মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৮৮
সত্যেন্দ্রনাথ বসু (বিপ্লবী, মেদিনীপুর)
ভাস্করব্রত পতি
১৮৮২ সালের ৩০ শে জুলাই মেদিনীপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন 'ক্ষুদিরামের গুরু' বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি ছিলেন বিখ্যাত রাজনারায়ণ বসুর ভ্রাতুষ্পুত্র। বাবা ছিলেন অভয়চরণ বসু। মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৯৭ তে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৯৯ তে মেদিনীপুর কলেজ থেকে এফ. এ. পাস করেন। কিন্তু হাঁপানির জন্য বি. এ. পরীক্ষা দিতে পারেন নি। তাঁর কর্মস্থল ছিল মেদিনীপুর কালেক্টরেট। তিনি অস্ত্রগুরু হেমচন্দ্র কানুনগোকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের বাবা ছিলেন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
অরবিন্দ ঘোষের নির্দেশে কলকাতার অনুশীলন সমিতির সতীশ বসু মেদিনীপুরে এসে তাঁকে বক্সিং, লাঠিখেলা ইত্যাদি কসরত শেখান। ১৯০৫ সালে তিনি মেদিনীপুরে গড়ে তোলেন 'ছাত্রভাণ্ডার'। সেখানে ব্যায়ামচর্চার আড়ালে চলত বৈপ্লবিক অনুশীলন। সেসময় হেমচন্দ্র কানুনগো বোমা তৈরি শিখতে বিদেশে চলে গেলে তাঁর ঘাড়ের পড়ে সংগঠনের দায়িত্ব। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাঁর পথপ্রদর্শক ছিল অগ্রজ জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু। রাজনারায়ণ বসুর সক্রিয় সহায়তায় মেদিনীপুরে ১৯০২ সালে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে ওঠে। এই বছরে মেদিনীপুরে সিস্টার নিবেদিতার উপস্থিতিতে গুপ্ত সমিতির উদ্বোধনে তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯০৬ তে মেদিনীপুরে অনুষ্ঠিত কৃষি শিল্প প্রদর্শনীর তিনিই ছিলেন সম্পাদক।
বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু তাঁর সহায়তায় বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত হন। তাঁর নির্দেশে ঐ শিল্প মেলায় ক্ষুদিরাম বসু 'সোনার বাংলা' নামে বৈপ্লবিক ইস্তেহার ছড়াতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তখন ক্ষুদিরামকে ছাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় তিনি সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। যখন ক্ষুদিরাম বসু মজফফরপুরে ধরা পড়ে তখন ফের গ্রেফতার হন অস্ত্র আইনে দুমাস কারাদণ্ড ভোগের পর। এসময় তাঁকে আলিপুর বোমা মামলাতে গ্রেপ্তার করা হয়। সেসময় নরেন গোঁসাইকেও গ্রেপ্তার করা হয় ঐ একই কাজে জড়িত থাকার জন্য। কিন্তু এই নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হলে হেমচন্দ্র এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু জেলে বসেই সিদ্ধান্ত নেন নরেন গোঁসাইকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়া হবে। কোনও গদ্দারের স্থান নেই বাংলায়।
এজন্য জেলের মধ্যেই দুটি রিভলবার আনিয়ে নেন। এ কাজে যুক্ত হন কানাইলাল দত্ত। সত্যেন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হন। এবং বলেন, তিনি বৈপ্লবিক কাজের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত। নরেনের সঙ্গে দেখা করতে চান। ইতিমধ্যে ৩০ শে আগস্ট অসুস্থতার অভিনয় করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কানাইলাল দত্ত। ১ লা সেপ্টেম্বর হাসপাতালে দুজন রক্ষী নিয়ে আসেন নরেন। জামার ভেতর দিয়েই নরেনকে গুলি করেন সত্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর গুলি পায়ে লাগে। পালানোর চেষ্টা করতেই দরজার বাইরে দাঁত মাজার ভান করতে থাকা কানাইলাল দত্ত আহত নরেনের ওপর গুলি চালায়। সেখানেই মৃত্যু হয় নরেন গোঁসাইয়ের।
বিচারকের কাছে কানাইলাল দত্ত বলেন, 'ক্ষুদিরামের ভূত আমাকে রিভলবার দিয়েছে'। যাইহোক, বিচারে দুজনেরই ফাঁসির ঘোষণা হয়। কানাইলালের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কোনও অ্যাপিল হয়নি। তিনি বলেন, 'দেয়ার শ্যাল বি নো অ্যাপিল'। ঐ বছর ১০ ই নভেম্বর তাঁর ফাঁসি হয়ে যায়। কেওড়াতলা শ্মশানে তাঁর চিতাভস্মের ছাই কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সেদিন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ফাঁসি হয় ২১ শে নভেম্বর। ফাঁসির আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন তাঁর বোন সুরবালা দেবী। তবে বিধবা মায়ের জন্য মন খারাপ হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথ বসুর। সেসময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ফাঁসির পরে মৃতদেহ অবশ্য জেলের বাইরে আনতে সাহস পায়নি ব্রিটিশরা। জেলের মধ্যেই চন্দনকাঠ ও ফুল দিয়ে চিতা সাজিয়ে দাহ করা হয় তাঁকে।
🍂
0 Comments