জ্বলদর্চি

রাজ্য ও তার গান— প্রাসঙ্গিকতা ও চয়নের যথার্থতা /অনমিত্র বিশ্বাস

রাজ্য ও তার গান— প্রাসঙ্গিকতা ও চয়নের যথার্থতা

অনমিত্র বিশ্বাস


যখন বাংলা দিবস কোন তারিখে রাখা হবে তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল [১], শ্রদ্ধেয় শাস্ত্রজ্ঞ সাহিত্যিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী শ্রাবণী পূর্ণিমা বা ভ্রাতৃত্বের চিহ্ন রাবীন্দ্রিক রাখী উৎসবের দিনটার প্রস্তাব রেখেছিলেন— কারণ সেইদিনই ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড কার্জনের টানা বিভাজনরেখার দুই পারে, প্রথম, যাকে বলা চলে বাঙালীর ‘ন্যাশনাল কন্‌শাসনেস্’ জন্ম নিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথ বলেন্দ্রনাথ কলকাতার রাজপথে চারণের মত সেইদিন গেয়ে ফিরেছিলেন, যাকে বাঙালীর জাতীয় শপথবাক্য বললে ভুল হয় না—
বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান্।
যদিও ‘বন্দেমাতরম্’ ইতিপূর্বে আদিতে বাংলার পরিপ্রেক্ষিতেই লেখা হয়েছিল, কিন্তু সমগ্র স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষ তাকে যথার্থ মূল্যে আপন করে নিয়েছে।

জর্মনির জাতীয় সঙ্গীত বলে, ‘জর্মনি! জর্মনি সবার সেরা।’ [২] রুশদের জাতীয় সঙ্গীতে গায়, ‘রোশিয়া স্ব্যাশ্‌চেন্নায়া নাশা দের্-ৎজাবা— রাশিয়া আমাদের পবিত্র রাষ্ট্র।’ টেক্সাস স্টেটের গানের কথায় আছে, ‘অল্ হেইল্ দ্য মাইহ্‌টি স্টেট।’ [৩] এই ঔদ্ধত্যই জাতীয়তাবাদের পরিচায়ক— এমনকী মঙ্গলের। বাংলা ভাষাতেও এর সমান্তরাল গান আছে বটে, ‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ কিন্তু তা গর্জনরবে গেয়ে উঠবার নৈতিক জোর সত্যই সেদিনের বাঙালীর গলায় ছিল কিনা তাতে সন্দেহ। আজই কি আছে। ১৯০৫-এর আগে স্টেট হিসাবে বাঙালীও নিজের সম্পর্কে ভাবেনি। বাংলা যে প্রাকৃতভাষা এবং সেই প্রাকৃতভাষার সহজ সাবলীলতাতেই [৪] আমি ‘দৈবে হতেম দশম রত্ন নবরত্নের মালে’— মাতৃভাষা সম্পর্কে এমন শ্রদ্ধা রবীন্দ্রনাথের পূর্বসুরীরা কেউই প্রকাশ করতে পারেননি। তার চেয়ে, যে-জাতি হঠাৎ করে সেইদিন আত্মপরিচয় লাভ করল, তার প্রার্থনা বরং এইই হওয়া সঙ্গত— তার আর কিছু নেই, গর্ব নেই ঐশ্বর্য নেই রাজত্ব নেই স্বাধীনতা নেই, মায়ের পায়ে নৈবেদ্য দেবার মত শুধু রক্ত আছে প্রেম আছে। সেই প্রেমে বাংলার মানব-জমিন ‘বাংলার বন, বাংলার মাঠ’-এর মতই পূর্ণ হউক। সেই রক্তটুকুতে সেদিন নিজের সঙ্গে পাঁঠার ভেজাল মেশায়নি বলেই সমগ্র ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালী বারবার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।

কিন্তু জাতি হিসাবে বাঙালীর বোধ সেদিন হলেও জন্ম সেদিন মাত্র হয়নি। পূর্ববাংলার মহাস্থানগড়ের রাজপুত্র পৌণ্ড্রক বাসুদেব স্বয়ং দ্বারকাধীশের মনে যে আশঙ্কার রেখাপাত করেছিলেন মহাভারতের আদিপর্বে তার উল্লেখ দেখি। বিদ্রোহী ভৃগুর মত শ্রীভগবানের নীল বুকে তিনি ধুলামলিন পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন। (পৌন্ড্রকের রাজধানী কোথায় ছিল সেই নিয়ে পণ্ডিত ইতিহাসবিদ্‌দের মধ্যে মতানৈক্য আছে বলেই আমি মূর্খ সেখানে নিরাপদে মন্তব্য করতে পারি। আলী-সাহেব রাসেলের মতকে খণ্ডন করে অভয় দিয়েছিলেন, মারধোর এড়াতে চাইলে পণ্ডিতদের বিবাদই মূর্খের পক্ষে বক্তৃতা দেবার প্রশস্ত সুযোগ। [৫] কারো কারো মতে পৌণ্ড্রকের তৎকালীন রাজত্ব আধুনিক মধ্যপ্রদেশের কোনো অঞ্চলে অবস্থিত; ‘পৌণ্ড্রক’ শব্দটি অবশ্য পুণ্ড্রবর্ধন জনপদ কিম্বা বর্ণবিশেষ দুইই বোঝায়। তবে যেহেতু দ্বারকাধীশের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল বারাণসীতে— যা ধরে নেয়া চলে দুই রাজ্যের মঝখানে অবস্থিত— এটাই মনে করা সঙ্গত যে পৌণ্ড্রকের রাজধানী আরো পূর্বে ছিল, নইলে সেই রাজ্য আক্রমণ করতে উদ্যত দ্বারকাধীশের— বারাণসী পথে পড়ত না।) একেবারে নিকট অতীতে শুধু বাংলার নয়, সমগ্র ভারতে ন্যাশনাল কন্‌শাসনেসের প্রথম প্রবক্তা কলকাতার সিমলেপল্লীর নরেন দত্ত। ত্যাগ সহনশীলতা অহিংসা বৈরাগ্যের প্রতীকী গৈরিকবর্ণে ছত্রপতি যেই বীরত্বের ব্যঞ্জনা সঞ্চার করেছিলেন [৬]— তাকে নতুন যুগের নতুন পটভূমিকায় স্থায়ীরূপে মূর্ত করে তুলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর সেই আত্মপ্রকাশ বিশ্বাবাসীকে অভিভূত করেছে।
🍂
মহাভারতের কালের পর থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত বাংলার বিশেষ উল্লেখ দেখি না ভারতবর্ষের রাজনৈতিক উতরোলে। আলেকজাণ্ডার গঙ্গাহৃদয়ের ওপার থেকেই কারবাঁর মুখ ঘুরিয়েছেন, ধর্মাশোক বাংলার বুকে ধর্মলিপি খোদিত করেননি। তারপরে ভারতবর্ষের আকাশে কালবৈশাখীর ঝড়ের মত উদীত দেখি বাংলার স্বাধীন অধিপতি শশাঙ্কদেবকে— উত্তর ভারতের উজ্জয়িনী-কনৌজের রাজারা হিউয়েন সাং-এর লেখনী ধার করে যাঁকে গাল পাড়া ছাড়া আর কোনো অনিষ্টই প্রতিবেশী গৌড়রাজ্যের করতে পারেনি তাঁর শাসনকালে। [৭] কেবল রাজনৈতিক অটোনমি বা পরিচিত নয়, উপমহাদেশের পরম্পর ঘটনাবলীর মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা এবারে নিতে লাগল বাংলা। এই বাংলার বুকে জয়দেব গোস্বামীর ভূর্জপত্রে দেবভাষা লোকভাষা হয়ে উঠল, পাল রাজাদের কালে ভগবান তথাগত দশাবতারের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলেন— সনাতনধর্মের সঙ্গে দার্শনিক বিপ্লবীর যুগান্তরের সংঘাত ঘুচল। [৮] আরব-মূরদের আগ্নেয়াস্ত্রে নৌকাডুবি হবার আগে পর্যন্ত চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর বিজয়সিংহের পথ ধরে ভারত মহাসাগর চষে বেরিয়েছিল। [৯, ১০]

ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ন্যাশনালিস্ট অডিটোরিয়ামের যথার্থ নামকরণ করেছিলেন কলকাতার মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু— মহাজাতি সদন। আস্ত য়ুরোপের জনসমুদ্রেও এত তরঙ্গোচ্ছ্বাস নেই। তাতে ভারতবর্ষের ঐক্য ক্ষুণ্ণ হয় না, তাতেই ভারতের মহাজাতি আরো মহিমান্বিত হয়ে ওঠেন তেত্রিশ কোটি দেবতার বিভিন্ন অথচ অবিচ্ছিন্ন গৌরবে। তাই পরিচয়ের সেই স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাও কর্তব্য নইলে আলাদা করে প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোতে কিছু কন্‌ট্রিব্যুশান সম্ভব নয়।

বাংলা ক্যালেণ্ডারের পত্তন আনুমানিক শশাঙ্কদেবের সিংহাসনারোহণের সঙ্গে মিলে যায়। আমরা আমাদের ইতিহাস অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখি না, পরে কোনো সমাপতনের উৎস খুঁজতে গিয়ে মিলিয়ে দেখি। এও তেমনি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, ‘যে-জাতির ইতিহাস নাই, তাহার ভবিষ্যৎ নাই।’ বাঙালীর পক্ষে তার কার্যকরণটা সহজে অনুমেয়। তবে তাই যদি হয়ে থাকে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ গৌড়াধিপতির রাজ্যাভিষেকের তারিখকে বাংলা দিবস আখ্যা দেবার যথেষ্ট যুক্তি আছে—

— যদি তার আদৌ কোনো প্রয়োজন থেকে থাকে। এসব দিবসপালনের কনসেপ্টটার ব্যাপারেই আমি এমনিতে খুব স্কেপ্‌টিক। অমুক ডেয়্ তমুক ডেয়্ কিছুই মনে রাখতে পারি না বলেই ‘দ্রাক্ষাফল অতিশয় টক’-এর মত আমি বলি, ‘এসব ডেয়্ নিয়ে মাথাব্যথা করার দরকার কী?’ বলতে পারি, এসব না হয়েও ত রাজ্যের প্রাশাসনিক ইত্যাদি কাজকর্ম দিব্যি চলছিল। কিন্তু গান গেয়ে আজ পর্যন্ত কারো উপকার বই অপকার হয়নি— গানের প্রয়োজন ছিল বইকি। মুকুন্দদাসের দেশাত্ববোধ হোক্ বা লালন-ফকিরের অধ্যাত্ম, তা সবই সর্বত্রগামী হয়েছে গানের ভেলায় চড়ে। রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে আমরা গান আর উপাসনাকে সমার্থক বলে জানতাম। বাংলা ত আর বিহারের মত অন্য রাজ্য থেকে ভেঙে, বাঙালী সরকারী কর্মচারীদের ঠেঙিয়ে ফেরৎ পাঠিয়ে তৈরী হয়নি। [১১] বিহার দিবসে সেই ভাঙনের লিগ্যাসিটি ধরা আছে। (বিহারবাসী আমার অনেক বন্ধু আছেন যাঁদের মধ্যে এই বিদ্বেষে লেশমাত্র দেখিনি। আবার এনআইটির ক্যাম্পাসে থাকাকালীন একাংশের মধ্যে তা আজও দেখেছি। আমার ধারণা, যে-কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যেই— বিশেষতঃ তা যদি হিংস্র প্রকৃতির হয়— জনতার বিপুল অংশ অলিপ্ত এমনকী বিরোধী হয়ে থাকে।) পূর্ববঙ্গের ওপর একদা যে ঈস্ট্ পাকিস্তানের কেতন উড়েছিল— এখন যা বাংলাদেশ— তাতেও সেই একই ভাঙনের উদ্‌যাপন— আরো সহস্রগুণ রক্তাক্ত সেই ভাঙন, অশুভ অশিব ভাঙনের মুহূর্তটিই তার অস্তিত্বের প্রমাণ ও পরিচয়। তার চেয়ে ভারতের বঙ্গপ্রদেশের প্রাদেশিক উদ্‌যাপনের মধ্যে প্রকাশিত হোক্ যা শুভ, যা পুণ্যের, যা আত্মপরিচয়লাভের গৌরবে উদ্ভাসিত— যা ভাঙনের নয়, মিলনের। ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বাংলা এখানেই ছিল, এতে নতুন করে ত কিছু নেই— আধখানি ভূভাগ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অত্যাচারে হারাবার ধাক্কাও প্রতিদিন গ্রেসফুলি কাটিয়ে উঠছে।

তবে গানটি যথার্থ। আমরা অনেকেই জানি না, মহাজাতি সদনে বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ তরুণ দেশনায়কের সম্মানে তাঁর পূর্বলিখিত গানে আরো একটি পংক্তি যোগ করেছিলেন— ‘বাংলার বাহু ভারতের বাহুকে বলিষ্ঠ করুক্।’ সুদূর জাপানের হোন্‌শু দ্বীপের একটি মন্দিরে সেই নেতার মূর্তির সামনে দুইবেলা ফুল-ধূপকাঠির নৈবেদ্য দেওয়া হয়। বাঙালীর লক্ষ্য হোক্ সেই ‘জান্-ই-হিন্দ্’ সুভাষচন্দ্রের কর্মযোগও, গানের এই জাতিগত প্রার্থনা শুধু প্রার্থনায় থেমে না থেকে পূজায় পর্যবসিত হোক্॥


তথ্যসূত্র:

১। ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা, ফেসবুক— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অফিশিয়াল  (https://www.youtube.com/watch?v=iLfOflrX_fo)।
২। বিমল মুখার্জী, ‘দু-চাকায় দুনিয়া’।
৩। উইকিপিডিয়া।
৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘শব্দতত্ত্ব’, বিশ্বভারতী।
৫। সৈয়দ মুজতবা আলী, ‘দেশে বিদেশে’, দে’জ পাবলিশিং।
৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রতিনিধি, ‘কথা ও কাহিনী’, বিশ্বভারতী।
৭। Li Rongxi (tr.), Xuanzang, The Great Tang Dynasty Record of the Western Regions, BDK America Inc. (1996) [dBET PDF Version]।
৮। জয়দেব, গীতগোবিন্দম্।
৯। বিজয়গুপ্ত, মনসামঙ্গল।
১০। শ্রীঈশানচন্দ্র ঘোষ অনূদীত ‘জাতক’, করুণা প্রকাশনী (১৩৮৫)।
১১। ‘The Lost World’, Sunday (07 July 2013) The Pioneer [https://www.dailypioneer.com/2013/sunday-edition/the-lost-world.html]; purulia.nic.in [http://www.purulia.nic.in/distAdmin/departments/dico/bhasa_andolon.html]; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একাধিক লেখায় বিহারপ্রদেশের সেই বিদ্বেষমূলক পটভূমির উল্লেখ আছে, যেমন ‘বিষের ধোঁয়া’ বা ‘বহ্নি-পতঙ্গ’।
-------
লেখক অধ্যায়ী-গবেষক।

Post a Comment

1 Comments

  1. রবীন্দ্রনাথের গানের শব্দ পালটে দেওয়ার কুকর্মটি এড়িয়ে গেলেন কেন?

    ReplyDelete