কবি এবং প্রকাশক হরপ্রসাদ সাহুই তাঁর গদ্য লেখার অনুপ্রেরণাদাতা। বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে কবিতা এবং ছোটখাটো লেখা লিখতেন। আদ্যাপীঠ মাতৃপূজাতে লিখতেন। দৈনিক স্টেটসম্যানতে সম্পাদকীয় নিবন্ধ নিয়মিত লিখতেন। কিন্তু হরপ্রসাদ বাবুর নির্দেশে শুরু করেন নিজের জন্মভূমির কোনে কোনে ছড়িয়ে থাকা মনিমুক্তো খুঁজে বের করা। এরপর তিনি এখন খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো ইতিহাস খোঁজেন। তাঁর কলমে মুখরিত হয়েছে চৌগেড়িয়া, শুকুতিয়া, ইটারা, বেড়াবেড়িয়া, কুমোরআড়া, সুন্দরনগর থেকে গৌরাঙ্গপুর, গুমাই, চণ্ডীপুর, সরস্বত্যা, ফকিরগঞ্জ গ্রামগুলি। কাশীজোড়া রাজবংশের রাজাদের কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন সাবলীলভাবে। তাঁর রচনায় বেহুলা নদী, মিঞার দমদমা, সিদ্ধিনাথের অস্থল, কুচমনদাসবাবাজির সমাধিস্থল, নছিপুরের যোগদি ঢিবি, বেচুপোতার মঠ সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়েছে পাঠকদের কাছে। ইন্দুমতী ভট্টাচার্য, রজনীকান্ত প্রামানিক, শ্যামাদাস ভট্টাচার্য, নির্মলচন্দ্র মাইতি, সতীশচন্দ্র দাস, যতীন্দ্রনাথ ভৌমিকদের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন সাবলীল ভঙ্গীমায়। 

রঘুনাথবাড়ি হাইস্কুলে পড়াকালীন বিদ্যালয়ের পত্রিকা 'ঊষা'তে লিখেছিলেন প্রথম লেখা। সেই শুরু লেখালেখিতে পথচলা। ১৯৭৬-১৯৭৭ নাগাদ পাঁশকুড়া কলেজে পড়াকালীন সম্পাদনা করতেন নিজস্ব পত্রিকা 'বঙ্গশ্রী'। বহু মানুষ লিখতেন এখানে। কিন্তু তা আর নিয়মিত হয়নি। একসময় বিপ্লবীদের পত্রিকা 'প্রবর্তক' এর দায়িত্বে ছিলেন। 

ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়েই হাঁড়িঝামা গ্রামের জমিদার প্রহ্লাদ জানার ছেলে সুব্রত জানার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন দুখানা প্রাচীন তরবারি। সেই তরবারি দুটি দিয়ে দেন গবেষণক হরপ্রসাদ সাহুকে। যা কিনা মহিষাদলে কোনও সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। মাগুরী জগন্নাথচকের সুশীল কুমার সামন্তের বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন ভাগবতের দুখানা প্রাচীন পুঁথি। নিজের বাড়িতে থাকা বহু মূল্যবান প্রাচীন ওড়িয়া পুঁথি দিয়ে দেন মালীবুড়োর হাতে। যা কিনা বরগোদা গ্রামে মালীবুড়ো সংগ্রহশালাতে সযতনে সংরক্ষিত রয়েছে। এভাবেই তিনি মেদিনীপুরের নানা হারিয়ে যাওয়া রত্নকে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টাতে নিয়োজিত। আর নিজেকে পরিগণিত করে তুলছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হিসেবে।


Post a Comment

0 Comments