মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯৫
মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বাধীনতা সংগ্রামী, মেদিনীপুর)
ভাস্করব্রত পতি
মেদিনীপুর শহরের পাহাড়ীপুরে ১৯১৫ সালের ২৭ শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন শহীদ বিপ্লবী মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। বাবা ছিলেন বেণীমাধব দত্ত। মেদিনীপুর টাউন স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। মেদিনীপুরে পরপর তিন জেলাশাসককে হত্যা করেছিল যে বিপ্লবীরা তাঁদের মধ্যে একজন এই মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৩১ এর ৭ ই এপ্রিল জেমস পেডী, ১৯৩২ এর ৩০ শে এপ্রিল ডগলাস এবং সবশেষে হত্যা করা হয় বি ই বার্জকে। এই বার্জ হত্যায় সামিল হয়ে বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছিলেন অনাথবন্ধু পাঁজা এবং মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত।
প্রথমে বার্জ হত্যার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত এবং শান্তি সেনের ওপর। ১৯৩৩ এর ১২ ই আগস্ট একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে বার্জকে হত্যার জন্য এঁদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় অনাথবন্ধু পাঁজা কে। কিন্তু মিশন ব্যার্থ হয়ে যায়। এরপর ১৯ শে আগস্টের মেদিনীপুর সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে বন্যাত্রাণ সমিতির মিটিংয়েও বার্জকে হত্যা করা সম্ভব হয়নি। সবশেষে ১৯৩৩ এর ২ রা সেপ্টেম্বর তেঁতুলতলা মাঠে পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ডে টাউন ক্লাবের সঙ্গে স্থানীয় মহম্মদীয়া ক্লাবের ফুটবল মাঠে বার্জ টাউন ক্লাবের হয়ে খেলবেন বলে জানা গেল। সেদিন ঠিক হল বার্জকে হত্যা করা হবে। শান্তি সেনকে কলকাতায় ফিরিয়ে কেবলমাত্র দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিকেল সোয়া পাঁচটায় বার্জ এলেন মাঠের পূর্ব দিকে। ইতিমধ্যে এসে গিয়েছেন স্মিথ, লিন্টন এবং জোন্স। মোটরগাড়ি থেকে নেমে বার্জ মাঠে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমদিকের গোলপোষ্ট থেকে মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অনাথবন্ধু পাঁজা বার্জের মুখোমুখি এসে একজন উত্তর দিকে অন্যজন পশ্চিম দিক থেকে গুলি চালালেন। প্রথমে অনাথবন্ধু এবং পরে মৃগেন্দ্রনাথ। অনাথবন্ধু বার্জকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন যাতে বার্জ ছিটকে যেতে না পারে। ঘটনাস্থলেই বার্জের মৃত্যু হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জোন্স বিপ্লবীদের দিকে রিভলবার তুলে আসতেই পাল্টা খোঁড়া হয়ে আহত হলেন তিনি। তখন বার্জের দেহরক্ষী মৃগেন্দ্রনাথকে গুলি করে। আর রিজার্ভ ইন্সপেক্টর স্মিথ গুলি চালায় অনাথবন্ধু পাঁজাকে। ব্রিটিশের গুলির পাশাপাশি অনাথবন্ধু নিজেও গুলি করেন নিজেকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। আর গুরুতর আহত হয় মৃগেন্দ্রনাথ দত্ত। মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে পরদিন ৩ রা সেপ্টেম্বর সকাল ৮.৩০ এ তাঁর মৃত্যু হয়। সেদিন বার্জের দেহে মোট তাঁরা মোট ৬ টি গুলি বিদ্ধ করে।
এই হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ধরা পড়লেন -- কামাখ্যা ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ, সুকুমার সেনগুপ্ত, শৈলেনচন্দ্র ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, ফনীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সরোজরঞ্জন দাস কানুনগো এবং শান্তিগোপাল সেন। ১৯৩৪ এর ১০ ই ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ট্রাইব্যুনালের রায় বোরোলো। তাতে রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় সুকুমার সেনগুপ্ত, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ এবং কামাখ্যা ঘোষের। বাকিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। মেদিনীপুরের মানুষ কিন্তু ভোলেনি জেলার এই অকুতোভয় বীর সন্তানকে।
🍂
0 Comments