বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯০
কোয়ান্টাম বিন্দুর নেবুলা রঙে ভাস্বর মধ্য রাতের তারা : রসায়নে নোবেল ২০২৩
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
(১)
এক কলেজ পড়ুয়ার ডায়নামিক লড়াই
"পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করতে অভ্যস্ত ছিলাম না আমি। পরীক্ষাহলের বিশাল আকার এবং পরীক্ষা পরিদর্শকের কঠোর গুরুগম্ভীর উপস্থিতিতে ভয় পেয়েছিলাম" — কথাগুলো বলে ক্ষণিক থামলেন প্রৌঢ় পণ্ডিত মানুষটি। বিশালাকার হলঘর তখন প্রিন্ট মিডিয়ার লোকজন, নিউজ চ্যানেল, সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান-এ ভর্তি। যেন গল্প দাদুর আসর বসেছে। অতীতের গল্প, পড়াশুনার কথা, কলেজ জীবনের কাহিনী, নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ প্রৌঢ় সোৎসাহে ভাগ করে নিচ্ছেন দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। তাঁর কাহিনী শুনলে মনে হবে গল্পের গরু আকাশে ওড়ে। একদম অসম্ভব, কিন্তু চরম বাস্তব। কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ফেল করার বাস্তব গল্প শোনাচ্ছেন তিনি। আবার শুরু করলেন পণ্ডিত –
"আমি প্রশ্নপত্রের প্রথম প্রশ্নটি দেখেছিলাম। কিছু বুঝতে পারিনি। স্বভাবতই এর উত্তর করতে পারিনি। এরপর দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তরও বের করতে পারিনি।"
একশো নম্বরের পরীক্ষা। পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে ব্যস্ত সবাই। অথচ তিনি চোখে সর্ষেফুল দেখছেন। হলের মধ্যে কাটানো ঘণ্টা তিনেক সময়, তাঁর কাছে, এক যুগ মনে হচ্ছিল তখন। তারপরও ধৈর্য্য ধরে তিনি বসে থাকলেন ঘরের এক কোণে। একটা প্রশ্নেরও একশো শতাংশ খাঁটি উত্তর তিনি লিখতে পারেননি। সবই যেন ঝাপসা। অস্পষ্ট। ভাসা ভাসা উত্তর। গুটিকয়েক প্রশ্নের উত্তর তাঁর জানা ছিল। বাদবাকি প্রশ্নের উত্তর হয় অজানা, কিংবা মনে নেই। বাম চোখ কেঁপে উঠল একবার। অমঙ্গলের সংকেত। দিনের শেষে তাঁর আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল। পরীক্ষার রেজাল্টে স্পষ্ট হল অনুমান। একশোর মধ্যে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর মাত্র কুড়ি! এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। পুরো ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে কম নম্বর ছিল সেটি। তখন মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি'র মনে হয়েছিল — 'এখানেই শেষ।'
ফ্রান্সজাত আমেরিকান রসায়ন বিজ্ঞানী ড. মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি (জন্ম – ১৫ মার্চ ১৯৬১)
হ্যাঁ, মৌঙ্গি বাওয়েন্ডির জীবনের গল্প চলছিল এতক্ষণ। সে-ই মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি, যিনি এবার (২০২৩) রসায়নে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। এ হেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীর জন্ম ফ্রান্সের প্যারিস শহরে, ১৫ মার্চ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর বাবা তিউনিশিয়ার বিখ্যাত গণিতজ্ঞ মহম্মদ সালাহ বাওয়েন্ডি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের নামকরা প্রফেসর ছিলেন। একসময় ফ্রান্স ও তিউনিশিয়ার মায়া ত্যাগ করে শিশুপুত্র সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন সিনিয়র বাওয়েন্ডি। মৌঙ্গি তখন খুব ছোট। বিদেশ বিভুঁইয়ে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে তিনি উঠলেন ইন্ডিয়ানা প্রদেশের পশ্চিম লাফায়েট্টে শহরে। সেখানকার পারডিউ ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে কাজে যোগ দিলেন ড. সালাহ। এখানেই ছোট্ট মৌঙ্গি'র বড় হয়ে ওঠা। পড়াশুনার হাতেখড়ি। স্থানীয় পশ্চিম লাফায়েট্টে জুনিয়র-সিনিয়র হাইস্কুল থেকে ১৯৭৮ সালের স্নাতক তিনি। উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য এরপর মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি পাড়ি দিলেন হাভার্ড ইউনিভার্সিটি। সেখানে ১৯৮২-তে ব্যাচেলর অব আর্টস এবং পরের বছর মাস্টার অব আর্টস। মাস্টার ডিগ্রি পাসের পর ভর্তি হলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রথিতযশা অধ্যাপক তখন ড. কার্ল ফ্রেড এবং ড. তাকেশি ওকা। দুই প্রফেসরের অধীনে শুরু হল তাঁর গবেষণা। প্রফেসর ফ্রেড-এর সঙ্গে মিলে তাত্ত্বিক পলিমার ফিজিক্সের উন্নতি সাধনে সচেষ্ট হলেন। অন্য দিকে, ওকা-এর সঙ্গে ট্রাইটিয়াম আয়নের হট-ব্যান্ডের উপর গবেষণার কাজ দারুণ উদ্যমে চলতে থাকে। শেষমেশ, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি হাসিল করে ফেলেন ড. মৌঙ্গি।
মৌঙ্গি বাওয়েন্ডি তখন কলেজ-স্টুডেন্ট। সেসময় বেল ল্যাবরেটরিতে একখানা গ্রীষ্মকালীন প্রোগ্রাম সংঘটিত হবার কথা। শতাব্দী প্রাচীন ল্যাবরেটরিতে তখন কোয়ান্টাম বিন্দু নিয়ে গবেষণা চলছে। ড. ওকা'র সুপারিশে সেখানে পৌঁছতেই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক মি. লুইস ব্রুস কোয়ান্টাম ডটস রিসার্চের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে। সেই শুরু। তারপর আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাননি তিনি। গ্র্যাজুয়েশন শেষে মিঃ ব্রুস-এর সঙ্গে পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চের কাজে বেল ল্যাবে পৌঁছে গিয়েছিলেন মৌঙ্গি। ১৯৯০ সালে তিনি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT) জয়েন করেন। ছয় বছর পর MIT-এর প্রফেসর হন।
অথচ আশ্চর্যের বিষয়, গ্র্যাজুয়েশনের প্রথম বছরে তাঁর উপর নেমে এসেছিল কঠিন যে-সময়, পরের বছরগুলোতে সেই কালো মেঘ নিমেষে উধাও শুধুমাত্র তাঁর কঠোর অধ্যবসায়ের কারণে। বাওয়েন্ডি তখন কলেজে স্নাতক পড়ে। ভীষণ পছন্দের বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি। রসায়ন বলতে সে অজ্ঞান। খুব ভালো লাগে পরমাণু, নিউক্লিয়াস, বিক্রিয়া ইত্যাদি। কিন্তু ভালো লাগা আর পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া – দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। বিষয়ের উপর প্রচণ্ড দখলদারিত্ব থাকলেই বুঝি সবসময় ভালো মার্কস পাওয়া যায়! এমন গ্যারেন্টি আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি, দিতে পারবেও না। ভালো মার্কস পেতে চাই সঠিক পরীক্ষা প্রস্তুতি। ঠিক মতো প্র্যাকটিস না হলে যত বিপত্তি! পরীক্ষা হলে প্রশ্নপত্র দেখে ভিরমি খাবার জোগাড় উপস্থিত হয়। পরীক্ষার খাতায় কী লিখব, কতটা লিখব, লেখা শুরু করব কীভাবে, শেষ কোথায় টানবো, কোনটা লিখব, কোনটা ছাড়ব ইত্যাদি ভাবনায় কলেজের প্রথম দিকে ব্যতিব্যস্ত ছিল তাঁর অস্থির মন। দ্বন্দ্ব নিজের ভেতরে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সঠিক উত্তর জানা প্রশ্নপত্রের উত্তরে অযাচিত ভুল। রেজাল্ট, তাঁর কথায়, একশোর মধ্যে মাত্র কুড়ি। এই অকৃতকার্য তাঁর জেদ বাড়িয়ে দেয়। কেন কম? ঘুরে দাঁড়ানোর সেই শুরু। সাংবাদিকদের তিনি বলে চলেন – 'কীভাবে পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করতে হয়, তা বের করেছিলাম, যা আমি আগে জানতাম না।'
একটু থেমে আবার শুরু করলেন – 'এরপরের অনেক পরীক্ষায় আমি একশোতে একশো পেয়েছিলাম।'
অবাক হয়ে এক নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীর কথাগুলি মন দিয়ে শুনছিল সকলে। তাঁর লড়াইয়ের গল্প শুনতে শুনতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়। ভেতর থেকে অদৃশ্য শক্তি জাগ্রত হয়। অতিরিক্ত অ্যাড্রিনালীন ক্ষরণ হয়। জীবনে না-পাওয়ার বেদনায় এখন আর কষ্ট হয় না, বরং না-পাওয়া জিনিস ফিরে পাওয়ার ইচ্ছাশক্তি বেড়ে যায় বহুগুণ। বিশ্বের যুবসমাজের উদ্দেশে নোবেল জয়ীর দৃপ্ত ঘোষণা –
'অধ্যবসায়ী হও এবং বাধা বিপত্তিগুলো এলে হতাশ হয়ো না, সচেতন থাকবে তোমাদের যেন কোনও কিছু ধ্বংস করতে না পারে। 'এফ' (ফেল করা) শব্দটির সঙ্গে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা আমাকে সহজেই ধ্বংস করে দিতে পারত। ওটি এখন পর্যন্ত ছিল আমার সর্বনিম্ন গ্রেড।'
বাওয়েন্ডি বর্তমানে 'ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট' (এমআইটি)-এর অধ্যাপক।
(২)
খুব শক্তিশালী একখানা অণুবীক্ষণযন্ত্র তাক করা আছে সাদা পৃষ্ঠায় আঁকা একটা বিন্দুর উপর। নীল কালির বিন্দু যার দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা কিছুই প্রায় নেই, সম্বল বলতে কেবল একটা অস্তিত্ব। একটা অবস্থান। সত্যিই কি তাই? আপনি যা দেখছেন, যা ভাবছেন, তা কতখানি সত্য? খালি চোখে যাকে শুধুমাত্র একটি বিন্দু বলে আপনার ভ্রম হচ্ছে, তার আসল পরিচয় কী? মাইক্রোস্কোপের লেন্সের তলায় তাকে কেমন দেখতে লাগে একবার ভেবে দেখেছেন? চলুন, আপনাকে নিয়ে একটু কল্পরাজ্য ঘুরে আসি। আপনি নিশ্চয়ই ব্যাপারটায় বেশ একটা রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছেন? আসলে রহস্য নয়, কুরুক্ষেত্রের ময়দানে যুদ্ধ চলাকালীন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয় মিত্র অর্জুনকে যে-বিশ্বলোক দর্শন করান, এটা খানিকটা তার মতো ঘটনা। ওই ঘটনার পর শ্রীকৃষ্ণের প্রকৃত স্বরূপ অর্জুনের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল। এখন যদি কোনো জিনিসের স্বরূপ উদঘাটনকে আপনি রহস্যের নাম দেন, তবে তা-ই সই! চলুন, এখন ওই বিন্দুর প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটন করি। জেনে নিই ওর আসল পরিচয় কী? ক্ষমতা কত?
তার আগে যন্ত্রের ক্ষমতা দশ লক্ষ গুণ বাড়িয়ে দিন। মাইক্রোস্কোপের লেন্সে চোখ রেখে বলুন তো কী দেখতে পাচ্ছেন? নীল কালির মূল উপাদানটাকে দেখতে পাবেন আপনি। এবার যন্ত্রের ক্ষমতা একশো কোটি গুণ বাড়িয়ে ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। কী দেখছেন? এবার দেখা যাবে সেই উপাদানটা, যাকে দেখার জন্য আপনি এতক্ষণ উৎসুক হয়ে এই অধমের সমস্ত কথাগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। কী সেই উপাদান? রাসায়নিক পদার্থের উপকরণগুলি। অণু কিংবা পরমাণু। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন পদার্থের ওই উপাদানগুলো কত ক্ষুদ্র!
এক মিটার দৈর্ঘ্য বলতে আন্দাজে দুই হাতের সামান্য বেশি দূরত্বকে বোঝায়। অর্থাৎ, এক মিটার = ২.১৮৭২৬ হাত। এখন এক মিটার দূরত্বকে যদি একশো কোটি বা এক বিলিয়ন সমান খণ্ডে ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে প্রতিটি সমান খণ্ডের মান দাঁড়াবে এক ন্যানোমিটার। দূরত্বের এই পাল্লার মধ্যে যে সব কণার আকার, তারাই ন্যানো-পারটিক্যাল নামে খ্যাত। ন্যানো-মিটার রেঞ্জের মধ্যে একটি বিশেষ পদার্থের কেলাস হল কোয়ান্টাম ডট অথবা কোয়ান্টাম বিন্দু। একেকটা কোয়ান্টাম বিন্দু গড়ে এক ন্যানো-মিটার থেকে একশো ন্যানো-মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। সেজন্যে, এই বিশেষ ধরণের ন্যানো-পারটিক্যালের ভেতরে শ'খানেক পরমাণু আরামসে ঢুকে যেতে পারে। এত ক্ষুদ্র জায়গার মধ্যে পরমাণুগুচ্ছ তখন একসঙ্গে জোট বেঁধে একটি পার্টিক্যালের মতো আচরণ করে। ন্যানোমিটার স্কেলে জোট বদ্ধ এমন বিশেষ ধরণের পরমাণু গুচ্ছের কেলাস 'কোয়ান্টাম বিন্দু' বা 'কোয়ান্টাম ডট' নামে আজকের বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যদিও পুরো সত্যিটা বলা হল না। কী সেই সত্য ঘটনা? আসলে যেকোনো পদার্থের পরমাণুগুচ্ছ কোয়ান্টাম বিন্দু নয়। তাহলে?
তড়িৎ পরিবহনের ক্ষমতা প্রত্যেক পদার্থের আলাদা আলাদা। তা নির্ভর করে বেশ কিছু ভৌত ও রাসায়নিক ঘটনার উপর। একটি ফ্যাক্টর হল স্বাধীন ইলেকট্রনের উপস্থিতি। যে পদার্থে মুক্ত ইলেকট্রন সংখ্যা বেশি, তার তড়িৎ পরিবাহিতা ঈর্ষণীয়ভাবে বেশি হবে। আবার যারা বেশি পরিমাণে তড়িৎ পরিবহন করতে সক্ষম, তারা ধাতু বা পরিবাহী। উল্টোদিকে, একদম ক্ষীণ তড়িৎ পরিবহন করে কুপরিবাহী অথবা অন্তরক পদার্থগুলো। অর্থাৎ, এদের তড়িৎ পরিবাহিতা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি বললেই হয়। এই দুই পদার্থের মাঝামাঝি রয়েছে আর এক বিশেষ জাতের পদার্থ। এরা অর্ধপরিবাহী। এদের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা ধাতুর চাইতে কম, কিন্তু কুপরিবাহী পদার্থের চেয়ে বেশি। আসলে কোনও পদার্থের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা ঋণাত্মক তড়িৎগ্রস্থ ইলেকট্রনের উপর বর্তায়। যার মুক্ত ইলেকট্রন সংখ্যা বেশি, ধাতব তারের মধ্য দিয়ে সে অধিক পরিমাণে ইলেকট্রিক কারেন্ট পাঠায়। মুক্ত ইলেকট্রন! সে আবার কী জিনিস? কীভাবে তৈরি হয় স্বাধীন ইলেকট্রন? তড়িৎ পরিবহনের জন্য কোন ইলেকট্রন দায়ী? তড়িতের জন্য পরমাণুর সব ইলেকট্রন এর জন্য দায়ী নয়। যারা প্রকৃত দায়ী, তারা মাত্র দুটি শক্তি স্তরে অবস্থান করে। যোজ্যতা শক্তিস্তর বা পটি আর পরিবহন পটি। একটি পারমাণবিক ইলেকট্রনের আঁতুড়ঘর হল কম শক্তির যোজ্যতা পটি। স্বাভাবিক অবস্থায় পরমাণুর একটি ইলেকট্রন যোজ্যতা পটিতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ এর শক্তি কম। ন্যূনতম শক্তি থাকলে শান্তিপূর্ণ স্থির থাকা যায়। এটাই পারমাণবিক সাম্যাবস্থায় থাকার শর্ত। কিন্তু বড়লোক কে না হতে চায়? একখান ইলেকট্রন বড়লোক বনে যেতে পারে যদি তার শক্তি বৃদ্ধি পায়। আর শক্তি বাড়লেই যত অশান্তি! কোয়ান্টাম থিওরি হুকুম জারি করে — পূর্বের কক্ষে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলে সে। তার কাছে তখন দুটি উপায়। হয় অতিরিক্ত এনার্জি শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। অন্যথায়, উচ্চ শক্তির নতুন কক্ষে গিয়ে বাসা বাঁধতে হবে। অধিকাংশ নিম্ন শক্তির ইলেকট্রন শেষের পথটি বেছে নেয়। উপযুক্ত শক্তি নিয়ে কোনোক্রমে যোজ্যতা পটি থেকে উচ্চ শক্তির পরিবহন পটিতে গমন করে এবং যোজ্যতা পটিতে একটি শূন্যস্থান তৈরি হয়। ইলেকট্রনের সেই ঘাটতি বা শূন্যস্থানকে হোল বা গর্ত নামে সম্বোধন করা হয়। এর আধান ধনাত্মক প্রকৃতির। আসলে হোল এক ভার্চুয়াল কণিকা। বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই, শুধু ধারণা রয়েছে।
ওদিকে, পরিবহন শক্তি পটিতে ইলেকট্রন তখন পুরোপুরি মুক্ত। স্বাধীন। অর্ধপরিবাহীর পরিবহন পটিতে ইলেকট্রন ও যোজ্যতা পটিতে হোল – উভয়ের উপস্থিতি পদার্থটির তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। স্বাধীন ইলেকট্রনগুলি যদি খুব বেশি ক্ষণ পরিবহন-পটিতে তিষ্ঠাতে না পারে, তবে তারা পুনরায় যোজ্যতা পটিতে ফিরে আসতে চেষ্টা করে ও যোজ্যতা শক্তিস্তরে হোলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একবার মিশে গেলে আর রক্ষে নেই। তখন ইলেকট্রন ও হোল উভয়ের অস্তিত্ব বিলোপ পায়। বিনিময়ে জন্ম নেয় আগুনের ফুলকি। বেরিয়ে আসে আলো। সে-আলোয় থাকে ইলেকট্রন-হোল যুগ্মের দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এই যে ইলেকট্রন ও হোল পরস্পর যুক্ত হয়ে আলো তৈরি করে ফেলল, এর একটা জুতসই নাম আছে। 'রি-কম্বিনেশন' (Recombination)। সে না-হয় হল! ইলেকট্রন-হোল যুগ্মের সঙ্গে কোয়ান্টাম বিন্দুর কী সম্পর্ক? কোয়ান্টাম বিন্দুর কী বৈশিষ্ট্য? খায়, না মাথায় মাখে! কী কাজে লাগে? কীভাবে সংশ্লেষণ করা যায়? হাজারো প্রশ্নে ঝালাপালা কৌতুহলী মন। মনের মধ্যে অনুচ্চারিত কথাগুলো অস্থির করে তোলে। জানতে চায় সদুত্তর।
এবার আসা যাক কোয়ান্টাম বিন্দু প্রসঙ্গে। কোয়ান্টাম ডট আসলে পরিবর্তনশীল আকারের এক বিশেষ অর্ধপরিবাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে ইলেকট্রনের মতো লক্ষণ রয়েছে। ইলেকট্রনীয় ধর্মের মূলে আছে এক্সাইটন। এক্সাইটন! এ আবার কী জিনিস? আসলে ইলেকট্রন ও হোল বা গর্তের আরেক নাম এক্সাইটন। এরা তিন দিক থেকে ঘেরা থাকে। ঠিক যেমন কুঁয়ার জলে ভেসে থাকে ব্যাঙ কিংবা মাছ। তিন দিক ঘেরা থাকলেও বস্তুর ইলেকট্রনিক লক্ষণগুলো কখনও চাপা পড়ে থাকে না। একদিন না একদিন ঠিক সত্যিটা বের হয়। কী সেই লক্ষণ?
সমান সাইজের কোলয়ডীয় কোয়ান্টাম বিন্দু তৈরি
কোয়ান্টাম মেকানিক্স মানেই অনিশ্চয়তার ঘনঘটা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স হল আলাদা আলাদা শক্তি সম্পন্ন অনেক কক্ষ ও তার মধ্যে ঘটে চলা রহস্যময় কাণ্ডকারখানা। একটি কণা হয়তো কোনো শক্তিস্তরে রয়েছে। সমস্ত কক্ষ বিবেচনা করলে যেকোনো একটি স্তরে কণার থাকার খুব ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে। কোয়ান্টাম থিওরি অনুযায়ী, অণু বা পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের জন্য রয়েছে বেশ কিছু স্থায়ী কক্ষপথ। ওই কক্ষপথ গুলির একটি করে নির্দিষ্ট শক্তি রয়েছে। যখন যে ইলেকট্রন যে-কক্ষে থাকে, সেটাই ইলেকট্রনের কক্ষ ও তার শক্তি ইলেকট্রনের শক্তি গন্য করা হয়। কক্ষপথগুলির শক্তি ছাড়া ইলেকট্রনের আর কোনো শক্তি থাকতে নেই। তাই কোনো ইলেকট্রন পর পর দুটি কক্ষের মাঝে থাকতে অপারগ। তবে এক কক্ষ থেকে উপর বা নীচের কক্ষে যাওয়া আসা করতে বাধা নেই। যে-কক্ষে সে যেতে চায়, তার সমান এনার্জি থাকা জরুরী। আবার একখানা নতুন ফরমান আছে। পাউলি'র অপবর্জন নীতি অনুযায়ী, একটি কক্ষে একটি মাত্র ইলেকট্রন থাকতে পারে, তার বেশি নয়। বেশি ইলেকট্রন থাকলে খুব সমস্যা। ঝগড়াঝাঁটি। মারপিট অহরহ লেগেই থাকে।
কোয়ান্টাম বিন্দু এমন কিছু অর্ধপরিবাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি, যার ইলেকট্রনীয় লক্ষণ রয়েছে। ইলেকট্রনিক লক্ষণগুলো পদার্থের আকার ও আকৃতির উপর নির্ভর করে। ধরা যাক, একটা গ্রহ। পৃথিবী। বেশ কিছু পদার্থ দিয়ে তৈরি সে। ভরের জন্য তারার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। এই ঘুরে বেড়ানোর মূলে রয়েছে এক টান। পৃথিবী ও সূর্যের মহাকর্ষ। যদিও আজকাল এ প্রসঙ্গ সত্য নয়। তারার চারপাশে গ্রহের ঘোরা নির্ভর করে স্থান-কালের বক্রতার উপর। এ হেন স্থান-কাল জ্যামিতির প্রবক্তা বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তাহলে দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত বস্তুর বেলায় যে নিয়ম খাটে, তা আইজাক নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র কিংবা কিংবদন্তি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা-বাদ তত্ত্ব। এখন সাধের পৃথিবীটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো খণ্ড করলে কী অবশিষ্ট পড়ে থাকে? ঝুরঝুরে মাটির মতো লক্ষ নিযুত কোটি অর্বুদ নির্বুদ পারমাণবিক কণা। যেমনি আস্ত একখান পৃথিবী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকায় ভেঙে গেল, অমনি মহাকর্ষ উধাও। তার বদলে লাগু হয় নতুন নিয়ম। নতুন আইনকানুন মোতাবেক শুরু হয়ে গেল কণাগুলোর অদ্ভুত আচরণ! আস্ত গোটা একটা পৃথিবী যে-নিয়মে চলত, রাতারাতি আমূল বদলে গেল সবকিছু। তার বদলে কণা জগতে চালু হল কোয়ান্টাম নীতি। অণু বা পরমাণুতে আবদ্ধ ইলেকট্রনগুলি আর যেকোনও শক্তি গ্রহণ করে চলাফেরা করছে না। কিছু বিচ্ছিন্ন শক্তি সমেত নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তারা। হঠাৎ করে এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ? কী এমন ঘটল যে মহাকর্ষ টান ছেড়ে স্থির-তড়িৎ-বলের হাত ধরল?
কোয়ান্টাম থিওরির সঙ্গে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রের বিস্তর ফারাক। কোয়ান্টাম কণিকার সাইজ যত ছোট হয়, পটি-পার্থক্য তত বাড়ে। যোজ্যতা পটি ও পরিবহন পটির শক্তির তারতম্য বেশি হলে যোজ্যতা পটি থেকে একটি ইলেকট্রনকে জোরপূর্বক পরিবহন পটিতে আনতে বেশি এনার্জি ব্যয় করতে হয়। উল্টোদিকে, পরিবহন পটি থেকে যোজ্যতা পটিতে ফিরে এলে কী ঘটে? যোজ্যতা পটির তুলনায় পরিবহন পটির শক্তি বেশি। বেশি শক্তিস্তর থেকে কম শক্তিস্তরে ঝাঁপ দিলে সমস্যা বাঁধে অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে। নিম্ন শক্তিস্তরে আসবার কালে কণাটি ওই অতিরিক্ত শক্তি শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়া শক্তি থেকে জন্ম নেয় আলোক তরঙ্গ। ফোটন কণিকার স্রোত।
এখন, কোয়ান্টাম বিন্দুর শক্তি তার আকারের উপর নির্ভর করে। এক্সাইটনের 'বোর ব্যাসার্ধ'-এর চেয়ে বিন্দুর সাইজ যখন ছোট হয়, তখন এর প্রত্যেক শক্তিস্তর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কয়েকটি ছোট ছোট উপশক্তিস্তরে বিভক্ত হয়। এই অবস্থাটি দুর্বল সীমাবদ্ধ অঞ্চল। ঘুরে পাশার দান উল্টে দিলে সবল সীমাবদ্ধ অঞ্চল তৈরি হয়। কোয়ান্টাম বিন্দুর আকার দশ ন্যানোমিটারের থেকে ছোট হলে বিন্দুর কোয়ান্টাম লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। স্পষ্ট হয় আলোক নির্গমনের সমূহ সম্ভাবনা। কোয়ান্টাম বিন্দু তখন নেবুলা রঙে ভাস্বর হয়ে ওঠে।
(৩)
নেবুলা রঙে উজ্জ্বল মধ্য রাতের তারা
'এখানে এখন মধ্য রাত্রি।'
মোবাইলের বিরক্তিকর রিংটোনে যখন আলেক্সেই ইয়েকিমভ-এর ঘুম ভাঙে, ঘড়িতে তখন মাঝরাত। বাইরে গাঢ় অন্ধকার। ঘোর অমাবস্যা। কোথাও এতটুকু আলো নেই। গভীর নিদ্রায় ডুবে রয়েছে গোটা বিশ্ব-পৃথিবী। খোলা জানালার ফাঁকে ধরা পড়ে একফালি আকাশ। সেখানে লক্ষ নিযুত কোটি তারার মেলা। ঘন অমানিশায় ঝলমলে আলো জ্বেলে সারারাত জেগে থাকে মধ্য রাতের তারাগুলি। জায়গাটা ফিনল্যান্ড লাগোয়া সোভিয়েত রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ। যত দূর দৃষ্টি যায়, সেই দিকচক্রবাল জুড়ে কেবল পুরু বরফের চাদরে ঢাকা। জনমানবশূন্য প্রদেশ। ধূ ধূ প্রান্তরে নিস্তব্ধ চরাচর। নির্জন বরফ-ঢাকা প্রান্তরে টুপটাপ তুষার পড়ার শব্দ শোনা যায় কান পাতলে। কাক পক্ষী কেউ টের পায় না সে-আওয়াজ। কনকনে হিমেল হাওয়ায় ইতস্তত উড়ে বেড়ায় তুষার বিন্দুগুলো। যেদিকে দৃষ্টি যায়, শুধুই শ্বেতশুভ্র বরফের মরুভূমির স্বর্গীয় দৃশ্য। পাইন বনে পুরু তুষার জমেছে। অব্যক্ত গাছ, না সাদা শাড়ি পরিহিতা বিশালাকার উঁচু ঢিবি – ঠাহর হয় না দূর থেকে দেখলে।
রাশিয়ান রসায়নবিদ ড. আলেক্সেই ইয়েকিমভ (জন্ম – ১৯৪৫)
বাইরের তাপমান শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে। ঘরের মধ্যে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলছে। বিছানায় জেগে রয়েছেন আলেক্সেই। যার রিংটোনে তাঁর ঘুম ভাঙল, নোবেল কর্তা সেই অ্যাডাম স্মিথের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে মোবাইলে। নোবেলজয়ের সুসংবাদ দিতেই এত রাতে তাঁর ফোনালাপ। ফিরতি অভিবাদন ব্যক্ত করে নোবেলজয়ীর করুণ সুর —
'এখানে এখন মধ্য রাত্রি।'
তাঁর স্বরে মিশ্র অনুভূতি মেশানো। আনন্দের পাশাপাশি আকস্মিক উত্তেজনা। উত্তেজনার বশে শরীরে তখন দ্বিগুণ হারে অ্যাড্রিনালীন হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়েছে। হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়া। সবকিছু যেন ওলটপালট অবস্থা। কোনো কিছু স্থির নয়। চারপাশের চেনা পৃথিবীটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে তাঁর মনে হল। যদিও তাঁর কথায় ক্লান্তির ছিঁটেফোঁটা নেই। উত্তেজনা রয়েছে। রয়েছে একরাশ আনন্দ। সুখের পরশ মেখে তাঁর মুখমণ্ডল জুড়ে লক্ষ নিযুত কোটি কোয়ান্টাম বিন্দুর খুশির ঝিলিক ধরা পড়ে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের হাঁড়ির খবর চরম গোপনীয়তায় চিরকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে। রাজনীতি হোক বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার – নিরাপত্তার দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে অন্দরমহলের গোপন খবর বিশ্বের কাছে ধরা দেয়নি অত সহজে! উদাহরণ হাতের কাছে রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো'র ঘটনা কেউ বিস্মৃত নয়। যুদ্ধের অনেক আগের ঘটনা সেটা। ব্রিটেন থেকে দেশে ফেরার অব্যবহিত পরে তাঁর সঙ্গে কী ঘটনা ঘটেছিল, বাইরে থেকে তখন কেউ জানত না। বেশ ক'বছর লুকোচুরি খেলা খেলার পর তাঁর খবরাখবর জানা যায়। বারবার এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু স্থান-কাল-পাত্র পরিবর্তন হয়েছে। অথচ সে-দেশের আভ্যন্তরীন কৌশল কখনও বে-নিয়ম হয়নি। সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে সকলের বেশ কৌতুহল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তখন শেষের শুরু। যুদ্ধ থামার কাউন্টডাউন শুরু হয়েছে। বাতাসে বারুদের গন্ধ ম ম করছে। এমন ঐতিহাসিক সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় আলেক্সেই ইয়েকিমভ-এর জন্ম ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে ফেব্রুয়ারি। লেনিনগ্রাদ-এ, অধুনা সেন্ট পিটার্সবার্গ, তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। হাইস্কুলের পাঠ সমাপ্ত করে গ্র্যাজুয়েশনের লক্ষ্যে ভর্তি হলেন লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি (বর্তমানে, সেন্ট পিটার্সবার্গ ইউনিভার্সিটি)। সেখান থেকে ফিজিক্সে স্নাতক ১৯৬৭ সালে। এবার তাঁর পাখির চোখ পিএইচডি ডিগ্রি। রাশিয়ার নামকরা একটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে সেন্ট পিটার্সবার্গ-এ। নাম 'লোফ্ফে ফিজিক্যাল-টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট'। রিসার্চ সেন্টারটি রাশিয়ান একাডেমী অব সায়েন্সের অধীন। এখান থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ডক্টরেট উপাধি হাসিলের পর তিনি পুরোদস্তুর রিসার্চের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পৌঁছলেন ভাভিলভ স্টেট অপটিক্যাল ইনস্টিটিউটে। অর্ধপরিবাহী-সক্রিয় কাঁচ, যার আরেক নাম 'স্কট গ্লাস', নিয়ে শুরু হল দ্বিতীয় পর্বের গবেষণা। ওই রঙীন কাঁচে নানান রঙ তৈরির যে থিওরি বা সমীকরণ, তার অনুসন্ধানে ব্যস্ত পণ্ডিত। কাঁচকে গরম করে রঙ মেশালে কপার ক্লোরাইড কেলাস সৃষ্টি হয়। সৃষ্ট কেলাস যে নীল বর্ণ ধারণ করে, তা রঞ্জন রশ্মির সাহায্যে সনাক্ত করা যায়। বিশেষ করে ছোট ছোট কেলাসগুলি হালকা নীল রঙের কাঁচ তৈরি করে।
সময়টা ছিল ১৯৮১ সাল। ইয়েকিমভ এবং তাঁর সহকর্মী আলেক্সেই অনুশ্চেঙ্কো একখানা জার্নাল প্রকাশ করে। সেখানে তাঁরা ব্যাখ্যা করলেন রিসার্চের বিষয়বস্তু। কাঁচের মধ্যে কপার ক্লোরাইড যৌগে ন্যানোক্রিস্টালের কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য সমূহের কথা জার্নালে ফলাও করে ছাপলেন। এ হেন
ন্যানোক্রিস্টাল 'কোয়ান্টাম ডট' নামে পরিচিত। এই আবিষ্কার তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। ২০২৩ সালে রসায়নে নোবেল পদক আসে ওই বিন্দুর হাত ধরে। তারপর ভলগা নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ১৯৯৯ সাল। তিনি পাড়ি দিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার নিউইয়র্ক-ভিত্তিক কোম্পানি 'ন্যানোক্রিস্টাল টেকনোলজি ইনকর্পোরেটেড'-এর উঁচু পদে বৈজ্ঞানিক হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন।
(৪)
নোবেলজয়ী রসায়নবিদ লুইস ব্রুস
লুইস ইউজিন ব্রুস-এর জন্ম আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওহিয়ো প্রদেশের ক্লিভল্যান্ড অঞ্চলে, ১৯৪৩ সালের ১০ আগস্ট। ক্যানসাস শহরের রোল্যান্ড পার্কে তাঁর হাইস্কুল জীবনের আরম্ভ। স্কুল জীবন থেকে তাঁর মেধার উন্মেষ ঘটে। তখন থেকেই ভৌত বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক, টান, ভালোলাগা বিষয় তৈরি হয়। ফিজিক্স ও রসায়নে তুখোড় বনে যায়। স্কুল স্তরের বৃত্তি পরীক্ষায় মিলল সাফল্য। কলেজে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার স্কলারশিপ মিলে গেল। নোভাল রিসার্চ অফিসার্স ট্রেনিং কর্পস (NROTC) স্কলারশিপ। এ হেন বৃত্তির একটা বিশেষ শর্ত ছিল। মার্কিন নৌবাহিনীর অপেক্ষাকৃত কম রেঙ্কের পদ ছিল মিডশিপম্যান। এই অফিসার পদটি তৈরি হয়েছিল মূলত কলেজ স্টুডেন্টদের দিকে তাকিয়ে। বৃত্তির শর্ত অনুসারে মিডশিপম্যান হিসেবে একজন কলেজ পড়ুয়ার পড়াশুনার শেষে নৌসেনায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। শেষমেশ NROTC স্কলারশিপ নিয়ে লুইস ব্রুস ভর্তি হলেন রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেটা ১৯৬১ সালের কথা। কলেজে পছন্দের বিষয় ছিল বিজ্ঞান। বিশেষত ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথেমেটিকস। ১৯৬৫ সালে বিজ্ঞানে স্নাতক হলেন তিনি। B.S. (Bachelor of Science) ডিগ্রি হাসিল করে পিএইচডি'র নেশা চেপে বসল তাঁর মাথায়। চললেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথিতযশা অধ্যাপক ড. রিচার্ড বারসন-এর অধীনে শুরু হল তাঁর গবেষণার কাজ। তাঁর পিএইচডি'র বিষয় কী ছিল? সোডিয়াম আয়োডাইড বাষ্পের উপর আলো ফেলে আয়োডাইড যৌগটিকে ভাঙা। গভীর অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে সফলতা মিলল হাতেনাতে। ফোটন কণিকার আঘাতে ভাঙল আয়োডাইড যৌগের চৌহদ্দি। পিএইচডি'র জন্য জমা পড়ল রিসার্চ পেপার। ১৯৬৯ সালে রাসায়নিক পদার্থবিদ্যায় মিলে গেল পিএইচডি ডিগ্রি।
আমেরিকান রসায়ন বিজ্ঞানী ড. লুইস ইউজিন ব্রুস (জন্ম – ১০ আগস্ট ১৯৪৩)
পূর্ব শর্ত মোতাবেক পিএইচডি শেষ করে তিনি যোগ দিলেন মার্কিন নৌবাহিনীতে। লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার অফিসার তিনি। মার্কিন মেরিন বিভাগের ওয়াশিংটন ডিসিতে সায়েন্টিফিক স্টাফ অফিসার পদে পোস্টিং। যত্ন সহকারে সেখানে নিজের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ব্রুস এখন আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত।
(৫)
কোয়ান্টাম বিন্দুর একাল ও সেকাল
আপনার রক্তনালীর মধ্যে কত লক্ষ নিযুত কোটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা অবিরাম ছুটে চলেছে দেহের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তার খবর রাখেন! আপনি বলবেন আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর না-ই বা রাখলাম। তা আপনার কথা অবশ্য ঠিক। কী দরকার ওদের হাঁড়ির খবর জেনে! শুধু শুধু মন উতলা হবে। তার চেয়ে বরং এই বেশ ভালো আছি। কারও খোঁজ রাখি না। একা একা থাকি। খাই দাই, ঘুমাই। 'আমি'কে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে খবর কাগজে চোখ রাখি। চা খাই। চা খেতে খেতে হাজার একটা শিরোনামে চোখ আটকায়। দেশের কথা, দশের কথা, রাজনীতির কথায় খিস্তিপাত করি। কিন্তু এ বছর রসায়নে কে নোবেল পুরস্কার পেল কি পেল না তা নিয়ে মাথা ঘামাই না। যত্তসব আজগুবি সংবাদ। হিজিবিজি লেখা। আংশিক বোধগম্য, বেশিরভাগটাই অবোধ্য এমন একখানা বিষয়ে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন অমুক বিজ্ঞানী। 'আচ্ছা, এই যে বিজ্ঞানীদের পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে সরকার কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলো, ঠিক করছে কি? এতে জনগণের কী উপকারটা হচ্ছে শুনি!' – আপনি ভাবছেন।
কোয়ান্টাম ডট প্রযুক্তি আবিষ্কার ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব এনেছে। এ হেন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে টিভির কিউএলইডি (QLED) স্ক্রিন তৈরি করা হয়। এর সাহায্যে উন্নততর এলইডি ( LED) বাতি তৈরি করা হয়েছে। জৈব টিস্যুর ম্যাপ তৈরিতেও কোয়ান্টাম বিন্দু অনস্বীকার্য। অপারেশনের সময় সার্জনদের গাইড করতে, মারণ রোগ ক্যানসারের ঔষধের আরও ভালো লক্ষ্য নির্ধারণে এবং সৌর প্যানেলগুলোতে মেডিকেল ইমেজিং ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও উন্নত পরিসেবা পাওয়া সম্ভব হবে। এমনকি টিভির পর্দায় আরও রঙিন ছবি দেখা যাবে কোয়ান্টাম বিন্দু প্রযুক্তির মাধ্যমে।
আশির দশকে ড. একিমভ এবং ড. ব্রুস তামার ক্লোরাইডের ন্যানো পার্টিক্যাল থেকে পাওয়া কোয়ান্টাম কণা গবেষণায় সাফল্য পেয়েছিলেন। ড. বাওয়েন্ডি আলোকপাত করেছেন রাসায়নিক পদ্ধতিতে কোয়ান্টাম বিন্দুর উৎপাদনে। নব্বইয়ের দশকে তিনি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নিখুঁত 'কোয়ান্টাম ডট' সৃষ্টি করেন।
0 Comments