সুমিত্রা ঘোষ
স্নানযাত্রার দিन মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে যে সমারোহ হয়েছিল, তা ওই সময়ের মানুষ দীর্ঘকাল মনে রেখেছিলেন। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ এই অনুষ্ঠানটি ভুলতে পারেননি। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ হিন্দুর দশবিধ সংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। ব্রাহ্মণের পালনীয় কর্মাদি সম্পর্কে, তখন ছিলেন সচেতন। রানি রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দেবালয় সম্পর্কে তাঁর ভক্তদের বলতেন রানি যেন একটি রজতগিরি তুলে এনে গঙ্গার তীরে বসিয়ে দিলেন।
মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে আলোকমালায় দক্ষিণেশ্বর থেকে বরানগর পর্যন্ত সাজানো হয়েছিল। পূজো উপলক্ষে একাধিক পুরোহিত নিযুক্ত ছিলেন। এক একজন পুরোহিত এক একটি পুজোয় ব্যস্ত ছিলেন। পুজো ছাড়া শাস্ত্রপাঠ, সংগীত, সানাই, মায়ের গান এসব তো ছিলই। পুজো উপলক্ষে সাধু, পরমহংস, হিন্দু, খ্রীষ্টান শাক্ত, বৈষ্ণব, পুরুষ, স্ত্রীলোক, ছেলে মেয়ে সকলেই এলেন। মিষ্টার তৈরির ভিয়েন বসান হয়েছিল। বহু প্রকারের মিষ্টান্ন তৈরি করা হয়েছিল। ভোগের আয়োজন ছিল অভূতপূর্ব। মায়ের ভোগ চূড়ার আকারে সাজানো হয়েছিল। উৎসবের দিন অত আহারাদির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও রাজকুমারের ছোটভাই গদাধর কিছুই গ্রহণ করলেন না। গদাধরের মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তাঁর ব্রাহ্মণের সংস্কার, আচারনিষ্ঠ পিতার স্মৃতি। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় অতি নিষ্ঠাবান ও পরম ভক্ত ছিলেন। শূদ্রের দান পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়। দাদা রামকুমার জগদম্বার অন্নভোগ গ্রহণ করলেও প্রথমে গদাধর তা গ্রহণ করেননি। পিতার সংস্কার তখনো তাঁর মনে - অশূদ্রযাজিত্ব, অপরিগ্রাহিত্ব। পুজোর দিন সন্ধ্যার সময় চিঁড়ে ভাজা, ছোলা ভাজা কিনে চিবোতে চিবোতে ফিরে গেলেন ঝামাপুকরে। পরের দিন গদাধর দক্ষিণেশ্বরে এসে দেখলেন তাঁর দাদা মায়ের পূজারী নিযুক্ত হয়েছেন এবং দক্ষিণেশ্বরে থাকবেন। তখন গদাধরও দক্ষিণেশ্বরে থেকে গেলেন কিন্তু মা ভবতারিণীর অন্নভোগ গ্রহণ করতেন না। সিধা নিয়ে গঙ্গার ধারে স্বপাকে আহার করতেন। দাদা রামকুমার গদাধরকে বোঝাতে লাগলেন যাতে ভাই কালীমন্দিরে থাকা এবং আহার গ্রহণে রাজি হয়। দাদার কথায় ভাই গদাধর অন্নভোগ গ্রহণ করতে রাজি হলেন।
রামকুমার ও গদাধর মন্দিরে থেকে গেলেন। রানি রাসমণি তো মহা খুশি এমন পূজারি পেয়ে। তিনি ভাবলেন এতদিনে জগদম্বার দেওয়া স্বপ্ন সফল হতে চলেছে।রামকুমারের পর গদাধর পূজাকার্যে নিযুক্ত হলেন। সবই ছিল মা ভবতারিণীর নির্দেশ। ঐসময় গদাধরের বয়স ২১/২২ বছর হবে। রামকুমারের মাধ্যমভাতা রামেশ্বরও দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়িতে কালীপূজো করেছেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ির মন্দির চত্বর বিশাল। দ্বাদশ শিবমন্দির - পাকা উঠান ও একপাশে বিষ্ণুঘর - শ্রীশ্রী ভবতারিণী মা কালী- নাটমন্দির - ভাঁড়ার, ভোগঘর, অতিথি শালা ও বলিদানের স্থান- অফিসঘর - ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর, ঠাকুরের ঘরের মধ্যে দেওয়াল জুড়ে আছেন ঠাকুরের অন্তরঙ্গ শিষ্যগণ। ওদিকে নহবত যেখানে মা সারদা বসবাস করেছেন। নহবতের পাশে বকুলতলা ও পঞ্চবটী। এই পঞ্চবটী তলায় ঠাকুর ধান করতেন। এছাড়া ঝাউতলা, বেলতলা, সদর দরজা ও খিড়কি দরজা ছিল। বর্তমানে অবশ্য প্রয়োজনে কিছু কিছু পরিবর্তিত হয়েছে। দ্বাদশ শিবমন্দিরের লাগোয়া পাকা উঠোন। উঠোন আকারে বিশাল। উঠোনের মাঝখানে সারি সারি দুইটি মন্দির। উত্তরদিকে রাধাকান্তের মন্দির। রাধাকান্ত মন্দিরের ঠিক দক্ষিণে মা-কালীর মন্দির। রাধাকান্ত মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ আছে, এই মন্দিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চওড়া বারান্দা তারপর দেবালয়। রানি রাসমণির আমলে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রী রামকৃষ্ণদেব ও ক্ষেত্রনাথ পুরোহিত পুজো করেছেন রাধা গোবিন্দ মন্দিরে। ১২৬২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে নন্দোৎসবের দিনে গোবিন্দজীকে কক্ষান্তরে শয়ন দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় পূজারি ক্ষেত্রনাথ পড়ে গেলেন। বিগ্রহের একটি পা ভেঙে গেল, পা ভাঙা নিয়ে রানিকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল, একপক্ষ বললে নতুন একটি মূর্তি গড়াতে হবে, অপর পক্ষের মত ভগ্ন পদের সংস্কার করলেই চলবে। রানি রাসমণি পণ্ডিতবর্গকে আহবান জানালেন এই সমসার সমাধানের জন্য। পণ্ডিতবর্গ বিধান দিলেন ভগ্ন মূর্তি গঙ্গাজলে বিসর্জন দিয়ে নতুন মূর্তি স্থাপিত হোক।ক্রমশ
0 Comments