শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৩৫ / সালেহা খাতুন
মনের রিলাকসেশন না হলে শরীরেরও হবে না। তখনকার শিক্ষানীতি অনুযায়ী অনার্স পার্ট ওয়ানে অনেক সময় পাওয়া যেতো। দুবছর ধরে চলতো পার্ট ওয়ানের প্রস্তুতি। ফলে অনেকটা সময় নিজের প্ল্যান মতো কাটানো যেতো। তবে চাপ নেহাত কম ছিল না। আসলে তখনও টাইম ম্যানেজমেন্ট একটি জরুরি ব্যাপার ছিল। দুটো জেনেরাল পেপার পড়তে হতো তিনশো তিনশো ছশো নম্বরের। আর অনার্স চারশো নম্বরের। তার সঙ্গে অ্যাডিশনাল পেপার একশো নম্বরের।
জেনেরাল পেপারে ইতিহাসের ক্লাস নিতেন সমরবাবু এবং স্নেহার্দ্রিবাবু। সমরবাবুর লেখা ইতিহাসের বই আমরা পড়তাম। স্যার অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। গৌর বর্ণের অধিকারী। ভারতের ইতিহাস পড়াতেন। যত্ন নিয়ে কত বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছেন। এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে যাতে বেরিয়ে না যায় তার জন্য অনেক টপিক লিখিয়েও দিয়েছেন। তাঁর লেখানো মগধের শাসন ব্যবস্থা (বিম্বিসার থেকে অশোক) সম্পর্কে একটি সুন্দর আলোচনা এখনও আমার খাতায় বর্তমান।
আর স্নেহার্দ্রিবাবু ইতিহাস পড়ানোর সাথে সাথে এন সি সির পাঠও দিতেন। খুব ভালো গণসংগীত গাইতেন। ক্লাসে পড়াতেনও ভারী গমগমে গলায়। ছাত্রীরূপে যথেষ্ট স্নেহ পেয়েছি ওঁর কাছে।
অধ্যাপিকা ড . নিবেদিতা চক্রবর্তী, আমার ম্যাডাম।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন পুলকবাবু , অধ্যাপক পুলক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা বলতাম পি কে বি। তিনি অত্যন্ত সাত্ত্বিক মানুষ। পণ্ডিচেরির শ্রীমার ভক্ত। অকৃতদার। দশাসই চেহারা। ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য পোশাক পরেন নি। স্যার বলতেন তাঁর জুতো সাধারণ দোকানে পাওয়া যায় না তাই তিনি অর্ডার দিয়ে জুতো বানান। কোনো অশ্লীল শব্দ জীবনে উচ্চারণ করেন নি। পড়ানোর মাঝে ঐ ধরনের কোনো শব্দ এলে তিনি বানান করে বোঝাতেন। কত কত আলোচনা তিনি লিখিয়ে দিয়েছেন। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্টিনের মতবাদ, বহুত্ববাদের সমালোচনা,জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার,জাতীয় জনসমাজের উপাদান, মার্কসবাদে লেনিনের অবদান, রাষ্ট্র সম্পর্কে গান্ধীজির ধারনা আরো অনেক বিষয়। শিক্ষার্থীদের যত্ন সহকারে পাঠদানের শিক্ষা তাঁর কাছেই পেয়েছি।
আশিসবাবুও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতেন। পড়া না করলে বি. এ. ক্লাসের শিক্ষার্থীদেরও কান ধরে দাঁড়াতে হতো। তবে আমার সৌভাগ্য যে আমাকে একদিনও ঐ শাস্তি পেতে হয় নি। পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল না বলে অনেকে গর্ব করেন, লাস্ট বেঞ্চে বসতেন বলে নিজের মহত্ব অনেকে ঘোষণা করেন, অন্যের যাপিত জীবনকে অনেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ যখন স্বতন্ত্র তখন তাদের ভাবনা চিন্তাও স্বতন্ত্র হবে। বোধও পৃথক হবে। একছাঁচে সবাইকে ঢালার দরকার নেই। নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে গিয়ে অন্যকে যেন আমরা ছোটো না করি। হ্যাঁ আমার শিক্ষক বন্দনা দেখে আমাকে আপনারা টিচার্স পেট বলতেই পারেন কিন্তু যাঁদের আমি মনেপ্রাণে শ্রদ্ধা করি এবং বিশ্বাসও করি তাঁরা নইলে আজকের আমি কোথায় তাঁদের ভুলি কী করে?
অনার্সে পরিতোষবাবু, শ্যামলবাবু, রণজিৎবাবু, তনুজাদি, নিবেদিতাদি, বিধানবাবু, লাইব্রেরিয়ান মীরাদি, ইংরেজির অধ্যাপক সন্তোষ কুমার চক্রবর্তী আমাদের পড়াতেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
রণজিৎবাবু যত্ন সহকারে পড়াতেন। স্যার থাকতেন শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে। একবার তনুজা আর আমি স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অবনী বাড়ি আছো’ কবিতাটির পাঠ নেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথের রুদ্ধগৃহ আর পথপ্রান্তে প্রবন্ধদ্বয় পড়েছি শুনে ক্লাসে খুব খুশি হয়েছিলেন।
নিবেদিতাদি আমাদের গণনাট্য পড়াতেন। উনি এখন পিংলা কলেজে পড়ান। ছাত্রী বলে ওঁর কাছে আদর পাওয়া এখনও অব্যাহত আছে। ইউ জি সি স্পনসর্ড ন্যাশনাল সেমিনারে আমাকে রিসোর্স পার্শন রূপে আহ্বান করেছিলেন। নিজের সম্পাদিত বইয়ে প্রবন্ধ লিখতে দিয়েছেন। কলেজের অনেক কনফিডেন্সিয়াল কাজেও আমায় দায়িত্ব দেন।
শিক্ষক এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমার জীবনের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বেলডুবি হাইস্কুলে পড়াকালীন স্কুলের রজতজয়ন্তীবর্ষ উদযাপনে অংশ নিয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণিতে আর স্কুলের পঞ্চাশবর্ষপূর্তিতেও গিয়েছিলাম তখন আমি কলেজে পড়াচ্ছি।
ইংরেজির অধ্যাপক ড.সন্তোষ কুমার চক্রবর্তী প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে আমাদের ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস পড়াতেন।
প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের রজতজয়ন্তী বর্ষ উদযাপন হচ্ছে যখন, তখন অনার্সে পড়ি। প্রভাতফেরিতে লালপাড় সাদা শাড়ি পরে অংশ নিই। সমগ্র আন্দুল পরিক্রমা করি আমরা। কলেজের সোশ্যাল ফাংশনের আনন্দ উপভোগ করি প্রাণ ভরে। শ্রাবন্তী মজুমদার, উৎপলেন্দু চৌধুরী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, পল্লবী চ্যাটার্জি প্রমুখ শিল্পীরা আসেন। অত্যন্ত ঘরোয়া একটা পরিবেশ ছিল প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে। গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে অনুষ্ঠান দিনের বেলাতেই হতো। ফলে আমাদের অংশ নিতে কোনো অসুবিধা হতো না।
(ক্রমশ)
0 Comments