বার্লিনের ডায়েরি -১০ম পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য।
(উৎসবের বার্লিন পর্বের শেষাংশ)
আলোর উৎসবে মাতোয়ারা বার্লিন নগরীর আকাশ বাতাস। চারদিকে শুধুই মল গুলোতে পোশাকে আশাকে বিলাস -ব্যসন আমোদে প্রমোদে উৎসবের আয়োজন। নিয়ন আলোর ঝকঝকে আলোক সজ্জায় বার্লিন নগরী যেন অপরূপা তিলোত্তমা। আলো ,ফুল, বাজী কেক চকোলেট গিফ্টের আনন্দ ধারা বইছে। বাতাসে ও স্ট্রবেরী ভ্যানিলার মোহনীয় সুবাস। আনাফ্রাঙ্কের মিউজিয়াম থেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরিয়ে অদ্রিজার হাতে হাত রেখে বাস স্ট্যান্ডের দিকে শ্রী এগিয়ে চলেছিল। কাছেই রয়েছে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ মিউজিয়াম। ঋষভের খুব ইচ্ছে এই মিউজিয়াম গুলো তে একটু ঢুঁ মারার।.ও অনেক ভ্রমণার্থী দের মুখেই শুনেছিল এর সংখ্যা পাঁচটি। প্রতিটি মিউজিয়াম ই অতুলনীয় সংগ্রহে পরিপূর্ণ। সব গুলো ঘুরে না দেখতে পেলেও শ্রীর মনে আছে একটি সংগ্রহ শালায় মিশরীয় রানী নেফারতিতির একটি অনিন্দ্য সুন্দর আবক্ষ মূর্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে সেখানে ওরা বহু তর্কে মেতে ছিল। খেয়াল ছিল না ,পশ্চিম আকাশে একরাশ মেটে সিঁদুরের গোলা ছড়িয়ে দিনের সূর্য প্রায় বিদায় নিতে চলেছে।
বার্লিন শহর
মিউজিয়াম বন্ধ হবার আগেই ওরা বেরিয়ে এসেছিল। ২৬০০ বছরের পুরোনো ব্যাবিলনের ইশতার গেট টি --প্রাচীন ব্যাবিলন নগরের এই ফটক যার নীচ দিয়ে সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর আলেকজান্ডার যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন। বাইজেন্টাইন আর্টের সংগ্রহ শালার কোষাগারে সম্ভবতঃ পার্গামন জাদুঘর , বোড জাদু ঘর এবং নিউজ মিউজিয়াম আল্টে ন্যাশানাল গ্যালারীর সাথে ইতিহাসের তথ্য বহুল বেশ কয়েকটি সংগ্রহ শালা দেখতে পেয়ে ঋষভ-- শ্রীময়ীর ইতিহাস বইয়ের পাতার আলোচনা থামে না। অদ্রিজা হেসে বলে তোমাদের জন্য এখানে একটা ক্লাসরুম খোলা দরকার দেখছি। শ্রীময়ী অদ্রিজা কে কপট রাগ দেখায় বলে ইতিহাস তো মোটেই পড় নি তুমি ! তাই জানো না কতটা interesting subject টি?বিশ্বখ্যাত স্বনাম ধন্য সমৃদ্ধময় বড় শহর গুলোর সাথে জন্ম থেকে জড়িয়ে রয়েছে কত উত্থান পতনের ঐতিহাসিক কাহিনী, কত ঐশ্বর্য্য ,কত ঐতিহ্য ,কত সাংস্কৃতিক মর্যাদার সাথে একটা দেশ জাতির স্বপ্নে ভরা গল্প ,সে খবর না পড়লে জানবে কি করে!
🍂
আরও পড়ুন 👇
একটু অপেক্ষা করতেই বাস এলে জানলার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রী জানলার বাইরে একটা দৃশ্য ও যাতে বাদ না যায়।একে একে প্রতিটা বাঁক, মোড় পেরোলেই দেখা যায় কেমন আলোকিত শহর। অক্টোবর মাসে এখানে যে লাইট ফেস্টিভ্যালের শুরু হয় সে আলোকসজ্জা নিউ ইয়ার্স পর্যন্ত চলে। তাই এ শহর ক্রমশঃ মেতে উঠছে আলোর রোশনাই তে। সেদিন তিতিরের বন্ধু নোড়া এসে ছিল, গোলাপি ফর্সা লম্বা লালচে চুল, নির্মল হাসিতে ভরা মুখখানি ,বিদেশিনী ডাচ মেয়েটি কে দেখলেই বেশ মায়াবী মনে হয়। ও অদ্রিজা কে বলেছিল শ্ৰীময়ীকে সাথে নিয়ে আলোক সজ্জায় সজ্জিত বার্লিনের পথে অন্তত একদিন ঘুরে বেড়াবে। শহরের পথে বেড়ানোর ঋষভের ও বেশ উৎসাহ আছে। শ্রীময়ী বলেছিল অবশ্যই একদিন যাবে। আজ চলার পথে বাস থেকেই চোখে পড়লো আলোকমালার সাজে উৎসব মুখর বার্লিন , যত দূর দেখা যায় শহরের সব বিশেষ স্থান ,পর্যটন কেন্দ্র গুলো লাইটের বাহারে সেজে উঠছে। চারিদিকের রাস্তা ঘাট এমনকি পথের ধারে ধারে গাছ গুলো ও আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল। সুন্দরী অপ্সরী রাতের বার্লিন আলোর তরীতে ভেসে চলেছে। সোনালী আলোকে রশ্মিতে উজ্জ্বল এক স্বর্গপুরী ।
বাস থেকে ভিক্টোরিয়ার বিজয় স্তম্ভ দেখিয়ে অদ্রিজা ঋষভ কে বলে এবারে এখানে নামতে হবে-- সন্ধ্যে সাড়ে ছটা পর্যন্ত সময় আছে টাওয়ারে প্রবেশের। শ্রী অবাক হয়ে বলে, আরে বাড়ি যাবো তো ? অদ্রিজা বলে এখন ই নয়। হাত ধরে টানে বলে চল এক্ষুনি নামতে হবে।
শহরের পথে
শহরের এই অনন্য স্থাপত্য ভিক্টোরিয়া বিজয় স্তম্ভ টি বেশ উঁচু। প্রায় কয়েক শত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। এই বিজয় স্তম্ভের সুউচ্চ কলাম টি ১৮৬৪ সালে জার্মানির এক যুদ্ধ জয়ের ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। যার শীর্ষে শোভিত হয়ে আছে একটি সোনালী দেবীমূর্তি যিনি সর্বদা আকাশের দিকে হস্ত প্রসারিত করে আছেন , যিনি বিজয়ের প্রতীক। একরাশ জোনাক পোকার একবার জ্বলা ও নেভার মত অসংখ্য আলোকসজ্জায় সজ্জিত চারধারে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তিতিরের পাগলামো যেখানে যত উঁচু টাওয়ার আছে সেখানে উঠবেই। শ্রীময়ীর পক্ষে এত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা বেশ কষ্টকর হলেও মোটেই সে দমবার পাত্রী নয়। একটু একটু করে মেয়েকে অনুসরণ করে টাওয়ারের শেষ মাথায় উঠে আসে। এবং যখন অতুলনীয় কারুকার্য ভরা স্থাপত্য সৌন্দর্যময় এক উজ্জ্বল শহর ওদের চোখের সামনে দূর দূরান্ত পর্যন্ত ভেসে উঠেছিল , সে দৃশ্য ওকে ও সমান নেশা গ্রস্থ করে তুলেছিল। শ্রীময়ী র মনের অতলে চাপা পড়ে থাকা সুপ্ত ইতিহাস আবার সজীব হয়ে ওঠায় ,মিনিট ঘন্টার কাঁটা নিজের গতিতে ঘুরতে লাগলো।
কাছেই কাইজার ভিলহেম মেমোরিয়াল চার্চ যা বিশ্ববিখ্যাত যুদ্ধ বিরোধী শান্তির প্রতীক । যার ঘন্টা বেজে ওঠায় কী এক অপার্থিব আকর্ষণে খুব তাড়াতাড়ি করে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল ওরা। চার্চের প্রার্থণা সভা কোথায় কোনদিকে জানেনা। ঘন্টা ধ্বনির আওয়াজে ভিতরে না ঢুকে বাইরে থেকে ই ঘুরে দেখেছিলো কাইজার ভিলহেম মেমোরিয়াল চার্চ টির শত ছিন্ন নির্মম ভগ্নদশা। চারিদিকে অসংখ্য নতুন স্থাপত্যের মাঝে এই পুরোনো চার্চবাড়ি টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে এর অনেকাংশ ধ্বংস প্রাপ্ত হয় কিন্ত কিছুটা অংশ আজো পুরোনো স্থাপত্যের নিদর্শন হিসাবে সংরক্ষিত রাখা আছে। যেনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত বার্লিনের ভয়াবহ পরিণতির এক দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যুদ্ধের নানা স্মৃতি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রাখা এ শহর নিজেই এক ইতিহাসের জ্বলন্ত উদাহরণ।
চার্চের বেজে ওঠা সান্ধ্য ঘন্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিলো। চারিদিকে অসংখ্য নতুন স্থাপত্যের মাঝে এই পুরোনো চার্চবাড়ি টি যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছিল তার করুণ কাহিনী শোনানোর জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বংসী বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত বার্লিনের ভয়াবহ নির্মম পরিণতি প্রতীকচিহ্ন বহন করে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপত্য টি দেখে চোখ ভরে জল আসে । চার্চ টিকে প্রদক্ষিণ করে ওর ক্ষয় প্রাপ্ত ভাঙা সিঁড়িতে শ্রান্ত শরীরে বসলে সন সন ঠান্ডা হাওয়া ছুটে এসে যেন চাবুক কষায়। ভাঙা চার্চের খিলান পলেস্তরা খসা ক্ষয়িত দেওয়ালের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয় ওঠে মানব বিশ্বের অস্তিত্বের জন্য শুধুই শান্তি চাই , যুদ্ধ নয় ,রক্ত ক্ষয় নয় , বিশ্বময় অপার শান্তি একমাত্র কাম্য। ঘন্টা ধ্বনি চারদিক থেকে ই প্রতিধ্বনিত হয় । অদ্রিজা বলে , কী সুন্দর এক আবহ এই দিন শেষের ছায়ান্ধকারে লাগছে। ভুষো কালো নাগরিক আকাশের গায়ে হেলান দেওয়া উঁচু উঁচু ইমারতের কার্নিশের ধার ঘেঁষে শুক্লা দ্বিতীয়ার এক ফাঁলি চাঁদ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অম্লান হেসে চলেছে ,একে একে তারা রাজি আকাশের গায়ে জ্বলজ্বল করছে। চার্চ এর সুরেলা ঘন্টা ধ্বনি ,চতুর্দিকে প্রতিধ্বনিত হয়ে যুদ্ধ প্রিয় বিধ্বংসী লীলায় মত্ত জাতি কে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে --এই সুন্দর পৃথিবীতে সবার সমান বাঁচার অধিকার তাই যুদ্ধ বন্ধ হোক। যুদ্ধ নয় ,ক্রোধ হিংসা দ্বেষ নয়,শান্তি চাই ।শান্তি বিরাজ করুক সর্বত্র ।
শ্রী চুপ করে ভাবে শুধু বিশ্বযুদ্ধ নয় পরবর্তী কালে নানা ঠান্ডা লড়াই ,স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম পীঠস্থান এই নগরটি। আজো সেই ক্ষতের স্মৃতি বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় নতুন যুগের বার্লিন। কৌতূহলী ওর মন এ শহরের পথে পথে খুঁজে বেড়ায় বিশ্বযুদ্ধের বাঙ্কার নাৎসী দপ্তর সোভিয়েৎ সেনাদের গণ কবর বা বার্লিন দেওয়ালের ভগ্নাংশ। পূর্ব জার্মানির মুক্তি কামী মানুষের খোঁড়া সেই বিখ্যাত ট্যানেল গুলো কোথায় ? যার কাছে গেলে আজ ও হাওয়ায় প্রতিধ্বনিত হয় অত্যাচারের বোবা কান্না।
শহর বার্লিন
সারাদিন ও রাতের ঘোরাঘুরিতে ক্লান্ত শরীরে শীতের হাওয়া এখন ও প্রবল বেগে হুল ফুটিয়ে চলেছে। এবারে খুব দ্রূত আঁধার ঘনিয়ে আসছে বার্লিনের রাজপথে। শ্রীময়ীর কল্পনার চোখে ভেসে উঠছে কত রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিষাদ ঘন মুহূর্তের ছবি। এতক্ষন অতীতের পাতায় আচ্ছন্নের মত ওর মন, ওর চিন্তা ডুবেছিল বিশ্বযুদ্ধ,হিটলার, ফায়ার কামান, বম্বিং,যুদ্ধ বিমান প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ নাশকতা রক্তনদীর দৃশ্য। যদি ও সব চাপা পরে গেছে আলোর রোশনাইয়ে।
ঋষভ ঘড়ির দিকে তাকায় , রাত প্রায় সাড়ে ন'টার কাছে। বাস এসে গিয়েছে , এবার বাড়ি ফেরা। অতীতের পাতায় আচ্ছন্নের মত ডুবে ছিলো শ্রীময়ী। চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মত চলমান ছিল লেলিহান অগ্নি শিখায়,লোলুপ ধ্বংসে যুদ্ধ জয়ের কাহানী । বাস কাইজার স্ট্রীটের বাড়ির কাছের নির্দিষ্ট স্টপেজে থামতেই ও যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিলো। আস্তে আস্তে দোতলা বাসের সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়েছে রাস্তায়। ধীরে ধীরে আট লেনের বড় রাস্তা টি পার হয়ে পাঁচমিনিটের মত পায়ে হেঁটে ঘরের রুম হিটারের উষ্ণতার আরামে দুরন্ত ঠান্ডা থেকে রেহাই পাওয়া গেল।
এবার ডিনার টেবিলে বসে গরম ধোঁয়া ওঠা চিকেন স্যুপের বাটিতে চামচ ডুবিয়ে নিজের হাতে বানানো রুমালি রুটির টুকরো ছিঁড়ে মুখে পুরে শ্রীময়ী নতুন ভাবনায় ভারী ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অজস্র চিন্তার সাথে মনের মাঝে ঘুরপাক খায় আরো নতুন জায়গা দেখার পরিকল্পনা। আগামী উইকএন্ডে কোথায় কেমন করে কাটবে আরো দুটো ছুটির বেলা-- ও র বেড়ানোর হুজুগ দেখে ঋষভ ,অদ্রিজা কে বলে "তোমার মা র অবস্থা দেখ! এবার বুঝি ,ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে ও নতুন দেশে পাড়ি দেবে । কাল সকালেই দেখবে নতুন কোনো জায়গায় বেড়ানোর পরিকল্পনা একবারে রেডি। " ক্রমশ
0 Comments