মেদিনীপুরের মানুষ রতন পর্ব -- ৯০
সাতকড়িপতি রায় (স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাড়া)
ভাস্করব্রত পতি
মেদিনীপুর কলেজে এফ এ পরীক্ষায় অঙ্কতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পান। ১৯০৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই আইন পরীক্ষায় পাস করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জন কার তাঁকে মেদিনীপুরে ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ করেন। তমলুকের রেজিষ্ট্রি অফিসে যোগ দিলেও স্বদেশী আন্দোলন করার জন্য তাঁকে রাঁচিতে বদলি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তিনি নাকি আলিপুর বোমা মামলায় জড়িত আসামীদের একশো টাকা চাঁদা দিয়েছেন! এজন্য বর্ধমানের কমিশনার মিঃ ওয়ালশ তাঁকে কৈফিয়ত তলব করেন। কিন্তু বোমা মামলার অভিযুক্তরা ছাড় পাওয়ার ফলে এ বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কোনো শোরগোল হয়নি। কিন্তু তিনি সরকারি চাকরিতে অনাগ্রহ পোষণ করেন এরপরেই। ১৯১১ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেদিনীপুর সেটেলমেন্ট কোর্টে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন। ১৯১৪ তা ছেড়ে দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের জুনিয়র হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেনদেন সাতকড়িপতি রায়।
১৮৮০ সালের ২৮ শে মে চন্দ্রকোনার জাড়াতে জন্মগ্রহণ করেন মেদিনীপুরের খ্যাতনামা বিপ্লবী সাতকড়িপতি রায়। তিনি ছিলেন যোগেন্দ্র চন্দ্র রায়ের মেজ ছেলে। মেদিনীপুর হার্ডিঞ্জ স্কুল, জাড়া হাই ইংলিশ স্কুল এবং সবশেষে মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ইতিহাস বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় পদক ও বৃত্তি লাভ করেন। এহেন মানুষটি কিন্তু হেসে খেলে সরকারি বদান্যতায় জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু করেননি। জীবনটাকে অন্যভাবে অতিবাহিত করেছেন দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে।
মেদিনীপুর বোমা মামলার আসামী হেমচন্দ্র কানুনগো, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়দের দীপান্তর বাস থেকে মুক্ত করার কাজে ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সহযোগী সাতকড়িপতি রায় সফল হন। উল্লেখ্য, তাঁর দাদা কিশোরীপতি রায় ছিলেন জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক এবং ভ্রাতুষ্পুত্র সনাতন রায় জেলাশাসক বার্জ হত্যা মামলায় দীপান্তর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ১৯২১ সালে বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি গঠিত হয়। তাঁর সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। সহ সম্পাদক হন সাতকড়িপতি রায়। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জনের নির্দেশে বড়বাজার কেন্দ্র থেকে স্বরাজ্য দলের প্রতিনিধি হয়ে চিত্তরঞ্জনের ভাই অ্যাডভোকেট জেনারেল সতীশরঞ্জন দাশকে ১২০০ ভোটে পরাজিত করেন।
ঠিক এই সময় ঘাটাল এবং উত্তরবঙ্গে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। ঘাটালে বন্যা দুর্গতদের জন্য বন্যাত্রাণের দায়িত্ব পড়ে সাতকড়িপতি রায়ের ওপর। মেদিনীপুরে মহাত্মা গান্ধী এবং সরোজিনী নাইডু এলে তিনি দোভাষীর কাজ করেছিলেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর ডাণ্ডি অভিযানে সাতকড়িপতি রায় একদিনের জন্য পা মিলিয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন ১৯১৪ থেকে আমৃত্যু কলকাতা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। মেদিনীপুর সম্মিলনীর আজীবন সভাপতি। কলকাতা রিলিফ কমিটি, অরবিন্দ সেবক সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
১৯৩৪ সালে বাংলায় হরিজন সেবক সংঘের সম্পাদক হন তিনি। আর সভাপতি হন বিপিনচন্দ্র রায়। একসময় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে এবং তাঁর দাদাকে জেলা থেকে বহিষ্কার করে বিপ্লবী কার্যকলাপের জন্য। ১৯৩৮ এর ৩ রা মে ঘাটাল সফরে আসেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তখন তাঁর পথের সঙ্গী ছিলেন 'সতুদা' ওরফে সাতকড়িপতি রায়, জহর বক্সী, দেবেন্দ্রলাল খান, অরবিন্দ মাইতি প্রমুখরা। ১৯৪১ এ শ্রীমৎ প্রণবানন্দজীর সংস্পর্শে আসেন।
রাজপুতানার বীর রানাদের বীরত্বের কাহিনী নিয়ে তিনি অনেক নাটক লিখেছেন। 'প্রনব' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন 'চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে আট বছর' নামে একটি লেখা। ব্যাপক সাড়া পড়ে তাঁর এই লেখাটি। ১৯৬৫ সালে নিজের গ্রামেই স্থাপন করেন 'জগন্মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়'। ১৯৬৮ সালের ২৯ শে নভেম্বর এই মহান বিপ্লবীর জীবনাবসান ঘটে। মেদিনীপুরের মানুষ রতন এই মানুষটির নাম কিন্তু আজও প্রায় অপরিচিত হয়েই রয়ে গেছে জেলাবাসীর মননে।
0 Comments