সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ২৫
গৌতম বাড়ই
রাঢ়ের সেই ভয়ানক সিংহরাজের মনে ভয় ধরে গেল। আজ কিছুদিন হল খেয়াল করছেন এই জঙ্গল প্রদেশের উঁচু- নিচু টিলা পাহাড়ের দেশে রাতের গভীরতায় সহস্র ঘোড়ার খুরধ্বনি প্রায়শই ভেসে আসছে। যখন তারা আসে বাতাসের বেগে আসে , ছিন্ন করে সমস্ত বাধানিষেধ। তাদের আগ্রাসী আর অনুসন্ধিৎসু মনোভাব এক রকম সিংহরাজকে বিপন্ন করে তোলে। সে কে বা তারা কে? দিনের আলো কম হয়ে এলেই , ঘন অন্ধকারে পুরো চরাচর ঢাকবার মুখে এই জঙ্গল প্রদেশে তাদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। সিংহমশায় তাই দিনের আলো নিভে আসতেই এই গুহাআবাসের মধ্যে ঠাঁই নেয় আজকাল, সচরাচর বাইরে আর থাকে না। সংসারের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য, চারজনের আহারের সংস্থান আর প্রয়োজনীয় যা কিছু জিনিস দিনের বেলাই সংগ্রহ করে আনেন। তাই সে গুহার অভ্যন্তরে একগাদা ভয় চোখে- মুখে মেখে বসে ছিলেন প্রায় অন্ধকার কোণটিতে।
সুসীমা এগিয়ে আসে সিংহরাজের দিকে, তার নজর এড়ায়নি বেশ কিছুদিন হল সিংহরাজকে এরকম ভয়ার্ত মুখে চুপচাপ বসে থাকতে। বয়সের সাথে সাথেই সবাই কেমন তার প্রতাপ আর দেহবলের ঘাটতিতে গুটিয়ে আসে, এই সিংহকে দেখে সুসীমার তাই মনে হয়। সে এগিয়ে এসে বলে-- "হে সিংহরাজ, আপনার সেই তেজ তো আজ অস্তায়মান দেখছি। এরকম ভয়মাখা মুখ কেন আপনার?"
সিংহরাজ কী তার স্ত্রীর কথায় দূর্বলতা প্রকাশ করবেন? বরং এরকম কথাবার্তায় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হলেন।
রেগে গিয়ে বললেন-" এরকম ভাবনা কখনও মনের ভেতরে আনবে না। আমি সিংহ, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত যেমন হিংস্র, আর তেমনই ভয়ংকর।" এই বলে সামনে একটা কাঠের লাঠি দিয়ে সুসীমার গায়ে বেশ সজোরে আঘাত করলেন। ছিটকে পড়লেন সুসীমা। ভীষণভাবে আহত হলেন। আর এইসব দেখতে পেয়ে সিংহবাহু আর সিংহসিবলী জোরে কঁকিয়ে কেঁদে উঠলেন। সিংহরাজ তার পুত্র আর কন্যার ছুটে গিয়ে গলার টুঁটি চেপে ধরলেন। সুসীমার কপাল ছড়ে গিয়েছে, রক্তমাখা মুখে কোনক্রমে উঠে এসে, করজোড়ে মিনতি করে ছেলে আর মেয়েকে বাঁচালেন। আর ঠিক এই সময় রাঢ়ের বনাঞ্চলে শোনা গেল শত সহস্র ঘোড়ার খুরধ্বনি যেন! সুসীমার মনে হচ্ছিল সে ছুটে বাইরে যায়, কিন্তু গুহাপথের সদর দরজায় পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে সিংহরাজ।
🍂
আরও পড়ুন 👇
ক্রমে- ক্রমে বাতাসে মিলিয়ে গেল সে ধ্বনি। তবে এই ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনির ছন্দ তার চেনা মনে হচ্ছে। তার কান এই পুরানো শব্দের ছন্দ চিরটাকালের জন্য ধরে রেখেছে। তাই কী! সুসীমা দাঁতে ঠোঁট চেপে এই হিংস্র পশুর জন্য প্রতিশোধের স্পৃহা জাগিয়ে তুলল মনের ভেতরে। সুসীমার যৌবনের সেই উত্তাল ঢেউ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে, কিন্তু গভীরতা এসেছে আরও। শিখে গিয়েছে আঘাতের প্রত্যুত্তরে দু- পা পিছিয়ে এসে কেমন চার- পা এগিয়ে যেতে হয়। হাজার হোক রাজবংশের রক্ত তো তার শিরা উপশিরায় বয়ে চলেছে। এই বনের জানোয়ার তুল্য হিংস্র সিংহ রাজকন্যার স্বীয় বুদ্ধির কাছে পেরে উঠবে কেন? সুসীমা চরম আঘাত আনবেই। যে ষোড়শী বঙ্গরাজকে এবং তার দোর্দন্ড প্রতাপ বাহিনীকে পর্যন্ত একদিন ভয় না করে , পলায়ন করেছিল অজানার উদ্দেশে, সে এই সামান্য সিংহের কাছে মাথানত করবে!
এমন সময় সিংহকে চমকে দিয়ে গুহার ভেতরে অট্টহাসি শোনা গেল, বৃদ্ধা তাতুলি হো হো করে হাসছেন, সেই হাসিতে যেন সিংহরাজকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই আসল উদ্দেশ্য। সিংহরাজ দাইমা তাতুলির এরকম হাসিতে সত্যি চমকে উঠতে লাগলেন। চিৎকার করে উঠলেন- " এই বুড়ি তোর এই অদৃশ্য পথের আগমন বল ? তুই তো পিশাচিনী! নরকের কীট! কেন এসেছিস বল? " এই বলে সিংহের বারেবারে তার দেখা রাতের দুঃস্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। সিংহের মনে কু ডেকে উঠল, পরপর যা কিছু ঘটছে, এ তো তার মহাবিপদের ইঙ্গিত আগামীর । চুপ করে এবারে থেকে বৃদ্ধা তাতুলির দিকে চেয়ে রইলেন। সেই অন্ধকারে আর আলোতে মিশিয়ে অল্পস্পষ্ট দেখা গেল তাতুলি পরম যত্নে সুসীমার কপালের ক্ষতে শুশ্রূষা করছেন।
বৃদ্ধা তাতুলি বললেন-" এই খুনী আর বদমায়েশ পশু, তুই তোর জীবনে যেটুকু ভালো পেয়েছিস এই রাজকন্যার জন্য। তাকে তুই হেলায় হারাচ্ছিস। তোর অত্যাচারের মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রাজকন্যা সুসীমা বন্দী জীবন কখনও চায়নি, তুই ওকে তো সেই বন্দী করে রেখেছিস? তোর পতন হবেই। তোর মৃত্যু আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করব। আমার কিছুটি তুই করতে পারবি না। আমি আমার সুসীমা মায়ের জন্য অদৃশ্যলোক থেকে যখন- তখন বিপদে আপদে সশরীরে হাজির হব। "
সিংহরাজ ক্রোধে গরগর করতে লাগলেন। সুসীমা তাতুলির প্রাথমিক শ্রুশুষায় অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। তবে সারা দেহে মারাত্মক জখমে ব্যথা হয়ে আছে, যা অসহ্যকর। সুসীমার ছেলে- মেয়ে দুইটি বুড়ি তাতুলির কোলের কাছে গুটিসুটি মেরে পড়ে রয়েছে ভয়ে। জানে, এখানে এই মুহূর্তে তাদের পরম নিশ্চিন্তে থাকা। তাতুলি ছেলেমেয়ে দুটোর মুখে আঁচল থেকে বের করে কিছু খাবার তুলে দেয়। তারপর গুহার ভেতরের আরও অন্ধকারে সে মিলিয়ে যায়। দূর থেকে ভেসে আসে তাতুলির মুখনিঃসৃত ভয়ংকর বাণী । সিংহ একগাদা ক্রোধে অজানার উদ্দেশে রাগে বিচ্ছিরি রকমের আওয়াজ করতে থাকে।
সুসীমা সিংহবাহু আর সিংহসিবলীকে চুপচাপ একা চোট- জখম নিয়ে অসহায় অভুক্ত বসে থাকে। আর দূরে বসে সিংহরাজ ঘরের সমস্ত খাবার-দাবার নিয়ে একা একাই বসে খেতে থাকে। সিংহবাহু বাবার দিকে তাকিয়ে কী যেন মনে করতে থাকে। সেই মনে খুব একটা ভালো কিছু ছিল না। তার মা কখন পাশে রাখা খুঁটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ক্রমশ
0 Comments