জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস/ নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস
                
নির্মল বর্মন

 প্রাবন্ধিক কবি সজনীকান্ত দাস  বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সমালোচক সজনীকান্ত দাস ১৯০০ সালে ২৫ শে আগস্ট অবিভক্ত বর্ধমান জেলার বেতালবন গ্ৰামের মামালয়ে পিতা হরেন্দ্রলাল ও মাতা তুঙ্গলতা'র কোল আলো করে পৃথিবীর ভালোবাসা দেখেছিলেন।পিত্রালয় বীরভূমের রায়পুর। বাঁকুড়া জেলার ওয়েসলিয়ান মিশনারী কলেজ থেকে আই.এস.সি,   পরে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.এস.সি পাশ করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস.সি ( পদার্থ বিজ্ঞান)পাশ। বস্তুতঃ ১৯২৪ এ অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত "শনিবারের চিঠি" পত্রিকা তে যোগ দিয়েছিলেন।পরে জনপ্রিয় সম্পাদক হিসেবে সুযশ খ্যাতি ও সম্মান ছড়িয়ে পড়েছিল। কাজী নজরুল ইসলামের "আমার কৈফিয়ৎ"  কবিতায় "শনিবারের চিঠিতে প্রেয়সী দেন গালি" বিশ্ববিখ্যাত  কথিত উক্ত উক্তি "সজনীকান্ত দাস"-কে ভাস্বর করে তুলেছিল। কারণ, সজনীকান্ত এই পত্রিকার সঙ্গে অচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ  ছিলেন। সজনীকান্ত সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক হিসেবেই বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।কিন্তু বর্তমান সময় ও সমাজে সামান্য কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষ জানলেও,কালের অমোঘ নিয়মে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হতে চলেছেন।
🍂
প্রাবন্ধিক গবেষক,কবি সজনীকান্ত দাস এম.এস.সি. পড়া কালীন "শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় যোগ দেন এবং "ভাবকুমার প্রধান" ছদ্মনামে লিখতেন । প্রাবন্ধিকের "কামস্কাটকীয় ছন্দ" কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলার  "ব্যঙ্গ সাহিত্যে " সুপ্রতিষ্ঠা  পান। হাত যশ ও ভাগ্যের জোরে "শনিবারের চিঠি" পত্রিকাটির একাদশ সংখ্যা থেকে  সম্পাদক ও পরিচালক হতে পেরেছিলেন। সজনীকান্ত "প্রবাসী"পত্রিকায় যোগ দেন। সজনীকান্ত "বঙ্গশ্রী" ও "দৈনিক বসুমতী" পত্রিকারও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। সজনীকান্ত কবি সাহিত্যিক সমালোচক, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীত রচনাকার ও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গবেষক রূপে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও মর্যাদা দান করেছেন।  তাঁর বাংলা সাহিত্যের আসরে প্রথম আগমন নজরুলকে আক্রমণের মাধ্যমে। পর্যায়ক্রমে প্রায় প্রত্যেক নামডাকসম্পন্ন কবি সাহিত্যিক সজনীকান্তের সমালোচনায় ভারাক্রান্ত। কবি সম্পাদক সজনীকান্তের সমালোচনার পীঠস্থল:-- -সাহিত্যনীতি,  রাজনীতি  ও সমাজনীতি ইত্যাদি। কবিবর চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবেও সর্বজনগ্রাহ্য  খ্যাতি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের  সভাপতিত্বের আসন অলংকৃত করেন।
সজনীকান্তের প্রবন্ধগ্রন্থ সম্ভার:-- "পথ চলতে ঘাসের ফুল" ১৯২৯, "বঙ্গরণভূমে"১৯৩১, " মনোদর্পণ" ১৯৩১, "অঙ্গুষ্ঠ",১৯৩১, "রাজহংস",১৯৩৫, "আলো আঁধারি" ১৯৩৬," পঁচিশে বৈশাখ"১৯৪২," মানস সরোবর"১৯৪২,"ভাব ও ছন্দ" ১৯৫২, "পান্থ পাদপ"১৯৬০, "উইলিয়ম কেরী" (১৯৪২), "বাংলার কবিগান'"(১৯৪৪), "বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: গদ্যের প্রথম যুগ" (১৯৪৬), "পথের সন্ধান"(১৯৪৬), "স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা" (১৯৪৯), "ক্যাপ্টেন জেমস্ স্টিওয়ার্ট, ফেলিক্স কেরী"(১৯৫১),"আত্মস্মৃতি"(প্রথম খণ্ড ১৯৫৪, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৬, তৃতীয় খণ্ড ১৯৭৭),"রবীন্দ্রনাথ: জীবন ও সাহিত্য" (১৯৬০), "বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস" (১৯৬২) ইত্যাদি।
কবি সাহিত্যিক, সমালোচক, গীতিকার ও সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের লেখা গান ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে সুকৃতি সেনের কন্ঠে প্রতিধ্বনিত :-
"বন্দেমাতরম    বন্দেমাতরম
চক্রশোভিত ওড়ে  নিশান
নব ভারতের বাজে বিষাণ
কে আছ কোথায় ছুটে এস সবে
জ্ঞানী ও কর্মী ধনী বিষাণ

নতুন যাত্রা শুরু এবার"।

প্রাবন্ধিক সজনীকান্ত "বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস" গ্রন্থে আদি যুগ ও সময়ের বাংলা গদ্যকে নতুন আঙ্গিকে  স্থাপন ও সৃষ্টি করেছেন। প্রাবন্ধিক গবেষক বাংলা গদ্যের আদিযুগের বিচ্ছিন্ন উপাদানকে যত্নসহকারে ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত করে গদ্যের স্বরূপকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। সজনীকান্ত 'উইলিয়ম কেরী' সম্পর্কিত মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-, 
"একদিক হইতে আরবী, ফার্সী ও অন্যদিক হইতে সংস্কৃতের চাপে বাংলা ভাষার যখন মৃতকল্প অবস্থা, তিনিই তখন আশ্চর্যরকম দূরদৃষ্টি দেখাইয়া এই ভাষার আশ্রয়ে আত্মপ্রকাশ করিতে দ্বিধা করেন নাই; অন্য প্রাদেশিক বা প্রচলিত ভাষার প্রাধান্য অস্বীকার করিয়া সংস্কৃতানুসারিণী বাংলাকেই তিনি ভারতীয় প্রচলিত ভাষাসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন দিয়াছিলেন।"
 কবি সাহিত্যিক সজনীকান্তের "আত্মস্মৃতি"  প্রবন্ধ অতি অবশ্যই আত্মনিষ্ঠ । সমকালীন সময় ও সমাজের সাংস্কৃতিক জগতের সফল তথ্যযুক্ত চিত্রাঞ্জলী এতে কালজয়ী ভাবনায় উপস্থাপন করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সহ বহু প্রসিদ্ধ কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে সৌন্দর্য মন্ডিত সাহিত্য জীবনের ছক ও ছবি এই গ্রন্থের মূর্ত প্রতীক।
গবেষক সজনীকান্ত দাসের "রবীন্দ্রনাথ: জীবন ও সাহিত্য" গ্রন্থে বিশ্ববরণ্য রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী  বিশেষত গান, কবিতা , নাটক, উপন্যাস,প্রবন্ধ,  ছবি প্রতিভার মূল্যায়ন স্থানলাভ করাতে পেরেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  সম্পর্কে সজনীকান্ত দাসের মূল্যায়ন কালজয়ী:--
"তিনি এসেছিলেন কবি হিসেবে, সাহিত্যশিল্পী হিসেবে, সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে। কিন্তু এই কবি-কর্মের মধ্যেই তিনি মানুষের চিত্তকে এমনভাবে অধিকার করেছিলেন যে, এই সংশয় শাসিত যুগেই তিনি অনুরূপ বিপর্যয় ঘটিয়ে গেছেন; ভাষা, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রশিল্প, কারুশিল্প, শিক্ষা, সাজসজ্জা, আচার- ব্যবহার-সমস্ত কিছু প্রভাবান্বিত হয়েছে তাঁর সংস্পর্শে। ধর্মেতর ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবীর বর্তমান ইতিহাসের মধ্যে কোথাও এমনটি আর ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ পরম বিস্ময়ের মতই রয়ে গেছেন। তিনি শুধু যুগপ্রবর্তক মাত্র রইলেন না, সমস্ত যুগটাই তাঁতে বিধৃত হয়ে রইল।"

সজনীকান্তের  স্বচ্ছ নির্মল সাবলীল বাংলা ভাষা , প্রবন্ধের অন্যতম সম্পদও বটে। শুধু তাই নয়, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সাধু ও চলিত এই উভয় রীতিতেই  প্রবন্ধ রচনা করে বাংলার সারস্বত সমাজকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সজনীকান্ত যথাযথ তথ্যনিষ্ঠ পরিচ্ছন্ন মার্জিত গদ্যরীতির জন্য গদ্যকার ও প্রাবন্ধিক হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও বর্তমান সময় ও সমাজে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিকের পথে ক্রমশঃ অগ্ৰসর।

Post a Comment

0 Comments