দূর দেশের লোকগল্প— জর্জিয়া (এশিয়া)
দুই ভাইয়ের ভবিষ্যৎ
চিন্ময় দাশ
দুটি ভাই থাকে একটা কুটিরে। মা নাই বাবা নাই। খাবারও তেমন নাই ঘরে। এখন দশটা করে রুটি বেঁচে আছে দুজনের।
বড়ভাই বলল—এই দশটা রুটি ফুরিয়ে গেলে, পেটে কী দেব? চল ভাই, বাইরে বেরোই। দেখা যাক, ভাগ্যে কী আছে আমাদের।
ভাই বলল—তাই চলো।
ঘর ছেড়ে, বেরিয়ে পথে নেমেছে। কিছু দূর যাওয়ার পর, খিদে লেগেছে বড়র। বড় বলল—আয় ভাই, প্রথমে তোর রুটি খেতে খেতে যাই। পরে, আমার রুটি খাবো ভাগ করে।
ছোট আপত্তি করল না। রুটি খেতে খেতেই চলেছে দুজনে। যেই রুটি খাওয়া শেষ হয়ে গেল, বড় বলল—একই পথে হেঁটে কিছু লাভ নাই, বুঝলি। তারচেয়ে বরং দুজনে দু’পথে হাঁটাই ভালো। তাতে দু’গুণ কিছু সুযোগ পাওয়া যাবে।
ছোট কিছু জবাব দেবার আগেই, বড় সরে পড়ল। পুরো দশটা রুটি কিন্তু তার কাছেই রয়ে গেল।
ছোট চলেছে। চলতে চলতে ঘণ বনের মধ্যে হাজির। সেখানে একটা কাঠের কল। ছোট গিয়ে কলের মালিককে বলল—আজ রাতটুকুর জন্য একটু থাকতে দেবে আমাকে?
মালিক বলল—এখানে থাকবে? রাতের বেলায়? ভয়াণক জায়গা এটা। এমন ভাবনাও রেখো না মাথায়। একটু বাদেই রাত নেমে আসবে। যত হিংস্র জন্তু-জানোয়ার এসে হাজির হয়ে যাবে এখানে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তোমাকে। আমি নিজেই এবার কেটে পড়ছি। ঘরে ফিরতে হবে আমাকে।
--ওসব জন্তু জানোয়ারের ভয় আমি করি না। তুমি খালি একটু অনুমতি দাও।
--যা ভালো বোঝ, করো। আমাকে কিন্তু দোষ দিও না। বলেই বাড়ি চলে গেল মালিক।
কলের ভিতরে ঢুকে পড়ল ছোট। খুঁজে খুঁজে একটা কোণে সেঁধিয়ে, ঘাপটি মেরে বসে রইল।
রাত নেমে এল একটু বাদেই। তখন সত্যিই কার যেন পায়ের শব্দ। একটা ভালুক এসে ঢুকল কলটার ভিতর। তার পিছন পিছন একটা নেকড়ে আর একটা শেয়ালও। ছেলেটা ভয়ে ঘাপটি মেরে বসে রইল।
কতক্ষণ গল্পগাছা চলল তাদের। সারা দিনে কে কী শিকার করেছে, পেট ভরেছে কি না—এই সব।
তখন প্রায় মাঝরাত্তির। ভালুক বলল—এসো আমরা গল্প বলি। প্রত্যেই আমরা নিজের নিজের জীবনের গল্প বলব।
বাকি দু’জন বলল—মানে? কিছু বুঝলাম না।
ভালুক বলল—আমরা নিজের চোখে যা দেখেছি, বা যা শুনেছি নিজের কানে—তেমনি কোন গল্প।
তারা বলল—ঠিক আছে, বলব। তা ভাই, তুমি শুরু করো।
--ঠিক আছে, আমিই প্রথমে বলছি। ভালুক বলল—আমি একটা ইঁদুরের কথা জানি। সামনের পাহাড়ের তলায় একটা গর্তে থাকে। এক কাঁড়ি লোরি (জর্জিয়ার টাকা) আছে সে ইঁদুরের। এখন তো গরমের দিন। প্রতিদিন লোরিগুলো গর্ত থেকে বের করে। রোদে মেলে শুকোতে দেয়।
বাকি দুজন বলল—লরির গল্প শুনে আমাদের আর কী ভাই, ও দিয়ে আমাদের কী হবে?
ভালুক বলল—আমাদের কথা বলছি না,ভাই। এমনকি, ইঁদুরের নিজেরও কোন কাজে লাগবে ওগুলো। কিন্তু কোন অভাবি লোক যদি জানতো এ সংবাদ, তার কিন্তু ভারি উপকার হোত।
--এ আর এমন কী বড় কথা হোল? নেকড়ে বলল—আমি একটা শহরের কথা জানি। সেখানে জলের বড্ড আকাল। এক চুমুক জলও বহু দূর থেকে বয়ে আনতে হয়। সেজন্য সেখানে ভারি চড়া দাম জলের।
বাকি দু’জন বলল—তাতে কী হোল?
--সেই শহরের ঠিক বাইরে, একটা জায়গায় একটা পাথর পড়ে আছে। সেটাকে যদি কেউ সরিয়ে দিতে পারে, নীচে অগাধ জলের ভাণ্ডার। তখন জল বেচেই, বড়লোক হয়ে যাওয়া যাবে।
শেয়াল বলল— তাহলে, আমি আরও বড় খবর বলতে পারি। আমি এক রাজাকে জানি একটি মাত্র মেয়ে রাজার। কিন্তু হলে কী হবে? বছরের পর বছর বিছানায় পড়ে আছে মেয়েটা। দুটো পা-ই পঙ্গু বেচারীর।
--পঙ্গু মেয়ের খবর আর এমন কী বড় হোল?
শেয়াল বলল—বড় হে, খুবই বড়। কেন জানো? ঐ রোগ সারানোর উপায়টাও যে আমি জানি। আমাদের এই দেশে তো আর বীচগাছের অভাব নাই। ইয়াব্বড় সব গাছ এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। তার পাতা ভেজানো জলে তিন দিন স্নান করাতে হবে মেয়েটাকে। তাহলেই সুস্থ্য হয়ে যাবে সে। একেবারেই সুস্থ্য। কেউ যদি এ খবর জানতো, মেয়েটা সেরে উঠত। বলা যায় না, লোকটাও হয়তো রাজার জামাই হয়ে যেত।
গল্প করতে করতে ভোর হয়ে এলো। তিন জনে বেরিয়ে গেল কলঘর থেকে।
ছেলেটাও বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। সব শুনেছে সে বসে বসে। কিন্তু বিশ্বাসও হচ্ছে না। তবুও একবারটি যাচাই করে দেখা যাক। সোজা পাহাড়ের তলায় এসে হাজির হোল। এবার শুরু হোল তার ইঁদুরের গর্ত খোঁজা। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর, পেয়েও গেল জায়গাটা। সত্যিই একটা ইঁদুর বসে আছে রোদে। সামনে অনেক অনেক লোরি মেলে দেওয়া। রোদে লোরি শুকাচ্ছে। বসে বসে পাহারা দিচ্ছে ইঁদুর।
অবাক হয়ে গেল ছেলেটা। তাহলে, রাতের বেলা যা কিছু শুনেছে, সেসব তো গল্প নয়। একেবারে সত্যি কথা।
কাছেই শুকনো একটা ডাল পড়ে ছিল। এক ঘা বসাতেই ইঁদুর বাবাজী অক্কা পেয়ে গেল। ছেলেটাকে তখন পায় কে? লোরি কুড়োতে কুড়োতে দুটো পকেটই ভরে গেল তার জোব্বার।
এবার নেকড়ের বিবরণ মত, শহরের দিকে হাঁটতে লাগল। সেখানে প্রথমে ঢুকল একটা খাবার দোকানে। ভর পেট খেয়ে, পাথর খুঁজতে শুরু করল। খুঁজতে খুঁজতে বিকেল গড়িয়ে গেল। পথের পাশে পাথর পড়ে আছে, এমনটা চোখেই পড়ে না। সন্ধ্যা নামে নামে, এমন সময় দেখা গেল জায়গাটা।
অনেক রকমের ভাবনা ভীড় করে এল মাথায়। কী হতে পারে, কী না হতে পারে-- এমনই সব চিন্তা ঘুরছে ছোটর মাথায়। হাতটাও ছোঁয়াল না পাথরে। ফিরতি রাস্তা ধরে, রাত কাটাবার জন্য, একটা সরাইখানায় গিয়ে ঢুকল।
রাতের খাওয়ার সময় মালিককে ডেকে বলল—দুটো কর্মচারী লাগবে আমার। তবে দুজনেই বোবা আর কালা হওয়া চাই। পাওয়া যাবে?
--লোরি ফেলো। আকাশের হুরি-পরিও জোগাড় করে দেব।
শুনে তো ছোটর আনন্দ ধরে না। পকেট থকে কয়েকটা লোরি লোকটার হাতে গুঁজে দিল—এটা তোমার আগাম বকশিস।
--কাল সকালেই লোক পেয়ে যাবে। আনন্দে লাফাতে লাফতে চলে গেল মালিক।
পরদিন দুজন কাজের লোক নিয়ে পাথরটার কাছে হাজির হয়ে গেল ছোট। কাঠ-কুটো জুটিয়ে বেশ একটা ঘরের মতো বানিয়ে ফেলল আগে। যাতে বাইরের লোকের কিছু চোখে না পড়ে। তারপর তিনজনে মিলে পাথরটা সরাতেই, নীচে একটা কূয়ো। আহা, কী টলটলে স্বচ্ছ নীল জল তাতে।
পরদিন সকাল হতে লোকের চোখে পড়ল, একটা নতুন দোকান গজিয়ে উঠেছে পথের ধারেই। সামনে চার চারটে বড় বড় জালা সাজানো। জালাগুলো জল্ভর্তি। জল বিক্রি হচ্ছে সে দোকানে। যতটা জল নেবে, দামও দিতে হবে ততটা।
দুটো লোক জল তুলে দিচ্ছে। আর মুঠো মুঠো লোরি তুলে রাখছে ছোট ছেলেটা। সারা শহর জেনে গেল খবরটা। এখন আর দূর থেকে জল বয়ে আনবার কষ্ট নাই। হাত পাতলেই জল। ভীড়ে ভীড়াক্কার দোকানের সামনে।
ক,দিন না যেতেই ভিস্তিওয়ালারাও আসতে লাগল, এখান থেকে জল কিনে, বাড়ি বাড়ি ফেরি করতে লাগল তারা। ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল জনের ব্যবসা।।
হাতে যখন অনেক লোরি জমে গেল, নগরপালের কাছে গিয়ে হাজির হোল ছেলেটা। বলল—নগরীর লোককে জলপান করানো আপনার দায়। আমার দোকানটা আপনি নিয়ে নিন।
শুনে তার তো আনন্দ ধরে না। বলল—এর জন্য কত দাম দিতে হবে তোমাকে?
দু’ভাইয়ের মধ্যে এই ছোট ছেলেটা স্বভাবে যেমন সরল, তেমনি দয়ালু। হাতে অনেক লোরি জমে গেছে। আর দরকার নাই তার। সে জবাব দিল—লোরি আমিও নেব না। আপনিও নেবেন না। আমি জলের হক ছেড়ে দিচ্ছি। মানুষকে বিনামূল্যে জল দেবেন আপনি। তবে, দুটো কর্মী আছে আমার। তাদের মজুরীটা আপনি দিয়ে যাবেন।
শেয়ালের গল্প মতো, এবার ছেলেটা চলল রাজবাড়ির দিকে। সেখানে পৌঁছে, দেউড়ির সেপাইকে বলল—তাঁর মেয়ের চিকিৎসা করতে এসেছি আমি। রাজামশাইকে খবর দাও।
রাজার হুকুম পেয়ে, সেপাই এসে ভেতরে নিয়ে গেল ছোটকে। রাজা বললেন—আমার ঘোষণা তুমি জানো?
--জানি রাজামশাই। ছোট বলল—সারিয়ে তুলতে পারলে, আমার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন। না পারলে, গরাদে ভরবেন আমাকে।
রাজা বললেন—সে না হয় হোল। কিন্তু সারাবে কী ভাবে, সেটা শুনি।
ছেলেটা বলল—সেটা আমার কাজ। আমি করে নেব। আপনি বরং শুভকাজের জোগাড়যন্ত্র শুরু করে দিন। তিন দিন সময় লাগবে আমার। তার পরের দিন, নিজের পায়ে হেঁটে হেঁটে বিয়ে করতে আসবে আপনার মেয়ে। তবে, তিনটে জিনিষ লাগবে আমার।
ছেলেটার এমন আস্থা দেখে, রাজামশাইর মনে একটা আশা জেগেছে। বললেন—বলো, কী চাই তোমার?
--এক, অন্দর মহলে আপনার মেয়ের গোশলখানার পাশে একটা ঘর। আমার থাকবার জন্য। দুই, তিনটে বড় জালা। জল রাখবার জন্য। আর তিন, রাজকন্যার তিনজন খাস বাঁদি।
এ আর এমন কী চাহিদা! সাথে সাথেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। জালাগুলোতে জল ভরে ফেলল বাঁদিরা। বীচগাছের পাতা সাথেই এনেছিল ছেলেটা। জালায় ভিজিয়ে দেওয়া হোল। এক এক দিন এক জালা জলে, রাজকন্যাকে স্নান করাল তিন বাঁদি মিলে।
তিন দিন স্নান করবার পর, নিজের পায়ে হেঁটে বেড়াতে লাগল রাজার মেয়ে। হইহই পড়ে গেল রাজবাড়িতে। রাজাও কথা রাখলেন। মেয়ের বিয়ে দিলেন ছেলেটার সাথে।
ভারি ধুমধাম করে বিয়ে হোল দুজনের। রাজধানি শুদ্ধ লোক সাত দিন ধরে ভোজ খেল রাজবাড়িতে।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। ভালোও লাগতো সবার। কিন্তু হোল না। কেন হোল না, সেটা বলা যাক এবার।
হাজার হাজার লোক এসেছিল সাত দিনের সেই ভোজ সভায়। ছেলেটার বড়ভাইও ছিল ভীড়ের ভিতরে। সে ঠিক চিনতে পেরেছে তার ভাইকে। সে তো দারুণ অবাক। কী করে হোল এমনটা? মুখে দেবার একটা রুটিও ছিল তার কাছে। সে কি না আজ রাজার জামাই?
সে ভাইকে ধরে পড়ল—সত্যি করে বল আমাকে, তোর এত উন্নতি হোল কী করে? একসাথে বেরিয়েছিলাম। দিনের রুটিটাও জুটছে না আমার। আর, তুই কিনা একেবারে রাজার জামাই?
ছোটর মনে পড়ল—তার রুটির ভাগ খেয়ে, নিজেরটা নিয়ে সরে পড়েছিল বড়ভাই। কিন্তু অন্তরে ভারি সরল ছেলেটা। মুখে কিছু তো বললই না। উলটে কাঠকলের পুরো ঘটনাটা বলে গেল দাদাকে।
লাফিয়ে উঠল বড়—আজকেই আমিও যাচ্ছি ওখানে। আমাকেও বড়লোক হতে হবে।
ছোট বলল—খবরদার, দাদা। অমন কাজটি কোর না। ভারি বিপদে পড়বে তুমি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খুঁজে খুঁজে ঠিক কলে গিয়ে হাজির হয়ে গেল। মালিক চলে গেলে, সেঁধিয়ে গেল ভিতরে।
একটু রাত হয়েছে। ভালুক, নেকড়ে আর শেয়াল—তিনজন এসে হাজির। গল্প গুজব হচ্ছে। লুকিয়ে কান পেতে আছে বড়ছেলেটা। কখন নিজের কানে তিনটা বিষয়ের কথা শোনা যায়।
ভালুক বলল— জানো বন্ধুরা, ইঁদুরের লোরিগুলো সব লুঠ হয়ে গিয়েছে। ইঁদুরটাকেও মেরে রেখে গেছে কেউ। নেকড়ে বলল—ঠিক বলেছ তুমি। পাথর সরিয়ে জলও বের করা হয়ে গেছে। এখন সকলের ঘরে ঘরে জল। কাউকে দূরের পথ ভাঙতে হচ্ছে না আর। শেয়ালের তর সয় না। সে বলল—রাজার মেয়েও সুস্থ হয়ে গিয়েছে। বিয়েও হয়ে গেছে তার।
ভালুক বলল—কিন্তু এমনটা হোল কী করে? নেকড়ে বলল—আমার তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। শেয়াল বলল—এতে না বুঝবার আছেটা কী? আমরা তো আর কাউকে ডেকে বলতে যাইনি। কেউ নিশ্চয় আড়ালে লুকিয়ে শুনেছিল আমাদের কথাবার্তা। তারই ফল এটা।
নেকড়ে লাফিয়ে উঠল—তাহলে, আজও তো কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে ভেতরে। চলো তো দেখি হতভাগাকে।
তার পর? তার পর আর কী? যা হয়ার তাই হোল। তিনজন কলঘরের ভিতরে ঢুকল। পেয়েও গেল একজনকে। ছিঁড়ে টুকরো তুকরো করে ফেলল ছেলেটাকে।
উপযুক্ত সাজাই হয়েছে দুষ্টু আর লোভী ছেলেটার।
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments