জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৪ /বিজন সাহা

ব্লাগোভেশেনস্কি সাবর

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৩৪

বিজন সাহা 

কাজান ক্রেমলিন  - সিউইউম্বিকে টাওয়ার  

কাজান ক্রেমলিনের প্রধান রাস্তার ধারে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ডান দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সিউইউম্বিকে টাওয়ার। দীর্ঘ দিন যাবত ইতিহাসবিদরা বিতর্কে লিপ্ত কখন এই টাওয়ার তৈরি হয়েছিল সে নিয়ে।    এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৭৭ সালের কাজান ক্রেমলিনের পরিকল্পনায়। যেহেতু এই টাওয়ারের চূড়া থেকে কাজানকা ও ভোলগা – দুটো নদীই ভালো ভাবে দেখা যেত, তাই সে সময় এটা টহলের দায়িত্ব পালন করত। বিগত কয়েক শ বছর ধরে টাওয়ার সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত ছিল। কিছুদিন আগেও এটাকে পড়ন্ত টাওয়ার বলে চিহ্নিত করা হত প্রায় ২ মিটার হেলানো অবস্থায় ছিল বলে। কিন্তু কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র কিছুদিন আগে কম্পিউটার মডেলের মাধ্যমে দেখায় যে এভাবে চলতে থাকলে ২০৩৩ সালে টাওয়ার পড়ে যাবে। ফলে রিস্টোরেশন করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আমি প্রথম যখন এই টাওয়ার দেখি তখন সেটা পড়ন্ত অবস্থায় ছিল। যেহেতু এই নভেম্বরে কাজান গেলেও সময়াভাবে ক্রেমলিন যাওয়া হয়নি, তাই এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলতে পারব না। তবে এই টাওয়ার নিয়ে এক সুন্দর লোককথা প্রচলিত আছে যে সম্পর্কে আমরা এখন বলব।     

সিউইউম্বিকে টাওয়ার

ইভান গ্রজনি ১৫৫২ সালে কাজান অবরোধ করেন। সেসব দিনকালে নদী ছিল অন্যতম তো বটেই, এমনকি একমাত্র যোগাযোগের উপায়। তাই কোথাও যদি নদী অবরোধ করা হত, তাহলে আশেপাশের শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। যদিও কাজানের খানদের সাথে মস্কোর সম্পর্কের টানাপোড়ন শুরু হয় ১৪৬০ সালে তবে রুশদের কাজান জয়ের অভিযান শুরু হয় অনেক পরে। ১৪৮৭, ১৫২৪, ১৫৩০ ও ১৫৫০  সালের পরে ১৫৫২ সালে রুশদের কাজান জয়ের এ চেষ্টা ছিল পঞ্চম অভিযান। সে সময়ে কাজান ছিল দুই আগুনের মধ্যে। চেঙ্গিস খান ও তাঁর উত্তরসূরিরা এক সময় প্রায় সমস্ত দক্ষিণ রাশিয়া পদানত করেন। তখন মস্কো বলতে গেলে ছিলই না। কিয়েভ থেকে শুরু হয় রুশ সাম্রাজ্যের যাত্রা। এখানেই ৯৮৮ সালে রাজা আলেগ খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরেরা ভ্লাদিমির, সুজদাল, নভগোরাদ ইত্যাদি জনপদ স্থাপন করে রাজত্ব শুরু করেন। এক সময় ভ্লাদিমির, সুজদাল এসব তাতার ও মঙ্গোলদের অধীনস্থ হয়। কিন্তু ইভান গ্রজনির সময়ে মস্কো নিজেকে শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়ে তুলে। ইতিমধ্যে কাজান, বুলগার এসব রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এরমধ্যেই অবশ্য এসব রাজ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মস্কোর খৃস্টান রাজ্যের বিরুদ্ধে। ক্রিমিয়ার তাতারেরা তখনও বেশ শক্তিশালী ও কাজানের খানদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ। কাজানে মস্কোপন্থী আর ক্রিমিয়ার তাতারপন্থী গ্রুপ ছিল একই রকম শক্তিশালী। আর এই দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বই কাজানের কাল হয়। ইভান গ্রজনি যাত্রা করেন কাজান বিজয়ে। কাজান বিজয় ইভান গ্রজনির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কেননা এই বিজয় পরবর্তীতে আস্ত্রাখান জয়ের দুয়ার খুলে দেয়। যদিও ইভান গ্রজনির কাজান জয় ছিল দীর্ঘ ও সুপরিকল্পিত রণকৌশলের ফল তবে এর চেয়েও বেশি জনপ্রিয় লোককথা। যাহোক সে সময়ে কাজানের খান ছিলেন নাবালক শিশু, তাঁর হয়ে রাজকার্য চালাতেন তাঁর মা সিউইউম্বিকে। কথিত আছে যে কাজানের খানেরা তখন বিস্তীর্ণ স্তেপে যেসব যাযাবর জাতি বাস করত তাদের সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করে রানী করতেন। তবে রাজপ্রাসাদের অন্তঃকলহের কারণে এরা এসব বিয়ে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করত। সিউইউম্বিকে ছিলেন ভিন্ন রকমের। তিনি ভয় না পেয়ে এ গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন এবং জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাই তাঁকে কৃষকের রানী বলা হত। ইভান গ্রজনির সাথে সেই যুদ্ধে কাজান পরাজিত হয়, সিউইউম্বিকে বন্দী হন। তাঁকে মস্কো নিয়ে আসা হয় ও পরবর্তীতে কাসিমভের মস্কোপন্থী খান আলী শাহের সাথে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। তবে লোকমুখে পাওয়া যায় ভিন্ন ইতিহাস। সেই লিজেন্ড অনুযায়ী ইভান গ্রজনি সিউইউম্বিকেকে আত্মসমর্পণ করে তাঁর রানী হবার প্রস্তাব দিলে তিনি বলেন যদি ইভান গ্রজনি সাত দিনের মধ্যে কাজান ক্রেমলিনে সুউচ্চ টাওয়ার তৈরি করে নিজের ভালোবাসার প্রমাণ দিতে পারেন তবেই তিনি আত্মসমর্পণ করবেন। রুশ জার ইতালীর শিল্পীদের দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে টাওয়ার তৈরি করেন। তখন রানী সিউউম্বিকে টাওয়ার থেকে লাফিয়ে আত্মবিসর্জন দেওয়া শ্রেয় মনে করেন। বর্তমানে এই টাওয়ার সিউইউম্বিকে টাওয়ার নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হল বাস্তবে এই টাওয়ারটি তৈরি করা হয় কাজান বিজয়ের বেশ কয়েক বছর পরে। আমি যখন দিলীপকে এই লোককাহিনী শোনাই, ও বারবার বলে, এমনকি ঐতিহাসিক ভাবে সত্য না হলেও তুমি এই ঘটনা অবশ্যই উল্লেখ করবে। 

🍂

সিউইউম্বিকে টাওয়ারের যে পাশে প্রেসিডেন্ট ভবন তার অন্য পাশে সুন্দর ভাবে সাজানো কালো রঙের গম্বুজের রাজকীয় গির্জা। এর পেছনে তাইনিৎস্কি টাওয়ার। আগে এখানে ছিল খানদের টাওয়ার যার ভেতর দিয়ে কাজান বিজয়ের পর স্বয়ং ইভান গ্রজনি ক্রেমলিনে প্রবেশ করেন। রুশ ভাষায় তাইনা অর্থ গোপন। এখানে জলের গুপ্ত উৎস রয়েছে বলেই এর নাম তাইনিৎস্কি বা গুপ্ত টাওয়ার। আমরা এখন ধীরে ধীরে ফিরতে শুরু করেছি স্পাসস্কি তোরণের দিকে। এর পর দেখা যাবে কাজানের সবচেয়ে পুরনো স্থাপনা, রঙ বেরঙের গম্বুজ শোভিত ব্লাগোভেশেনস্কি সাবর। এই গির্জা পস্কভের স্থপতিরা ১৫৫৫-১৫৬২ সালে তৈরি করেন। পরে সাবরের পাশে ৫০ মিটার উঁচু সাদা পাথরের চ্যাপেল তৈরি করা হয়। চ্যাপেল সহ গির্জা  সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে পর্যন্ত কয়েক শ’ বছর টিকে ছিল। বিপ্লবের পর নতুন শাসকেরা ক্রেমলিন জনগণের জন্য বন্ধ করে দেন। বন্ধ করা হয় সব গির্জা। ১৯২৮ সালে চ্যাপেল ভেঙ্গে ফেলা হয় যা আজ পর্যন্ত পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। ১৯১৮ সালে বলশেভিকরা সাবরের সব গম্বুজ ভেঙ্গে ফেলে। আগে যেখানে চ্যাপেল ছিল এখন সেখানে ছোট্ট একটি উঠান মত। ২০০৩ সালে সেখানে কাজান ক্রেমলিনের স্থপতিদের মূর্তি স্থাপন করা হয়। দুই জন স্থপতির একজন তাতার যিনি খানদের রাজপ্রাসাদের পরিকল্পনা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পাশে স্পাসস্কি টাওয়ারের নকশা হাতে বসে আছেন একজন রুশ স্থপতি। মজার ব্যাপার হল এতদিন পর্যন্ত আমি জানতাম এটা কিরিলিক অক্ষরের আবিষ্কর্তা কিরিল ও মেফোদির স্ট্যাচু। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম সাথে থাকা স্থানীয় কেউ সেটাই বলেছিল।    

এর পরে পর্যবেক্ষণ স্কয়ার যেখান থেকে কাজানকা নদী ও শহর হাতের মুঠায় ধরা পড়ে। দূরে কাজান-আরেনা নামে নতুন স্টেডিয়াম, নীচে ক্রেমলিন বাধ। নীচে পুগাচভের আক্রমণে ক্রেমলিনের উত্তর-পূর্ব টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ। ক্রেমলিনের বাইরে এখান থেকে দেখা যাবে পারাস্কেভি পিয়াৎনিৎসির গির্জা আর একটু দূরে কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠিত কাজানের ঈশ্বর মাতার গির্জা। ২০১৯ সালে যখন ওদিকে যাই তখন ঈশ্বর মাতার গির্জা নির্মাণাধীন ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কাজানের ঈশ্বর মাতার আইকন রাশিয়ার অন্যতম সম্মানিত আইকন। অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারদর্শী এই আইকন কাজানে আবির্ভূত হয় ১৫৭৯ সালে। এমনকি উনবিংশ শতকেই কাজানের ঈশ্বর মাতার আদি আইকন কোথায় আছে সে সম্পর্কে সন্দেহ ছিল। এই আইকন নিয়েই কুজমা মিনিন ও প্রিন্স পাঝারস্কির নেতৃত্বে রুশ বাহিনী লিথুনিয়ান ও পোলিশ হানাদারদের হাত থেকে মস্কো মুক্ত করে। পরে খুব সম্ভব সোভিয়েত আমলে এই আইকন হারিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ভ্যাটিকান এই আইকন রুশ অর্থোডক্স চার্চের কাছে হস্তান্তর করে। প্রতিদান হিসেবে কাজানে ক্যাথলিক চার্চ নির্মাণ করা হয়।    

কাজান ক্রেমলিনের স্থপতিদের মূর্তি

মানুষ যেমন প্রথম প্রেমের খুটিনাটি আজীবন মনে রাখে ঠিক তেমনি মনে রাখে কোন জায়গায় প্রথম ভ্রমণ কাহিনী। এখনও মনে পড়ে ২০০৭ সালের কথা যখন বোগদান, ভিক্টর আর আমি কাজান ক্রেমলিনে ঘুরে বেরিয়েছিলাম। টুকটাক স্যুভেনির কিনতেও ভুলিনি। এরপর কত বার সেখানে গেছি, কিন্তু প্রথম দেখার স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। ক্রেমলিন থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা চলে গিয়েছিলাম সামনের রাস্তা ধরে। এর নাম ক্রেমলভস্কায়া উলিৎসা বা ক্রেমলিন স্ট্রীট। দুই ধারে পুরানো দিনের সুন্দর সুন্দর স্থাপত্যে শোভিত এই রাস্তা আমাদের নিয়ে গেছে কাজান ইউনিভার্সিটির সামনে। পথে পড়েছে বিজ্ঞানী লবাচেভস্কির স্ট্যাচু, ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর সব শেষে কাজান ইউনিভার্সিটির মূল ভবনের সামনে তরুণ লেনিনের স্ট্যাচু।          

কাজানের ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=XVl9tv0b91c&t=6s

কাজানের ছবি 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=202

Post a Comment

0 Comments