বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
অষ্টাদশ পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল
আমাদের প্রশ্নের উত্তরে মোহান্তজি বললেন "মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর জীবনের মধ্যপর্বে নীলাচল থেকে ব্রজধাম শ্রীবৃন্দাবনে এসেছিলেন। সেবারে শরৎকালে একজন সেবক নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন পাছে দর্শনার্থীদের ভিড়ে আগের বারের মতো এবারেও যাত্রা নষ্ট না হয়ে যায়। তাই তিনি রাজপথ ছেড়ে বনপথ ধরলেন। মহাপ্রভু মথুরায় পৌঁছে বিশ্রামঘাটে বসে বিশ্রাম করার পরে মথুরার সমস্ত তীর্থ দর্শন করলেন। চব্বিশ ঘাটে স্নান করার পরে তিনি বন ভ্রমণে বের হলেন। একে একে দর্শন করলেন মরুবন, তালবণ, কুমুদ বন ও বহুলাবন। এই সময়ে দিব্য ভাবাবেশে আবিষ্ট হয়ে মহাপ্রভু ব্রজ মন্ডলের বহু প্রাচীন লুপ্ততীর্থের পুনরুদ্ধার করেন। শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড দর্শন করে গোবর্ধন শহরে যেয়ে হরিদেবের মন্দির দর্শন করলেন এবং সেখান থেকে তিনি শ্রী মাধবেন্দ্রপুরী প্রতিষ্ঠিত যতিপুরার গোপাল বিগ্রহ দর্শন করেছিলেন। পরে মহাপ্রভু নন্দগ্রাম দর্শন করে গোকুল মহাবনে পৌছালেন। গোকুল মহাবন থেকে তিনি এলেন অক্রুর ঘাটে। অক্রুর ঘাটে অসংখ্য দর্শনার্থীদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে তিনি চীরঘাটে স্নান করে এই ইমলিতলায় এসে বসেছিলেন। এই ইমলিতলাতে তাঁর সাথে বৈষ্ণব কৃষ্ণদাসের মিলন হয়েছিল। মহাপ্রভুর মতে একটি রাসস্থলী।
'বৃন্দাবন লীলামৃত' গ্রন্থে ইমলিতলার মাহাত্ম্য সম্পর্কে বলা হয়েছে 'শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেক ব্রজরমনীর সঙ্গে একইভাবে বিহার করছেন দেখে শ্রীরাধার অভিমান হয়। অভিমানী রাধারানী রাসস্থলী ছেড়ে দূরে যেয়ে লুকিয়ে পড়েন। শ্রীরাধাকে দেখতে না পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে শ্রী রাধাকে খুঁজতে বেরোন। বিরহ ব্যাকুল শ্রী কৃষ্ণের ডাক শুনে শ্রীরাধা আর লুকিয়ে থাকতে পারেননি। অভিমান ভুলে যেয়ে তিনি তাড়াতাড়ি এই ইমলিতলায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে ছুটে এসেছিলেন। আর যমুনাতীরে এই ইমলিতলায় রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়। এই তেঁতুলতলা হলো সেই মিলন স্থান আর এই তেঁতুল বৃক্ষটি হল সেই পূণ্যবৃক্ষ"। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ বলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর বৃন্দাবন আগমনের পূর্বে, নিত্যানন্দ মহাপ্রভু মথুরামন্ডলের শুভ বিজয় করে শ্রীকৃষ্ণ লীলারস আস্বাদন করেন। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু পরবর্তীকালে বৃন্দাবনে শ্রীরাধার ভাব নিয়ে এসে এই ইমলিতলায় উপবেশন করবেন সে কথা নিত্যানন্দ মহাপ্রভু জানতেন। ইমলিতলা বৃক্ষের চতুষ্পার্শের পুরাতন বেদি সংস্কার করে মহাপ্রভুর উপবেশনের উপযোগী করে রেখেছিলেন। বৈষ্ণব শাস্ত্রে এই ইমলিতলা নিয়ে বলা হয়েছে একদিন এই ইমলি বা তেঁতুল বৃক্ষের তলদেশ দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ অভিসারে রাসমন্ডলে দ্রুত গমন করছিলেন শ্রীরাধিকা। সেই মুহূর্তে বৃক্ষ থেকে পতিত পাকা ইমলি শ্রী রাধিকার শ্রীচরণ কমলে দলিত হল। তিনি ভূপতিত হলেন। তাঁর শ্রীচরণের অলক্তরাগ (আলতার রং) বিনষ্ট হলে রাধারানী অত্যন্ত ব্যথিত হন কারণ তার প্রাণকৃষ্ণকে এত সুন্দর আলতার রং তিনি দেখাতে পারলেন না। রাধার মনোব্যাথার কথা জানতে পেরে শ্রীকৃষ্ণও খুব দুঃখ পেলেন। তাঁর অভিশাপে আজও বৃন্দাবনের মধ্যে কোথাও তেঁতুল পাকে না। কিংবদন্তি এই ইমলিবৃক্ষের নিচে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাধা বিরহে কাতর হয়ে শ্রী রাধামন্ত্র জপ ও রাধারূপ ধ্যান করতে করতে অপূর্ব বিপ্রলম্বভাবে শ্রী গৌরাঙ্গ রূপ ধ্যান করেছিলেন। এই ইমলিতলায় শ্রীকৃষ্ণ প্রথম গৌরলীলার সূচনা করেন। তারপরে প্রেমালাপ করতে করতে পুনরায় রাসলীলা আরম্ভ করলেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
রাধাভাবে বিভোর হয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বৃন্দাবনে এসেছিলেন ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের কার্তিক পূর্ণিমায়। মহাপ্রভুর কণ্ঠে শুধু হাহাকার। কৃষ্ণ বিরহে যেন উন্মাদ দশা তাঁর। পথশ্রমে ক্লান্ত মহাপ্রভু ইমলিবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় উপবেশন করলেন এবং যমুনা ও বৃন্দাবনের অপূর্ব শোভা দর্শন করে আনন্দিত হলেন। মোহন্তজীকে আমরা বললাম যে আপনি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সম্বন্ধে আমাদের আরও কিছু জানান। তাতে তিনি বললেন মহাপ্রভুর প্রকটলীলার শেষ বারটি বছর নিগুঢ় মহাভাবের প্রকাশে উজ্জ্বল, অপ্রাকৃত বৃন্দাবনলীলার রসে পূর্ণ - বড় মধুর, বড় করুণ। এই সময়ে মহাপ্রভু মহাভাবে বিভাবিত হয়ে থাকতেন। তাঁর অন্তরতলে নিরন্তর চলত ব্রজের যুগল মিলন আর মাথুর বিরহের জোয়ার-ভাটা। কখনও বিরহবেদনা বিষে জর্জরিত হয়ে তিনি উন্মত্ত, কখনও বা মিলনের আনন্দে অধীর। দিনের পর দিন উদগত হতে থাকে কৃষ্ণ সুধারস। মহাপ্রভুর তখন ঠিক 'রাই-উন্মাদিনী'র দশা। কিন্তু মহাপ্রভু নিজের মর্ম জ্বালার উদঘাটন করে আর অষ্টসাত্ত্বিক বিকারের মধ্যে দিয়ে ওই বিরহ রস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। শুধু কথায় আর কাব্যে নয়, তিনি জীবনের পরতে পরতে ব্রজরস ও কৃষ্ণ বিরহের স্বরূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এ যেন মর্তের ধুলি ধূসর আঙ্গিনায় স্বর্গের অমৃত বিতরণ। প্রাকৃত বৃন্দাবনে কেউ এইভাবে মূর্ত করে তুলেছেন কিনা তাও আমার জানা নাই। রসমধুর ব্রজলীলা মহাপ্রভুর মধ্যেই রূপায়িত হয়েছিল। একদিকে শ্রীকৃষ্ণের অচিন্তনীয় মাধুর্য, আরেকদিকে রাধারানীর সর্বাতিশায়ী প্রেম ও মাধুর্য এবং ওই প্রেমের মাখামাখি মহাপ্রভুর সারা দেহে ও মনে, আর তাঁর অন্তরসত্তায় মহাভাবের চরম উৎকর্ষ প্রত্যক্ষ করে মানুষ সে সময়ে ধন্য হয়েছেন। মহাভাবসিন্ধু মহাপ্রভুর হৃদয় বিদারী আর্তি, কান্না আর প্রেম বিরহের এরকম উদ্বেলতা শুধু তাঁর নিজের কৃষ্ণলীলারস আস্বাদনের জন্য নয়, জনমানসে ঐ রস উৎসারিত করাও তাঁর লক্ষ্য ছিল। মহাপ্রভুর কৃষ্ণ অপ্রাকৃতিক ব্রজলোকের কৃষ্ণ। যিনি সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, তিনি অনাদিরাদি গোবিন্দ সর্ব কারণের কারণ - তিনিই তাঁর কৃষ্ণ, আবার তাঁর রাধাও তেমনি এই কৃষ্ণেরই স্বরূপ-শক্তি-হ্লাদিনী। দুই হয়েও স্বরূপত তাঁরা এক। কবিরাজ কৃষ্ণদাসের ভাষায়। "রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান। দুই বস্তু ভেদ নাই শাস্ত্র পরিমান।। মৃগমদ তার গন্ধ বৈছে অবিচ্ছেদ। অগ্নি জ্বালাতে তৈছে কভু নহে ভেদ।। রাধাকৃষ্ণ ঐছে সদা একই স্বরূপ। লীলারস আস্বাদিতে ধরে দুই রূপ।।"
কৃষ্ণপ্রেমে শ্রীরাধা যেমন আকুল হয়েছিলেন তেমনি মীরাবাঈও আকুল হয়েছিলেন। কৃষ্ণভক্তিতে শ্রীরাধার আত্ম নিবেদনের দৈবিক সব ঘটনা যেন লৌকিক রূপ পেয়েছিল মীরাবাঈয়ের কৃষ্ণপ্রেমে। মেবারের রাণী মীরাবাঈ এসেছেন বৃন্দাবনে। শুনেছিলেন মহাপণ্ডিত শ্রীরূপ গোস্বামীর কথা। এলেন তাঁর কুটিরে। তখন শ্রীরূপ গোস্বামী জপ করছিলেন। খবর দেওয়া হল মেবারের রানী মীরাবাঈ তাঁর দর্শন চান। এক ভক্ত গিয়ে সে কথা বলতে শ্রীরূপ গোস্বামী বললেন "আমি কোন নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি না"। মীরাবাঈ সে কথা শুনে বললেন "প্রভু বৃন্দাবনে তো একজনই পুরুষ এবং তিনি হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ আর সবাই তো প্রকৃতি, তাঁর গোপী। গোস্বামীজী কি নিজেকে পুরুষ বলে ভাবেন?" মুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন শ্রীরূপ গোস্বামী। কুটির থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আজও বৃন্দাবনময় একই পুরুষ বিরাজিত, তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর সকলেই তাঁর ভক্ত। 'মেরে তো গিরিধর গোপাল দুসরো ন কোই'। মীরার মতো কজন এভাবে বলতে পেরেছিলেন? শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণে সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন তিনি। ইহকাল পরকাল সব। এমনকি বিষের পাত্র শ্রীকৃষ্ণের চরনামৃত জ্ঞান করে গ্রহণ করতে ইতস্তত করেননি এই মহান সাধিকা। কিংবদন্তি মীরাকে হত্যা করার জন্য তাঁর স্বামী রানা ভোজরাজ মুখবন্ধ ছোট্ট ঝুড়িতে বিষধর সাপ পাঠিয়েছিলেন। মীরাকে বলা হয়েছিল তাতে শালগ্রাম শিলা আছে। ভগবানের অসীম কৃপায় তিনি ঝুড়ি খুলতেই তার ভেতরে দেখলেন সত্যিই একটি শালগ্রাম ছিল। মীরাবাঈয়ের ভক্তির জোরে বিষধর সাপের শালগ্রাম শিলায় রূপান্তর হয়েছিল। সেই শালগ্রাম শিলা সঙ্গে নিয়ে তিনি বৃন্দাবনে চলে আসেন। এখানে ভজন কুটির বানিয়ে সেখানে সেই শালগ্রাম শিলা স্থাপন করেন। বৃন্দাবনে বহুদিন ছিলেন মীরাবাঈ। তারপরে তিনি মেবারে ফিরে যান। কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমে আত্মমগ্ন হয়ে পুনরায় ঘর ছাড়লেন মীরাবাঈ। সুরের খেয়া বেয়ে সাধিকা চলেছেন চেতনার বৈতরণী পারাপার করতে। কালোর প্রেমে পাগল মীরা। গিরিধারীলালকে বুকে জড়িয়ে রাজপুরী থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন দ্বারকার পথে। কৃষ্ণ সেখানে রণছোড়জী নামে বিখ্যাত। মন্দিরে শুরু হলো মীরার সাধনা। ভক্তিতে ভগবান বাঁধা, ভক্তিতেই তো মুক্তির সন্ধান। সাধিকা মীরার শরীরে কৃষ্ণপ্রেমের পূর্ণ প্রকাশ। মীরা গিরিধারীলালের প্রেমিকা। শোনা যায় জীবনের শেষ দিনগুলি এই দ্বারকা মন্দিরে মীরাবাঈ কাটিয়েছিলেন। জনশ্রুতি শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরে বিগ্রহের সামনে কীর্তন ও নৃত্য করতে করতে গিরিধারীর মূর্তিতে বিলীন হয়ে যান তিনি। তাঁর ওড়নাখানি আজও রয়ে গেছে রণছোড়জীর মুখমণ্ডলে।
পরবর্তী অংশ উনবিংশতি পর্বে
0 Comments