জ্বলদর্চি

কবিজন্ম / চন্দন ভট্টাচার্য্য

কবিজন্ম
চন্দন ভট্টাচার্য্য

কবিজন্ম-১
                     
লক্ষ নিযুত হাজার কোটি বছর পর সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা পড়লেন দোটানায়। এতো সৃষ্টি... এতো রকমের সৃষ্টির পর সৃষ্টি গুলো সৃষ্টিকর্তার মনে দিলো নাড়া।সত্যিই তো ! সৃষ্টি রহস্য... সৃষ্টির গান গাইবে কে! সকল সৃষ্টির মাঝেই তো একটা করে  গান..সুর..তান..লয় আছে। আর সব গানই তো কবিতা। কবিতা কথা কয়। নীল আকাশ... নীল সাগর তাদেরও তো কথা আছে। কবিতা আছে। ভয়ঙ্কর আগ্নেয়গিরি! সেও তো হুঙ্কার ছাড়ে। অচল পর্বত । তারও কথা আছে। কবিতা আছে। ধূ ধূ মরুভূমিও ফিসফিস করে কথা কয়। অনন্ত কোটি তারা নক্ষত্র উল্কা ধূমকেতু ছায়াপথ কালো গহ্বর গ্রহ উপগ্রহ জানা অজানা প্রাণী উদ্ভিদ ফল ফুল নদ নদী! তাদেরও গান আছে।তান আছে। ছন্দ আছে। এক সুর - এক তান- এক লয়ে তারা দুর্নিবার গতিতে চলমান নিরন্তর। তারা সবাই এক একটি জলজ্যান্ত কবিতা। শুধু দেখার মতো চোখ, শোনার মতো কান আর উপলব্ধি করার মতো হৃদয় চাই। যিনি এই কবিতা দেখতে পান, এই গান শুনতে পান, রহস্য ভেদের চরম আকাঙ্ক্ষা যাঁর আছে.....
তিনিই কবি... তিনিই ঋষিকবি...তিনিই ঈশ্বর ... তিনিই পরমেশ্বরকণা।
এইসব অযুত লক্ষ নিযুত কোটি কবিতা লিপিবদ্ধ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রথমে সৃষ্টি করলেন মাছ। অসংখ্য জলাশয় নদনদী এমনকি মহাসাগরের প্রতিটি কোনায় কোনায় তার অবাধ যাতায়াত। পরখ করে দেখার জন্য সৃষ্টিকর্তা জলের তলে দিলেন টোপ। সুগন্ধি আহার । আর টোপ গিলে মাছ নিজেই হয়ে গেল অত্যাশ্চর্য আহার। সৃষ্টি করলেন ব্যাঙ। কিন্তু তার দুই পা জলে... দুই পা ডাঙায়। দু নৌকায় পা তার। ব্যাঙের পর সৃষ্টি হল সাপ। সর্পিল গতি তার। কণ্ঠে হলাহল। সৃষ্টিকর্তা বিচলিত হয়ে সৃষ্টি করলেন অজগর। নির্বিষ।প্রায় স্থবির। কিন্তু জন্মেই সে শুরু করে দিল অজগরবৃত্তি।নড়ে না। চড়ে না। মুখের সামনে যা পায় তাই গিলে ফেলে। সৃষ্টির গানে তার কান নেই। মন নেই। অতপর পাখি। আকাশে বাতাসে সৃষ্টির কোনায় কোনায় অবাধ বিচরণ তার। কিন্তু বিক্ষিপ্তমনা সে। উড়ুউড়ু মন। তাই সৃষ্টি হল তুরঙ্গ। সৌন্দর্যসুখে বদ্ধ সে। নির্নিমেষ নয়নে ময়ূরের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে সোজা চলে গেল পশুরাজের পেটে। তবে কি মাতঙ্গই হতে পারে জাত কবি। কিন্তু স্পর্শ সুখে বদ্ধ সে। তবে কি পতঙ্গ - ভৃঙ্গ - মধুকর! না না না। তারা শুধু গুনগুন গান গায়। অনেক ভেবে অনেক চিন্তা করে সৃষ্টিকর্তা নিপুণ হাতে সৃষ্টি করলেন মানুষ। মান আর হুঁস দিলেন।আর পঞ্চ ইন্দ্রিয় ষড় রিপূ অষ্টপাশে আবদ্ধ করলেন তাদের। তার সাথে দিলেন জ্ঞান বিবেক বৈরাগ্য। তার সাথে জুড়ে দিলেন মায়া মমতা স্নেহ প্রেম ভক্তি ভালোবাসা হিংসা ঘৃণা দ্বেষ বিদ্বেষ ছলনা আসক্তি পরশ্রীকাতরতা  দম্ভ অহঙ্কার মোহ আত্মজ্ঞান আর আত্মজ্ঞান লাভের পথ। দস্যু রত্নাকর সব দোষে দূষ্ট । পাপের ভার তার নিলনা কেউ। তাই তিনি মুক্তি পেতে চাইলেন। বাহ্যজ্ঞানহীন। অযুত হাজার বছর ধরে তিনি মুক্তি চাইলেন মুক্তি। চাইলেন আত্মজ্ঞান লাভের পথ।অবশেষে উঁইঢিবির ভেতরে তিনি দেখা পেলেন তাঁর। দুইহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তাও তাঁর দুটি হাত শক্ত করে ধরলেন। তিনি হলেন জাত কবি। জন্ম হল এক মহাকবির। কবি বাল্মিকী। তারপর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। কদাকার। জটাজুটধারী। তিনিও রিপুমুক্ত হতে চেয়ে সৃষ্টিকর্তার স্মরণাপন্ন হলেন। চাইলেন আত্মজ্ঞান লাভ করতে। সৃষ্টিকর্তা তাঁরও দুটি হাত শক্ত করে ধরলেন। বললেন সোহহম...সোহহম। সৃষ্টি হল জয়া সংহিতা.... মহাভারত। হোমার অন্ধ ছিলেন। সৃষ্টিকর্তার কোন সৃষ্টিই প্রত্যক্ষ করেননি তিনি। তবু আকুতি ছিল। ছিল পরা ভক্তি। পরাভক্তি পরিনত হল নিগুঢ় প্রেমে। গভীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। তিনিও তাঁর দুইহাত শক্তকরে ধরলেন। সৃষ্টি হল ইলিয়াড ---- ওডিসি। জাতকবি হয়ে গেলেন তিনি। আরো অনেকেই আধো ভক্তি আধো প্রেম আধো মায়ায় পেতে চাইলেন তাঁকে। তিনি তাদের একটি হাত ধরলেন। শুধু একটি মাত্র হাত।তারাও হলেন কবি । কেউ কেউ রিপুর তাড়নায় মায়াবদ্ধ হয়ে কবি হতে চাইলেন। জাগতিক ভাবনাই সম্বল তাদের। অন্নপ্রাণ। ইন্দ্রিয়বদ্ধ। সৃষ্টিকর্তার ধার ধারেন না। আত্মসর্বস্য। অহঙ্কারী।দাম্ভিক। অর্থলোলুপ। ভোগী। অবিরাম কলম চালান তারা। বকধার্মিক। ঝোপের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ভাবেন আমায় কেও দেখতেই পায়নি। তারাও তো কবি ! তাদেরও তো কথা আছে!!  কবিতা আছে!!!আদিরসে সিক্ত হয়ে তাদের কলম থেকে অবিরাম ঝরে পড়ে দরবারি সঙ্গীত!!!!! আজকাল আদিরসে সিক্ত বানিজ্যিক কবিতারই সমাদর বেশী। বোকাবাক্সের নীচে বসে আবালবৃদ্ধবনিতা সেইসব কবিদের কাব্যগাথার চর্বিতচর্বন করেন। চুঁয়া ঢেকুর তোলেন। চড়কের গাছে হাঁড়ি ঝুলিয়ে গাছের নিচে কাঁচা কাঠে আগুন দিয়ে ফোপরা বাঁশের চোঙায় ফুঁ দেন।আর সমাজকে উচ্ছন্নে পাঠিয়ে সেইসব উচ্ছন্নমার্কা উন্নাসিক অসংযমী সুরা নারী সিংহাসনের পূজারী কবিরা উচ্ছিষ্টভোগী হয়ে অনায়াসেই রাজ অনুগ্রহে বড়ো ইয়া বড়ো তকমা... পেল্লাই মাপের খেতাব বগলদাবায় করে সৃষ্টিকর্তা সহ কবি ও কবিতার গুষ্টির ষষ্ঠীপূজা করেন আর নিজেদের ভাবেন জগদীশ্বর । রূপালী পর্দায় ঝলমলে সিংহাসনে বসে থাকতে দেখে আমরাও তাদের অনুগ্রহ পাবার আশায় হাপিত্যেশ করি। নিজ নিজ সন্তানদের তাদের কাছে পাঠাই। সন্তানরাও তাদের আদর্শ মনে করে। হাজারো সেলাম ঠুকে শিল্পকে...শিল্পিসত্বাকে শাওড়া গাছে তুলে দিয়ে ধাঙড় নাচ ও বাঁশবাজির খেলা দেখায়। দূর থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠেন বাল্মিকী..ব্যাসদেব.. হোমার..রবি ঠাকুর.. শেক্সপিয়ার..শেলী..কীটস..ওয়ার্ডসওয়াথ..তলস্তয় গেটে গোর্কি চেখভ। প্রমাদ গুনে  কত্থক..ভারতনাট্যম.. মোহিনী আট্টম ..কথাকলি। কাঁদতে কাঁদতে জীবনানন্দ বলে ওঠেন, " আর তো আসবোনা আমি ধানসিঁড়িটির তীরে। " অশ্রুসিক্ত নয়নে ওয়ার্ডসওয়ার্থ কাতরোক্তি করেন , " আই ডু নট লিশন মোসেনলেশ অ্যান্ড স্টিল.....অ্যাজ আই ডু নট মাউন্টেড আপ দ্যা হিল....দ্যা মিউজিক ইন মাই হার্ট আই ডু নট বোর.... নো নেভার ইট ওয়াজ হার্ড নো মোর।" তবু আশার কথা এই.... এতো বিপর্যয়ের মাঝে কঙ্কালসার পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে কোনো এক কবি কি যেন নাম তাঁর! হ্যাঁ মনে পড়েছে... মনে পড়েছে । জন কীটস। কবি জন কীটস এখনো বলে চলেছেন, " দ্যা পোয়েট্রি অব দ্যা আর্থ শ্যাল নেভার ডাই।"


কবি জন্ম-২

এক আকাশ কবিতা লেখার আশায় ধরাধামে এসে কবি দেখলেন আকাশটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরা। ঠিক চ্যাঙারীর মতো।একটা রন্ধ্রের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা ছায়াপথ। আকাশগঙ্গা নাম তার। একটা সূর্য তার মাঝের অনন্ত কালো গহ্বরের চারদিকে ঘুরে চলেছে অহর্নিশ। তারপর আবার একটা। তারপর আবার একটা। এমনি করে অযুত লক্ষ নিযুত কোটি ছায়াপথ.... কালো গহ্বর ... সূর্যের মতো... এমনকি অযুতগুন সূর্যের মতো গনণাতীত অগ্নিগোলকের নিরন্তর ঘুর্ণন। তাদেরকে কেন্দ্র করে এক একটি নক্ষত্রলোক। নক্ষত্রলোকগুলোর মধ্যে অযুত  হাজার পৃথিবী। অযুত হাজার পৃথিবীর মাঝে নিযুত কোটি প্রাণ দেখে সম্বিত হারালেন কবি। ভুলে গেলেন পার্থিব চাহিদা ... লৌকিক পিতৃমাতৃপরিচয়। দিব্যজ্ঞানে দিব্যচোখে দেখলেন এক মুরলীবাদক। অযুত ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রক । পরমেশ্বর নাম তাঁর। আসমানে ত্রিভঙ্গাসনে  নিরুদ্বিগ্নভাবে মূরলী বাজান তিনি।আর মুরলীর ধ্বনীতে ধ্বনীতে নিরন্তর সৃষ্টি হয় অযুত লক্ষ নিযুত কোটি পিতা পুত্র মাতা পিতামহ প্রপিতামহ প্রপিতামহের প্রপিতামহরা সব। এক লহমায় মিলেমিশে একাকার তাঁরা।আতসকাঁচে পৃথক করা দায়। প্রত্যেকেই যেন এক একটি জলজ্যান্ত পরমেশ্বরকণা। সেই মুহূর্তে....ঠিক সেই মুহূর্তেই নির্বিকল্প কবি। বাধাহীন বন্ধনহীন। ধার্মিক। অধর্মকে জয় করে ধর্মকে বর্ম করেছেন তিনি। এক দেহেই তিনি হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খ্রীষ্টান ইশাহী। অর্থের কাঙাল নন তিনি। অর্থ অর্থহীন আজ তাঁর কাছে। নিস্পৃহকাম। কামকামনার নাকে কানে দড়ি বেঁধে অযুত হাজারবার নাকখৎ খাওয়ান। এভাবেই রিপুজেয় ইন্দ্রিয়জিৎ   পরমেশ্বরের সাধক কবি মোক্ষলাভ করেন। মানুষের কথা লেখেন। প্রকৃতির জয়গান গান। এমনকি তাঁর কলমের আঁচড় থেকে ঈতর শ্রেণীর প্রানীদের কথাও বাদ যায়না কখনো।পায়েস খাওয়ার বাসনা থাকেনা তাঁর। বায়ুভূক তিনি। অজান্তেই কখন সহসা পায়েসের বাটি নিয়ে মুখের সামনে ধরেন মাতৃসমা সুজাতা। কবি পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে পায়েস করেন পান। পায়েস পান করে দৈহিক শক্তি ফিরে পান কবি। দেহের পশরা সাজিয়ে কবির কাম হরণ করতে আসেন পিঙ্গলা। জীবদেহ সংরক্ষণের এহেন প্রয়াস দেখে কবি সেই বারাঙ্গনাকে করেন প্রণাম। অগনিত গুরুদের মাঝে স্থান দেন তাকে। কবি কখনো বা নচিকেতা হয়ে স্ব-শরীরে যমলোকে যান।ছলনার বেড়াজালে যমকে আবদ্ধ করে আবার ফিরে আসেন জীবলোকে। কখনোবা রনাঙ্গনে যান কবি। পরমেশ্বর, ঈশ্বরকে পাঠান কবির রথের সারথি করে। কখনো বা কবি মেঘনাদ। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধে মাতেন তিনি। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে অধর্মের কাছে পরাজিত হন। কখনো বা কবি মা সারদা। জন্মগত যোগিনী। সৎ অসৎ সকলেরই মা তিনি। আবার সহসা সত্যদ্রষ্টা আত্মজ্ঞানী কবি রাজরোষে হাসতে হাসতে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হয়ে যান। হাসতে হাসতে মাথায় পরেন কাঁটার মুকুট। কখনো বা কবি বোকা কালিদাস। গাছের আগায় বসে গোড়া কাটেন। কিন্তু কখনোই গাছ থেকে পড়ে যাননি। কারণ একহাতে গাছের উপরের ডাল ধরে অন্য হাতে নিচের ডাল কেটে ফেলে অনায়াসেই উপরের ডালে উঠে যেতেন। ফুলশয্যার রাতে প্রবেশ পথ না পেয়ে মশারীর উপরেই লাফ দেন তিনি। রাজপরিবারে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধে। রাজকন্যা মুহূর্মুহূ অচৈতন্য হয়ে পড়েন। পতঙ্গের লম্বভাবে উড়বার শক্তি নেই এই সত্য স্বীকার করেনি কেও। শুধু বোকা কলিদাসই নাম রয়ে যায় তাঁর। অলক্ষ্যে মুচকি হাসে পাহাড়ের দেওয়ালে খোদাই করা অভিজ্ঞান শকুন্তলম... মেঘদূতম...রঘু বংশম... কুমার সম্ভবম। কখনো বা রজোঃগুনে সিক্ত হয়ে কবি হয়ে যান সেকেন্দার আলেকজান্ডার। বিশ্ববিজয় করতে গিয়ে মাঝপথেই দেহত্যাগ করতে হয় তাঁকে। ভোগলিপ্সা দূর্ভোগে পরিণত হয় তাঁর। আর চেঙ্গিস খানের কথা কেই বা না জানে। লক্ষ নিযুত যুদ্ধবন্দীদের খেতে দেবার ভয়ে নির্বিচারে হত্যা করেন তাদের। তারপর... তারপর... তারপর ! তাঁর যে কি হল কে তার খবর রাখে। আর তৈলঙ্গ কবি ! অদ্ভুত ভাব তাঁর। নিরাভরণ। হাসতে হাসতে গঙ্গার উপর হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার জল খোঁজেন। কখনো বা খ্যাপা বামা। ভাবের ঘোরে নিজ বিষ্ঠা নিজেও খান আর জগন্মাতাকেও খাওয়ান।  পাপিষ্ঠ নরাধম দস্যু রত্নাকরও 'মরা' 'মরা' বলে অনন্ত জপ করতে করতে অলক্ষ্যে 'রাম রাম' বলে থাকেন।আসলে মোক্ষলাভ হলে কবিরাও সত্যদ্রষ্টা আত্মজ্ঞানী  হয়ে যান। মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আমার আমার করেননা কখনো। অখাদ্য কুখাদ্য খান না। বলেন না অকথা কুকথা।  বহিরাঙ্গের চাকচিক্য ভুলে অন্তরঙ্গ সাফাই করে হয়ে যান নির্বিকল্প সত্যদ্রষ্টা সুভাষি সুভাষিনী নিরহঙ্কার আত্মজ্ঞানী। আসলে কবি কবিই। মোক্ষ তার গলার হার। কবিত্ব তার রাজমুকুট।  কবির কবিত্ব চলে গেলে পড়ে থাকে শুধু মায়া। আর মায়ায় আবদ্ধ হয়ে কবি রচনা করেন বাৎসায়নী কাব্য দরবারি সঙ্গীত। আদিরসে সিক্ত হয়ে অকুল পাথারে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকেন তিনি।


কবি কথা

প্রকৃত কবিরা আপন খেয়ালে নিরন্তর করে চলেন সাধনা, করেন সৃষ্টি। হতে পারে তাঁদের সৃষ্টি অনেক মানুষের মন কাড়ে। দেশবিদেশের বহু মানুষ হতে পারেন তাঁদের গুনমুগ্ধ। আত্মার আত্মীয়ের চেয়েও পরমাত্মীয়। তাঁরা কবিকে নিয়ে ভাবেন। স্বভাবসুলভ কবি কখনোই ভাববেন না অর্থ ধন সম্পদ প্রতিপত্তির কথা। কিন্তু কেউ কেউ ভাবেন। অপথে বিপথে অন্ধকারে হাঁতড়ে হাঁতড়ে যারা অঢেল সম্পত্তি করেছেন তারা ভাবেন ভাটভিখারী কবিদের এত কদর কেন। কাব্য কবিতা আবার কি! খায় না মাথায় মাখে? তাই তারা ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে। কখনো কখনো যাকে সামনে পায় ছারপোকার মতো কুটুস কুটুস কামড়াতে থাকে। কবির পরিবার পরিজনদের কানে কামড়ায়। তাদের মনকে কখনো ক্ষিপ্ত, কখনো বিক্ষিপ্ত , আবার কখনো কখনো মুঢ় করে তোলে । একাগ্র মনা কখনোই হতে দেয় না। সেটা হয়ে গেলে তো তাদের জয়ঢাক বাজাবার কেউই থাকবে না। তাদের অর্থের , সম্পদের দাসত্ব করবে না কেউ। আর কবিকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অতি সুকৌশলে তারা পরিবার পরিজনদের মধ্যে ধন সম্পদ প্রতিপত্তির গরুত্বের বিষ দেবে ঢেলে। বাড়িয়ে দেবে চাহিদা। ধীরে ধীরে কবি তাঁর নিজের পরিবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তাঁদের মানবসম্পদ, তাঁদের সৃজনশীলতাকে পরিবার পরিজনদের দিয়ে পদদলিত করিয়ে তাঁরা পৈশাচিক আনন্দে ওঠে মেতে। আর কবিদের পরিবার পরিজনরাও সোনার হরিণ লাভের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভুলে যায় কবির আদর্শ  সৃষ্টি ত্যাগ তিতিক্ষা ভালোবাসা। কবি তবু বিচলিত নয় তাতে। ফেলেনা বিন্দুমাত্র চোখের জল। আপন মনে ভাবে নিরাকার ব্রহ্ম বলে আছে কিছু কি এই জগতে? নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা করে একটি একটি করে সৃষ্টি করার কি কোনো মূল্যই নেই এই বিশ্বসংসারে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে শুধু নাম আর রূপ। এই নাম আর রূপ নিয়েই তো আমাদের মায়ায় ভরা জগত। কবি ভাবলো নাম আর রূপকে অস্বীকার করে নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা কি তাহলে বিফলে গেলো? মায়া কি তাকেও করে ফেলল গ্রাস!!!!! নাকি গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে সেও বলবে ব্রহ্মও সত্য, জগৎ ও সত্য। ধন সম্পদ অর্থ প্রতিপত্তিও চাই .... আবার কবি সাহিত্যিকও হতে চাই। রাজার ভজনাও চাই আবার কবিরত্ন - কবিশ্রেষ্ঠও হতে চাই। জাগতিক জগতের হালফিল গুনগুন তো এটাই। এই দ্বিবিধ দ্বন্দের দোলাচলে পড়ে কবি হাসে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠে । আর সবার অলক্ষ্যে ব্রহ্ম বানী শোনা " সোহহম.... সোহহম... সোহহম।


আমি ও ঈশ্বর
               
প্রার্থনা করার সময় আমি ভাবলাম
ঈশ্বর বোধহয় সবই দেখছেন....
কিন্তু কাউকে নিন্দা করার সময় সেটা ভুলে গেলাম।
পূণ্য সঞ্চয়ের সময় ভাবলাম
হয়তো এটাও ঈশ্বরের নজরে আছে....
কিন্তু পাপ করার সময় আমার ঈশ্বর ভাবনা. গেল উবে ।
দান করার সময় ভাবলাম
ঈশ্বর নিশ্চই আমার প্রসংশায় পঞ্চমুখ.....
কিন্তু জনগনের টাকা চুরি করার সময় ঈশ্বরের কথা মনেই পড়ল না।
যখন আমি সেবামূলক কাজে ব্যস্ত ছিলাম
তখন ভাবলাম ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান.....
কিন্তু কাউকে আঘাত করার সময় বেমালুম ভুলে গেলাম ঈশ্বরের কথা।
নারীশক্তির আরাধনার সময় ভাবলাম
 ঈশ্বর আমার খুবই কাছে আছেন......
 কিন্তু নারীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করার সময় মনে হল ঈশ্বর বলে কিছুই নেই।
 জননেতা হবার আগে ভাবতাম ঈশ্বর নিশ্চই আমার সহায় আছেন ...…
 কিন্তু জননেতা হয়ে ক্ষমতার অপব্যাবহার করার সময় মনে হল ঈশ্বর যেন আমার আজ্ঞাবহ দাস।
 ঈশ্বর কিন্তু সব সহ্য করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন ......
 তবুও তিনি নিজের মনকে সবসময় বুঝিয়ে চলেছেন
 আজ নাহয় আগামীকাল সবই ঠিকঠাক হয়ে যাবে.....
 মানুষ আবার মানবিক হবে
 মানুষ আবার সৎ হবে
 পৃথিবী আবার শান্ত হবে।



ভিটের সাপ

যখন পূবের সিঁদুরে সূর্যটা একটু একটু করে পশ্চিমে হেলছিল
ভোরের স্মৃতিগুলো একটু একটু করে হয়ে যাচ্ছিল ম্লান
অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা যাচ্ছিল দুমড়ে মুচড়ে
তখন আমি তোমার স্মরণাপন্ন হলাম
আত্মসমর্পণ করলাম তোমার কাছে
কারণ বিশেষ ভাবে জ্ঞানী তুমি
দরাজ হৃদয়
মৃত্যুপথযাত্রীর একমাত্র সাহারা সেন্ডাই ভাইরাস।
তুমি আমার কাতর আহ্বানে সাড়া দিলে
আদরভরা কণ্ঠে ডেকে পাঠালে আমাকে 
হতাশাগ্রস্ত হৃদয়ে আমি ফিরে পেলাম প্রাণ
মনে জাগলো আশা
কিন্তু ততক্ষণে ভিটের সাপের বিষাক্ত ছোবলে
তুমি অষাড় হতে হতে ক্রমাগত চলে যাচ্ছিলে ভয়ালভয়ঙ্কর কোমায়
বিশেষ জ্ঞান হারিয়ে ক্রমে ক্রমে হয়ে যাচ্ছিলে অজ্ঞান
আমি প্রণাম করতে যাবো
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার সামনে দাঁড়ালে জোড়হাত করে
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তোমাকে দেখলাম
দেখলাম সবুজ সংকেত ক্রমে ক্রমে হয়ে যাচ্ছে গাঢ় লাল
আমার কান্নার স্রোত বাধা মানছিল না
আমি কোনো কথাই বলতে পারিনি
আবার তোমার অজ্ঞানতাকে সমর্থনও করিনি
শুধু মনে মনে তারিফ করেছি
প্রশংসায় হয়েছি পঞ্চমুখ
তোমার প্রতি নয়
পরন্তু আজন্ম লালিত সেই শ্বেতশুভ্র ভিটের সাপটার প্রতি
যে সামান্যতম সুযোগেরও সদ্ব্যবহার করতে ছাড়েনি।


অত্যাধুনিক সভ্যতা

দেখো আমরা কত্তো উন্নত হচ্ছি
দেখো আমরা কত্তো সভ্য হচ্ছি
দেখো আমরা কত্তো সুন্দর হচ্ছি
দেখো আমরা কত্তো আধুনিক হচ্ছি
দেখো দেখো দেখো আমাদের দেখো।
আমরা পৃথিবীর বুক চিরে পৃথিবীকে খন্ড খন্ড করেছি
দিয়েছি সীমারেখা
এপার থেকে ওপারে যাওয়া দন্ডনীয় অপরাধ।
পৃথিবী আমার মা
তবু মায়ের কাছে যাওয়া নিষেধ
তারজন্য ছাড়পত্র চাই।
আমরা আগে সংসার করতাম
করতাম বিবাহ
বিবাহ হল জন্মজন্মান্তরের বন্ধন
তখন আমরা সাতপাকে বাঁধা পড়তাম।
এখন সেসবের বালাই নেই
এখন আমরা চুক্তি বদ্ধ হই
চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমরা নির্দিধায় বহুমাত্রিক যৌনসুখ উপভোগ করি
যেন যৌনতাই জীবনের সারবস্তু।
সদ্যজাত শিশুর খাদ্যভান্ডারে তালা লাগিয়ে 
 আমাদের তাদের খেলার সামগ্রী বানিয়েছি
তাদের নিয়ে আমরা পুতুল খেলা করি
জন্মদ্বার আজ হয়ে গেছে সম্ভোগের সামগ্রী 
আর নারীদেহ যেন এক মৃগয়াক্ষেত্র
যখন খুশি আবরণ উন্মোচন করা যায় 
যখন যেখানে খুশি যাওয়া যায়
আবার ভাড়াও নেওয়া যায়
মৃগয়া ক্ষেত্রগুলোও যেন নিজেদেরকে ভাড়ায় খাটানোর জন্য সদাব্যস্ত থাকে
এভাবেই বিষাক্ত হয়ে যায় পবিত্র মাটি
আর এই অপবিত্র বিষাক্ত মাটিতে অহরহ নানারকমের বীজ বুনে আমরা উৎকৃষ্ট ফসল লাভের আশায় হাপিত্যেশ করে বসে বসে প্রহর গুনি।


কবি কথা-৪

প্রকৃত কবিরা আপন খেয়ালে নিরন্তর করে চলেন সাধনা, করেন সৃষ্টি। হতে পারে তাঁদের সৃষ্টি অনেক মানুষের মন কাড়ে। দেশবিদেশের বহু মানুষ হতে পারেন তাঁদের গুনমুগ্ধ। আত্মার আত্মীয়ের চেয়েও পরমাত্মীয়। তাঁরা কবিকে নিয়ে ভাবেন। স্বভাবসুলভ কবি কখনোই ভাববেন না অর্থ ধন সম্পদ প্রতিপত্তির কথা। কিন্তু কেউ কেউ ভাবেন। অপথে বিপথে অন্ধকারে হাঁতড়ে হাঁতড়ে যারা অঢেল সম্পত্তি করেছেন তারা ভাবেন ভাটভিখারী কবিদের এত কদর কেন। কাব্য কবিতা আবার কি! খায় না মাথায় মাখে? তাই তারা ছিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে। কখনো কখনো যাকে সামনে পায় ছারপোকার মতো কুটুস কুটুস কামড়াতে থাকে। কবির পরিবার পরিজনদের কানে কামড়ায়। তাদের মনকে কখনো ক্ষিপ্ত, কখনো বিক্ষিপ্ত , আবার কখনো কখনো মুঢ় করে তোলে । একাগ্র মনা কখনোই হতে দেয় না। সেটা হয়ে গেলে তো তাদের জয়ঢাক বাজাবার কেউই থাকবে না। তাদের অর্থের , সম্পদের দাসত্ব করবে না কেউ। আর কবিকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য অতি সুকৌশলে তারা পরিবার পরিজনদের মধ্যে ধন সম্পদ প্রতিপত্তির গরুত্বের বিষ দেবে ঢেলে। বাড়িয়ে দেবে চাহিদা। ধীরে ধীরে কবি তাঁর নিজের পরিবারেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তাঁদের মানবসম্পদ, তাঁদের সৃজনশীলতাকে পরিবার পরিজনদের দিয়ে পদদলিত করিয়ে তাঁরা পৈশাচিক আনন্দে ওঠে মেতে। আর কবিদের পরিবার পরিজনরাও সোনার হরিণ লাভের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ভুলে যায় কবির আদর্শ  সৃষ্টি ত্যাগ তিতিক্ষা ভালোবাসা। কবি তবু বিচলিত নয় তাতে। ফেলেনা বিন্দুমাত্র চোখের জল। আপন মনে ভাবে নিরাকার ব্রহ্ম বলে আছে কিছু কি এই জগতে? নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা করে একটি একটি করে সৃষ্টি করার কি কোনো মূল্যই নেই এই বিশ্বসংসারে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে শুধু নাম আর রূপ। এই নাম আর রূপ নিয়েই তো আমাদের মায়ায় ভরা জগত। কবি ভাবলো নাম আর রূপকে অস্বীকার করে নিরাকার ব্রহ্মের সাধনা কি তাহলে বিফলে গেলো? মায়া কি তাকেও করে ফেলল গ্রাস!!!!! নাকি গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে সেও বলবে ব্রহ্মও সত্য, জগৎ ও সত্য। ধন সম্পদ অর্থ প্রতিপত্তিও চাই .... আবার কবি সাহিত্যিকও হতে চাই। রাজার ভজনাও চাই আবার কবিরত্ন - কবিশ্রেষ্ঠও হতে চাই। জাগতিক জগতের হালফিল গুনগুন তো এটাই। এই দ্বিবিধ দ্বন্দের দোলাচলে পড়ে কবি হাসে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠে । আর সবার অলক্ষ্যে ব্রহ্ম বানী শোনা " সোহহম.... সোহহম... সোহহম।

Post a Comment

0 Comments