আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
শুরুর কথা
জীবন তো হাওয়ার মতো, নদীর মতো নিত্য বহমান। এই যেমন, দাওয়ার পাশের শিরীষ গাছটিতে প্রতি প্রত্যূষে এসে লাগে নবীন রোদ ঘ্রাণ,পাতা জাগে, ফুল জাগে। আবার,দিনান্তে তার পায়ের তলাতেই এসে জমে বিধুর গোধূলি, ছায়া পড়ে,মায়া পড়ে। একটা গোটা জীবন জুড়ে মানুষ তার উৎস থেকে মোহনা যাত্রাপথে অযুত অভিজ্ঞতার নুড়ি কুড়িয়ে এইভাবেই হয়তো পেরিয়ে যায় অনাদি পথ; সুখে-দুঃখে, পতনে-উত্থানে; জীবন পেরিয়েও যা অমূল্য, চিরায়ত; প্রতীক্ষাকাতর, শুভেচ্ছামধুর।
তাই প্রতিটি জীবনের গল্পই হয়তো রূপকথা সদৃশ, সাধারণ হয়েও অসাধারণ।
এমনই এক নারীর কথা,তাকে জড়িয়ে তার সময়, পরিবার, সমাজ ও নিজস্ব চেতনার কথকতা চিত্রায়িত এই স্মৃতি আলেখ্যে। কঠোরে-মধুরে,বিপদে-সংঘাতে,আদরে-ঘৃণায় লালিত এই যে আমাদের মধ্যবিত্ত অনৃত যাপন; যা মৌসুমীবায়ুর মতো, পশ্চিমী ঝঞ্ঝার মতো,ঝিরিঝিরি ঝর্ণা অথবা বেত্রবতী তটিনীর বেগে সম্পর্কের,প্রকৃতির উপলে-মাস্তুলে আছড়ে পড়ে; সাহিত্যকে বাধ্য করে তাকে আখরায়িত করতে। লিপিবদ্ধ হয়ে থাক তা না’হয় আগামীর জন্য,অন্য কোন বৃহত্তর আখ্যান সম্ভাবনায়…
প্রথম পর্ব
‘আ…চৈ চৈ চৈ…! আ… চৈ চৈ চৈ… !
আ মোলো যা, সন্ধ্যে নামতে চললো, ঘরে ঢোক না!তোদের নিয়ে আর পারিনা বাপু! ’…
অগ্রহায়ণের শেষ বেলায়, বাড়ীর খিড়কিপুকুরটির জলে তখনও এসে পড়ছে দিনশেষের আলো। সে আলো খেলা করছে সঞ্চরমান হাঁসগুলির সারা গায়ে, পালকে, চঞ্চুতে। সেই ওম্ গায়ে মেখে ডানার ঝাপটায়,কর্কশ কাকলীতে তখনও শেষ হয়নি তাদের যূথবদ্ধ বিশ্রম্ভালাপ,দিনান্তের শেষ জলযাপন। স্বাভাবিক চোখে বড়ো রমনীয় এ দৃশ্য। তবু তা কি বিব্রত করলো ঐ একাকিনী রমনীর মনকে?
আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে তাই কি ঐ এঁদোপুকুরের হিমশীতল জলে গা-কাপড় ধুয়ে পুকুরঘাটের মোরাম পৈঠা পেরিয়ে চলে গেলেন দ্রুত অবগুণ্ঠবতী সেই শুভ্রবসনা মধ্যবয়সিনী? ঘোমটার আড়ালে ঢাকা মুখখানি দেখা না গেলেও গলার স্বর এবং চলনভঙ্গীতেই ধরা পড়েছে তাঁর ব্যস্ততা এবং অসন্তুষ্টি।
আর হবে নাই বা কেন! যাঁর জীবন কাটে অর্থহীন অব্যবস্হায়,বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা জেনেও যার প্রতিদিনের দিন গুজরান, এসব দেখার অবসর তাঁর কই!
এমনিতেই এমন সব শীতের বেলার তো শুধু পালাই পালাই বাই। সকালবেলার শিশিরটুকু ঘাসে লাগার তর নেই, তাড়া লেগে যায় সংসারের। সারা ঘর জুড়ে বাসী ছড়া দেওয়া,রান্নাশালে গোবর লেপা,সে পাট মিটিয়ে কাঠের উনুনে রান্নার হুটোপুটি, ছেলেপুলেদের স্কুল বা অফিসের ভাত,বৌদিদিদের গেরস্থালি সামলে দেওয়া, সময়ে সময়ে ধান সেদ্ধ, মুড়ি ভাজা….একান্নবর্তী গ্রামীণ সংসারে কাজের তো অন্ত নেই।
তারই মধ্যে পুষেছিলেন হাঁস কয়টি, ছেলেপুলেদের ডিম খাওয়া এবং অবশ্যই কিছু বাড়তি রোজগারের আশায়,তখনকার দিনের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত গৃহস্থালি বাড়িতে যেমন থাকে।
বেলা প্রায় পড়ে এলো, হাঁসগুলিকে এখনি খাঁচায় না পুরতে পারলে রাতে বেড়াল বা বেঁজি আঁচড়াবে,চ্যাঁ-চ্যাঁ চিৎকারে বড়োদাদার ঘুম নষ্ট হবে,রাগারাগি করবে,মাঝরাতে সে এক ঝামেলা।
এখনও তুলসীতলায় সন্ধ্যেবাতি জ্বালানো হয়নি, রাতের রান্নার জোগাড় হয়নি, হ্যারিকেন-লন্ঠনগুলোয় বাতি পড়েনি… তাছাড়া সারা দুপুর পুকুর পাড়ে বসে ছিপ ফেলা মাছগুলিকে লঙ্কা তেল দিয়ে নিভু আঁচে বাটিচচ্চড়ি বানাবার আয়োজন হয়নি, বাড়ির কচিকাঁচাগুলো বড়ো ভালোবাসে কিনা… এখনও পড়ে আছে কত্তো কাজ!
🍂
আরও পড়ুন 👇
এই সব ভাবতে ভাবতে চারপাশের গাছগাছালি ছাওয়া ঝুঁঝকো আঁধার পেরিয়ে টক করমচার ঝোপের পাশ দিয়ে ঠাকুর দালানে পৌঁছলেন বিরজা; বিরজাসুন্দরী দেবী। । আসার পথে আগাছা জড়ালো পায়ে, হেমন্ত শেষের অপুষ্ট অগাছা। অনেকটা কি তাঁরই মতো? ভাবতে গিয়ে আচমকাই উদাস হয়ে গেলেন নারী, ক্ষণিক আগের ব্যস্ততা ভুলে তুলসীতলায় ঘটি নামিয়ে তাকালেন পশ্চিম আকাশে ক্রমশঃ ডুবতে যাওয়া সূর্যটির দিকে।
গল্পে শুনেছেন,প্রৌঢ় দম্পতির সন্তান তিনি। যৌবন পেরিয়ে বাবা-মার কোলে এসেছিলেন,জন্মের সময়ে মা-শিশু দুজনকে নিয়েই ছিলো যমে মানুষে টানাটানি;শেষে কন্যে প্রাণে বাঁচলেও মায়ের শরীর নিতে পারেনি বেশি বয়সের মাতৃত্বের ভার। জন্মের এগারো দিনের মাথায়ই মাতৃহারা হন তিনি,বাবার স্নেহ সে অর্থে পাওয়া হয়নি তাঁর। তবে তখনকার দিনে এসব তো ছিলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবু,তাঁর ভাগ্য ভালো,মোটামুটি যত্নেই বড়ো হয়েছিলেন মিলিজুলি পরিবারে। দুর্গাপুজোর সময়ে জন্ম,নামকরণও হয়েছিলো দেবীর নামে, ডাকনাম ছিলো তারা।
তবে মা না থাকলেও,দাদা-দিদি, খুড়িমা, জ্যাঠাইমা সহ বাড়ির সবার চোখের মনি ছিলেন, আদরের ঘনঘটাও ছিলো বেশ।
এবং তাদেরই উৎসাহে মধ্যবিত্ত চাষনির্ভর পরিবারের কন্যে হয়েও অক্ষর পরিচয় হয়েছিলো তাঁর;বাপ-খুড়োর উৎসাহে, বাড়িতেই দাদাদের কাছে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগরের বই, নামতা, প্যারীচরণের ফার্স্টবুক। এবং একটু বড়ো হতেই রূপের দৌলতে বিয়েও হয়েছিলো খুব বড়ো এক পালটি পরিবারে, বেশ ঘটা করে। কথা ছিলো আর পাঁচটি কন্যের মতো কেটে যাবে জীবন আলোয় কালোয়;তবে বিরজাসুন্দরীর অদৃষ্টে সেরকম কিছু হয়নি। আটবছরে গৌরীদান… বড়ো হওয়ার আগেই কপাল পুড়িয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসা! বড়ো নিস্করুণ সে উপাখ্যান…
যদিও এই সব কথকতার কারুণ্য কখনও স্বীকার করেননি বিরজা,জীবনভ'র। নিজের নামের প্রতি সম্মান রেখেই নিজের শর্তে বেঁচেছেন। কুলীন ব্রাহ্মণ বাড়ির বিধবা হয়েও মাছ খেয়েছেন, একা একা তীর্থে গেছেন,নির্ভুল হিসেবে পাড়ার মেয়েদের মহাজনী-সুদ-ধার কারবার চালিয়েছেন!
পাড়াঘরের প্রতিবেশীরা কখনও সহানুভূতি দেখিয়েছে, কখনও ঈর্ষা করেছে। গুরুত্ব দেননি, তিনি থেকেছেন তাঁর মতো। সত্যি কথা বলতে কি, হতাশা, দুঃখ যে একেবারেই আসেনি ভরা যৌবনে, তা নয়। তবে বড় দাদার অভিভাবকত্ব, বড়ো বউদিদির স্নেহ, তাঁরও পরে বিধবা হয়ে বড়োদিদিরও বাপের বাড়িতে ফেরৎ আসা, অনেক গুলি ভাইপো-ভাইঝির মা হয়ে ওঠার সৌভাগ্য; সর্বোপরি শ্বশুরকূলের অগাধ সম্পত্তির উত্তরাধিকার তাঁকে দিয়েছিলো এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য, যা আর পাঁচটা ব্রাহ্মণ পরিবারের বিধবার চাইতে তাঁর জীবনকে অন্য পথে চালাতে সাহায্য করেছিলো।
তবে গোল বেঁধেছে ইদানীং। বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে মেজ ভাইপোর স্ত্রী, ভাইপোটি তাঁর প্রাণ। বছরবিয়োনী তার মায়ের অসুস্থতার কারণে ছেলেটি ছোট থেকেই তাঁর কাছে মানুষ। মনে আছে,মায়ের দুধের চাহিদায় তাঁর কুমারী স্তনে কামড় দিতো যখন শিশুটি,কি যেন এক অব্যক্ত সুখে অথবা হাহাকারের বেদনায় ভরে যেত বুক;না-পাওয়া অথবা পাওয়া,কিসে যে আছন্ন হচ্ছেন তিনি,বুঝতে পারতেন না। তবে দিনরাতের জড়িয়ে ধরা বন্ধনে মা-ছেলে দুজনেই মনে মনে যে এই সম্বন্ধে সাবলীল,তা বেশ টের পান আজকের বিরজা,মুখে তাঁকে তারামা ডাকলেও।
ক্রমে দিন গড়াচ্ছে,তাঁরা বুড়ো হচ্ছেন,ছেলেপুলেরা বড়ো হচ্ছে,মেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে,বড়ো ভাইপোটির পরে মেজ ভাইপোরও সম্প্রতি বিবাহ হয়েছে স্বাভাবিক সংসার ছন্দে। এবং এবাড়ির নিয়ম অনুসারে,বড়ো দাদা,বাপ জেঠাদের মতো মেজছেলেও থাকে তার কর্মস্হলে,ছুটিছাটায় বাড়িতে আসে। তবে,লক্ষ্য করছিলেন তাঁরা,বিয়ের পরে,তার বাড়ি আসার মাত্রা বেশ বেড়েছে। এবং তা যে নববধূর জন্যই তা বুঝতে কারো বাকি নেই। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটির দিকে আঙুল উঠেছে,যেমন আর পাঁচটা গ্রাম্য সংসারে হয়। এদিকে, ভাইপোর নতুন বৌটি শহরে মানুষ, পাড়া গাঁয়ের নিয়মকানুন যে তেমন কিছুই জানে না, তা প্রথম দিনই টের পেয়েছিলেন বিরজা। মাঝেমধ্যেই হি হি হাসি,নূপুর পায়ে দৌড়াদৌড়ি,ছেলের পাত থেকে মুড়ি নিয়ে খেয়ে ফেলা,বাসীকাপড়ে সবাইকে ছুঁয়ে দেওয়া….ইত্যাদি ইত্যাদি অপকর্ম সে করেই চলে নিত্যদিন। এবং এসব নিয়ে কুটকচালিও চলে বিস্তর। তবে কেন কে জানে, নিজহাতেই তাকে আগলাবার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন বিরজা। মেয়েটিও অবশ্য সানন্দে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলো,বেশ কেটে যাচ্ছিলো দিন… (ক্রমশ… )
0 Comments