জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /ষোড়শ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
ষোড়শ  পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

             
সেখানে যেয়ে তিনি কদম্ব গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ নয়নে গোপ কুমারীদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং তাদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য তিনি গোপবালকদের সাথে উচ্চকণ্ঠে কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু তাদের এই সশব্দ উচ্চকণ্ঠ গোপকুমারীদের যখন দৃষ্টি আকর্ষণ করল না তখন উপায়ান্তর না দেখে শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন যমুনা তীরে গোপকুমারীদের বিচিত্র বসন পড়ে আছে। তিনি সেই বস্ত্রগুলি নিয়ে এসে কদম্ব গাছের শাখা প্রশাখায় বস্ত্রগুলি সুবিন্যস্ত ভাবে রেখে বসে রইলেন। হঠাৎ যমুনা তীরে দৃষ্টিপাত করে গোপকুমারীগন কদম্বগাছে শ্রীকৃষ্ণকে দেখে এতই আত্মহারা হলেন যে তারা স্থির করতে পারলেন না কিভাবে কদম্ব গাছের দিকে যেয়ে তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেম নিবেদন করবেন, কারণ তাদের বস্ত্রগুলি তো যমুনা তীরে রেখে এসেছেন। সলজ্জ পীড়াবশতঃ তারা সংকোচে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন "হে শ্যামসুন্দর, তোমার কদম্ব গাছের শাখায় শাখায় আমাদের পরিধেয় বস্ত্রগুলি তুমি রেখে দিয়েছো। আমাদের বস্ত্রগুলি যমুনা তীরে রেখে দিলে আমরা জল থেকে উঠে বসন পরিধান করে আপন আপন গৃহে চলে যাই"। এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ বললেন "গোপকুমারীগণ, বসনগুলি যদি তোমাদেরই হয় তাহলে জল থেকে উঠে এখানে এসে বসন পরিধান করে আপন আপন গৃহে চলে যাও"। শ্রীকৃষ্ণের এই কথা শুনে গোপকুমারীরা ভাবলেন তাদের কাত্যায়নী পূজা নিশ্চয় সর্বাংশে সার্থক হয়েছে কারণ যার জন্য আমাদের এই ব্রত পালন তার উপস্থিতি আমাদের কত আনন্দ দান করছে। কিন্তু কৃষ্ণ প্রেমে গোপ কুমারীদের লজ্জা তাদের এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছে যে তারা তাদের চির আকাঙ্ক্ষিত জীবনের ধন শ্রীকৃষ্ণের আদরের ডাক শুনেও তীরে উঠতে পারছেন না। তাদের অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ বললেন "তোমাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তোমরা এখানে এসে তোমাদের বস্তুগুলি নেবে না। তাই আমি এই বস্ত্রগুলি দিয়ে দোলা বানিয়ে তাতে কিছুক্ষণের জন্য নিদ্রা যাই"। কথাগুলি বলে শ্রীকৃষ্ণ যে মুহূর্তে বস্ত্রগুলি খুলতে যাচ্ছেন অমনি গোপকুমারীরা বললেন "আজ আমাদের কাত্যায়নী ব্রত শেষ হয়েছে। ব্রত সমাপন করে জলবাস অবলম্বন করেছি"। এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ কদম্বগাছ থেকে নেমে যমুনা তীরে যাবার উপক্রম করতে গোপকুমারীরা প্রেমস্বভাবসুলভ লজ্জায় অবিভূত হয়ে পড়লেন আর ভাবতে লাগলেন শ্যামসুন্দর যদি অবিবেচকের মত আমাদের কাছে এসে পড়েন তাহলে আমাদের কি বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। তাই তারা ব্যস্ত হয়ে যমুনার শীতল জল থেকে দুহাত উপরে তুলে হাত জোড় করে কাকুতি মিনতি করে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আপন আপন বসন প্রার্থনা করতে লাগলেন। তারা বললেন "হে ব্রজরাজনন্দন আমরা জানি যে এই ব্রজ মধ্যে তুমি সকল দিক থেকে প্রশংসনীয়। আমাদের সঙ্গে এমন কোন রকম নিন্দনীয় কাজ করা তোমার পক্ষে অনুচিত। তুমি আমাদের ধর্ম লজ্জা দিয়ে রক্ষা করে আমাদের বসন ফিরিয়ে দাও"। তাদের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ যখন বসন ফিরিয়ে দিলেন না তখন তারা বললেন "হে ধর্মজ্ঞ, আমরা যদি নগ্ন অবস্থায় কদম্বতলে যাই তাহলে নগ্নস্ত্রীদর্শনে তোমার ধর্মহানি হবে। আর তাছাড়া তুমি যদি এইভাবে আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করো তাহলে আমরা গোপরাজের কাছে যেয়ে তোমার নামে অভিযোগ করব"। শ্রীকৃষ্ণ গোপকুমারীদের কোন কথায় কর্ণপাত না করে তাদের বললেন "হে গোপকুমারীগণ, যদি বস্ত্র গ্রহণের জন্য সত্যিই তোমাদের আগ্রহ থাকে তাহলে তোমরা জল থেকে উঠে হাসতে হাসতে সকলে মিলে তোমাদের প্রতিশ্রুতি মতো উপস্থিত হয়ে নিজেদের বস্ত্র নিয়ে যাও। আর তা না হলে আমি এই বস্ত্রগুলি যমুনার জলে বিসর্জন দিয়ে চলে যাব"। তার কথা শুনে গোপকুমারীগণ ভাবতে লাগলেন যে লজ্জা এবং কৃষ্ণ এ দুটি কাউকেই আমরা পরিত্যাগ করতে পারছি না।
🍂
 আমাদের স্বভাববশত লজ্জার জন্য কৃষ্ণকে পাবারও উপায় নাই। তাই তারা চিন্তা করলেন আমরা অনন্তকাল পর্যন্ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবো আর আমাদের জীবনের জীবন কৃষ্ণকে নয়ন ভরে দর্শন করব। কিন্তু একথা ভেবেও তারা পুনরায় চিন্তা করলেন আমরা যদি গৃহে ফিরে না যাই তাহলে আমাদের পিতা-মাতারা চিন্তা করে নিশ্চয়ই যমুনা তীরে চলে আসবেন এবং আমাদের এই অবস্থা দেখে তাঁরা আর আমাদের ঘরের বাইরে বের হতে দেবেন না। সেক্ষেত্রে আমরা চিরতরে কৃষ্ণ দর্শনে বঞ্চিত হব। তাই তারা তাদের লজ্জা বিসর্জন দিয়ে হাসতে হাসতে কদম্ব তলে শ্রীকৃষ্ণের কাছে এগিয়ে চললেন। তারা যখন কদম্ব গাছের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন তাদের চুলগুলি বুক পর্যন্ত ঢেকে এবং হাতগুলি কোমরের নিচে এমন ভাবে রেখেছেন যাতে তাদের গোপনাঙ্গ না দেখা যায়। গোপকুমারীগন তাদের লজ্জা বিসর্জন দিয়ে ভগবানের কাছে এগিয়ে আসছেন দেখে শ্রীকৃষ্ণ খুবই খুশি হলেন আর তাদের বস্ত্রগুলি তাদেরকে প্রত্যর্পন করে বললেন "যদিও ব্রজদেশের দেশাচার বিবস্ত্র হয়ে স্নান করা আর তোমরা বালিকা বলে তোমাদের পক্ষে দোষজনক নয় তবুও এইভাবে তোমরা ব্রত অনুষ্ঠান করছো। তাই এতে কাত্যায়নী ব্রতের ফলপ্রাপ্তিতে বিঘ্ন ঘটবার সম্ভাবনা আছে। তোমাদের হাতগুলি উর্ধদেশে তুলে আমার কাছে এসে তোমাদের বসনগুলি নিয়ে যাও"। তখন তারা সমস্ত লজ্জা শরমকে বিসর্জন দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে আপন আপন বস্ত্র নিয়ে নিলেন। বস্ত্র নিয়ে দুহাতে বসনাঙ্গ ধরে মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগলেন এবং লজ্জাবদনে কদম্বতলে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাদের বললেন "তোমরা তো তোমাদের বস্ত্র পেয়েছ তাহলে আর কেন এখানে অকারনে দাঁড়িয়ে আছো? তোমরা যে শুধুমাত্র আমারই জন্য নানা কষ্ট সহ্য করে আমাকে পতিরূপে পাবার জন্য আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছ তা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমাদের আন্তরিক বাসনা আমি সর্বতোভাবে অনুমোদন করলাম"। পরম করুণাময় শ্রীকৃষ্ণ গোপকুমারীদের শুদ্ধ প্রেমে প্রসন্ন হয়ে আরও বললেন "তোমরা যেমন আমাকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কষ্ট স্বীকার করেছ আমিও তোমাদের পত্নীরূপে স্বীকার করলাম। আমাদের এমন পরস্পর স্বীকারোক্তি দ্বারাই আমাদের বিবাহ সম্পন্ন হল। তোমরা আর কোন চিন্তা করো না, তোমরা তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। এখন তোমরা তোমাদের ঘরে ফিরে যাও"। সংক্ষেপে এই হল গোপকুমারীদের কাত্যায়নী ব্রত পালন এবং শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক তাদের বস্ত্রহরণের ঘটনা। এখানে উল্লেখ করা সমিচীন হবে যে বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন মা কাত্যায়নী। মা কাত্যায়নীর এক বিরাট মন্দির আছে রঙ্গনাথ মন্দিরের উত্তরে। সেখানে প্রত্যহ পূজো হয় এবং ভোগ নিবেদন করা হয়। নবরাত্রির সময় সেখানে ধুমধাম সহকারে বৈষ্ণব মতে পূজো করা হয়। একথা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।আমরা কদম্বঘাটে নির্নিমেষ নয়নে কদম্ববৃক্ষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালাম। যমুনা তীরে সেই সময় অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্রুত পদব্রজে আমরা এরপরে কেশীঘাটের দিকে রওনা হলাম। 
(পরবর্তী অংশ সপ্তদশ পর্ব)

আরও পড়ুন 
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments