পঞ্চদশ পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল
প্রচন্ড ভিড়ের চাপে আমার নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। কোনক্রমে একবার দর্শন করে মন্দিরের বাইরে এসে আমার স্ত্রীকে যেখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম সেই রাস্তার হদিস কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। প্রত্যেকটি রাস্তায় জনসমুদ্র লক্ষ করে যাচ্ছি। বৃন্দাবনে শুধু বাঁকেবিহারী মন্দিরেই নয়, ছোট মাঝারি সব মন্দিরেই হোলি খেলা হয়। ব্রজভূমির সব মন্দিরেই একই দৃশ্য। কোথাও আবির, গুলাল খেলার সঙ্গে চলে পিচকারির রঙ খেলা। মথুরা বৃন্দাবনের বেশ কয়েকটি মন্দিরে ভক্তেরা ঝুড়ি ভর্তি গোলাপের পাপড়ি নিয়ে আসেন। প্রথমে মন্দিরের বিগ্রহকে গোলাপের পাপড়ি দেওয়া জল দিয়ে স্নান করানো হয়। তারপর নিজেদের মধ্যে গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়ে খেলা হয়। গোলাপের সুগন্ধে সমস্ত মন্দির সুরভিত হয়ে ওঠে। বিভিন্ন বৈষ্ণব সংঘ ও আখড়ার ভক্তরা তাদের গুরুদেব ও কৃষ্ণের ছবি নিয়ে নাম সংকীর্তন করতে করতে পথ পরিক্রমা করছেন। রাধা-কৃষ্ণ নামসুধায় গোটা বৃন্দাবন আজ মাতাল হয়ে উঠেছে।
অবশেষে প্রায় এক ঘণ্টা পরে স্ত্রীকে যেখানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম সেই রাস্তার হদিস পেলাম। এখান থেকে আমরা যখন আমাদের আশ্রমে ফিরলাম তখন প্রায় বেলা একটা বেজে গেছে। এই দিন দুপুরে আমাদের আশ্রমে ভান্ডারা ছিল। দুপুরে খাওয়ার পরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে পুনরায় বাঁকেবিহারীজীর মন্দিরে গেলাম। বিকেলে অবশ্য সকালের মতো এতো ভিড় ছিল না। যেটুকু ভীড় ছিল সেই ভীড় ঠেলে আমরা এগিয়ে একেবারে রেলিংয়ের ধারে যেয়ে দাঁড়ালাম। খুব কাছ থেকে দর্শন করতে পারলাম বিগ্রহকে। বিগ্রহের বাঁদিকে নিচের বেদীতে একটি ছোট্ট বিগ্রহ এবং একটি ছোট মুকুট। তার বাঁ পাশে একটি প্রাচীন তৈলচিত্র। মন্দিরের একজন সেবাইতকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন এটি হরিদাস স্বামীর তৈলচিত্র। পটের মুখ বাঁকেবিহারীজীর দিকে ফেরানো। মনে হচ্ছে যেন তিনি সবসময় বাঁকেবিহারীকে দর্শন করছেন। ভোগ নিবেদনের সময় ভোগের পাত্রটি আগে তৈলচিত্রে ছুঁইয়ে বাঁকেবিহারীজীকে নিবেদন করা হয়। মনে করা হয় যেন হরিদাস স্বামী সবকিছু বাঁকেবিহারীজীকে নিবেদন করছেন। হরিদাস স্বামীর ডান পাশের মুকুটটি শ্রীমতী রাধারানীর প্রতীক। তার তলায় শিলাকৃতি রাধাযন্ত্র। ওই রাধাযন্ত্র নিয়ে হরিদাসস্বামী সাধনা করতেন। আমরা বাঁকেবিহারীজীর মন্দিরে পুজো দিয়ে ধীর স্থির ভাবে ফিরে এলাম যখন তখন রাত্রি প্রায় আটটা বাজে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
পরের দিনে বিকেলে আমরা বৃন্দাবনে যমুনার তীরের ঘাটগুলি দেখতে গেলাম, কারণ এখানকার অনেকগুলি ঘাট শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার এবং মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের স্মৃতিবিজড়িত। প্রথমে আমরা গেলাম কদম্বঘাটে। কদম্ব ঘাট সম্বন্ধে বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে গোপীগনের কাত্যায়নী ব্রত পালন এবং তাঁদের বস্ত্রহরণের কথা এসে যায়। কদম্ব ঘাটের আরেক নাম চীরঘাট। গোবিন্দঘাটের উত্তরে আর ভ্রমরঘাটের দক্ষিণে এই ঘাট অবস্থিত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবনে এসে চীরঘাটে প্রথম স্নান করেছিলেন। তবে প্রধান পরিচয় এই ঘাটে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপীগনের বস্ত্রহরণের লীলাস্থল। ঘাটের উপরে কদম্ব গাছটির নাম চীরকদম্ব।
আমরা কাত্যায়নী ব্রতের কথা উল্লেখ করে পরবর্তীতে বস্ত্রহরণের কথা উল্লেখ করছি। ব্রজকুমারীরা শিশুকাল থেকেই শ্রীকৃষ্ণকে খুব ভালোবাসেন আর কৃষ্ণপ্রেয়সী হওয়ার জন্য লালায়িতা। তারা বয়সে বালিকা হলেও কৃষ্ণ প্রেমাবেশে এতই আকুল যে তারা শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাবার জন্য একেবারে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। তারা সর্বদাই চিন্তা করতেন আর সমবয়সীদের সাথে পরামর্শ করতেন কেমন করে তাদের শ্রীকৃষ্ণের সাথে বিবাহ হবে আর পতিরূপে শ্রীকৃষ্ণকে পেয়ে তাঁর সেবা করে তাদের জীবন ধন্য হবে। একদিন কোন এক নির্জন স্থানে বসে যখন সকলে মিলে কৃষ্ণ কথা আলোচনা করছিলেন তখন বৃন্দাবনের বনদেবী বৃন্দা সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন "হে গোপ কুমারীগণ, আমি এই বন থেকে প্রতিদিনই তোমাদের অন্তরের কথা শুনি। আমি আমার সাধনালব্ধ পরম করুণাময়ী কাত্যায়নী দেবীর মন্ত্র তোমাদের প্রদান করব। তোমরা একমাস ওই মন্ত্র জপ করে কৃষ্ণশক্তি দেবী কাত্যায়নীর অর্চনা করবে আর তাতেই তোমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হবে"। এই কথা বলে বৃন্দাদেবী তাদেরকে কাত্যায়নী দেবীর মন্ত্র দিলেন। তারপর দেবীর আরাধনা কিভাবে করতে হবে জানিয়ে বৃন্দাদেবী সেখান থেকে চলে গেলেন। বৃন্দাদেবীর উপদেশ অনুসারে কৃষ্ণ অনুরাগিনী গোপকুমারীগন কাত্যায়নী ব্রত পালন কৃষ্ণপ্রাপ্তির একমাত্র উপায় জেনে কার্তিকী পূর্ণিমার পরদিবস থেকে অঘ্রান মাসের পূর্ণিমা পর্যন্ত একমাসকাল যথারীতি ব্রত অনুষ্ঠান করতে শুরু করলেন। তারা সূর্যোদয়ের পূর্বে ব্রাহ্মমুহূর্তে যমুনা তীরে উপস্থিত হয়ে যমুনাতে অবগাহন করতেন। যদিও হেমন্তকালে ওই সময়ে যমুনার শীতল জলে অবগাহন কষ্টকর তবু কৃষ্ণের প্রতি অনুরাগবশতঃ এই কষ্ট স্বীকার করে যমুনার তীরে বালুকাময় স্থানে সারিবদ্ধ ভাবে বসে বালুকা দ্বারা কাত্যায়নী দেবীর মূর্তি রচনা করে ভক্তি সহকারে অর্চনা করতেন। ব্রজবাসীগন অর্থাৎ বালিকাদের পিতামাতারা কেউই ব্রজকুমারীদের এই কাত্যায়নী পূজার সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না। গোপকুমারীদের অপার কৃষ্ণ অনুরাগের মহিমায় ও কৃষ্ণপ্রাপ্তির তীব্র উৎকণ্ঠায় এইভাবে দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে ব্রতের শেষ দিন এসে উপস্থিত হল। ব্রজকুমারীরা তাদের ব্রত আরম্ভের দিন থেকে শুরু করে কবে পূর্ণ হবে আর কৃষ্ণচন্দ্রের সাথে মিলন হবে বলে আকুল উৎকণ্ঠায় দিন গুনতে গুনতে আজ শেষ দিনের সন্ধান পেলেন। আগের আগের দিনের মতো আজও তারা রাত্রি শেষে শয্যা ত্যাগ করে কাত্যায়নী পূজার উপকরণ নিয়ে সকলে মিলে যমুনা তীরে এসে মন প্রাণ ঢেলে কাত্যায়নী দেবীর অর্চনা করলেন। তারা সেদিন মনে মনে স্থির করে নিয়েছেন যে আজ আমরা পতিরূপে ব্রজরাজনন্দনকে লাভ না করে ঘরে ফিরে যাব না। তারা যমুনা তীরে রইলেন আর মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন হয়তো ব্রজদুলালের এখনো প্রাতঃভোজন সমাপন হয়নি তাই তার আসতে দেরী হচ্ছে। এই কথা চিন্তা করে তারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতীক্ষায় পথের দিকে চোখ রেখে যমুনা তীরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষন এই ভাবে কাটানোর পরে তারা মনে ভাবলেন আজ আমাদের মহাযজ্ঞ শেষ হয়েছে কিন্তু আমরা এখনো যজ্ঞশেষে অবশ্য কর্তব্য যজ্ঞের অঙ্গীভূত স্নান করিনি বলেই বোধহয় আমরা যজ্ঞের ফল পাচ্ছি না। তাই আর দেরী না করে তারা স্নান করতে যমুনা তীরে বস্ত্র রেখে বিবসনা হয়ে যমুনার জলে নেমে উচ্চকণ্ঠে কৃষ্ণ গুনগান করতে করতে যমুনাতে জলবিহার করতে লাগলেন। এখানে উল্লেখ্য যে শ্রীকৃষ্ণের তখন বয়স মাত্র ৭ বৎসর আর গোপ কুমারীরা তার চেয়েও বয়সে ছোট। তাই গোপকুমারীদের অমন বিবসনা হয়ে স্নান করার মধ্যে কোন অশ্লীলতা আরোপ করা উচিত হবে না। শুধু তাই নয় সেই সময়কালের ব্রজের সকল নারীরাই বিবসনা হয়ে স্নান করতেন। এই রকম বিবসনা হয়ে স্নান করার দৃশ্য এখনো দু একটি তীর্থে দেখা যায়। যাই হোক সূর্যোদয়ের পরে সেই দিন প্রায় তিন ঘণ্টা কাল কেটে গেছে তবুও শ্রীকৃষ্ণ তখনও পর্যন্ত যমুনা তীরে এসে পৌঁছাননি। গোপকুমারীদের পিতা-মাতারা পর্যন্ত বুঝতে পারেননি যে তাদের শিশুকন্যারা গৃহে নেই। গোপকুমারীদের যমুনা বক্ষে মিলিত কৃষ্ণ গান ক্রমশ উচ্চ থেকে উচ্চতর হয়ে যমুনা তীরভূমিস্থ বনভূমিতে প্রতিনাদিত করে যেখানে শ্রীকৃষ্ণ গোপবালকদের সাথে গোচারণ করছিলেন সেখানে শ্রীকৃষ্ণের কর্ণগোচর হল। তিনি তার সহচর - শ্রীদাম, সুদাম, বসুদাম ও কিঙ্কিনি এই চার জনকে নিয়ে গোপকুমারীদের কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে যমুনা তীরে গেলেন।
পরবর্তী অংশ ষোড়শ পর্বে
0 Comments