জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক অধ্যাপক হুমায়ূন কবির /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক অধ্যাপক হুমায়ূন কবির

নির্মল বর্মন 

অধ্যাপক হুমায়ূন কবির  সাহেবের প্রকৃত নাম হুমায়ূন জাহিরউদ্দিন আমির-ই কবি, সাহিত্যিক, সমালোচক ও দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও ভারতের বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা করেছিলেন। প্রথমসারির ছাত্র হিসেবে বহুপদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোমর পুরে ১৯০৬ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারি জন্মগ্ৰহন করেন। মৃত্যু ১৯৬৯।
হুমায়ূন কবির ১৯৩১সালে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম অক্সফোর্ডের বিখ্যাত  "মডার্ন গ্রেট্‌স" পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন । কবির সাহেব প্রথম এশিয় যিনি 'অক্সফোর্ড হার্বাট স্পেন্সারে সর্বপ্রথম বক্তৃতা' দিয়েছিলেন ও  'প্রথম এশিয়া সাহিত্য সম্মেলন' এবং 'প্রথম  এশিয়া ইতিহাস সম্মেলনে'  সভাপতিত্ব'র আসন অলংকৃত করেন । ভারত সরকারের মূলস্তম্ভ শিক্ষা উপদেষ্টা,সেন্ট্রালমন্ত্রী, রাজ্যসভার সদস্য ইত্যাদি পদেও অভিষিক্ত ছিলেন। হুমায়ূন সাহেব 'চতুরঙ্গ' নামক ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক হুমায়ূন সাহেব  ''নবযুগ'' ,''কৃষক''ও  ''নয়াবাংলা'' পত্রিকা'র সঙ্গেও ওতোপ্রোত বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।
        প্রাবন্ধিক শিক্ষাবিদ হুমায়ূন কবির বাবু'র প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থগুলি :- 
   "স্বপ্নসাধ", (১৯২৮), "'ইমানুয়েল কান্ট'' (১৯৩৯), ''বাঙলার কাব্য'' (১৯৪২), " নদী ও নারী"(১৯৪৫), ''মার্কসবাদ'' (১৯৪৮), ''শিক্ষক ও শিক্ষার্থী'' (১৯৫৭), ''শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব'' (১৯৫৮), ," সিরাজ আবু তালিব খান"(১৯৬১), ''দিল্লী ওয়াশিংটন মস্কো'' (১৯৬৪)।
অধ্যাপক হুমায়ূন কবির ইংরেজি গ্ৰন্থ :-
      "Kant on philosophy in German"(১৯৬৫), "Poetry monad and society"(১৯৪১), "Muslim politics in Bengal"(১৯৪৩) ,"Rabindranath Tagore"(১৯৪৫), "Man and Rivers" (১৯৪৫),The Indian Heritage (১৯৪৬),"Science Democracy and Island"(১৯৫৫), "Education in India(১৯৫৬), Studies in Bengali poetry(১৯৬৪), The Bengali Novels (১৯৬৮),"Education for Tomorrow"(১৯৬৮), "Minorities in Democracy" (১৯৬৯).
প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক হুমায়ূনের ''ইমানুয়েল কান্ট''(১৯৪৮) গুরুত্বপূর্ণগ্রন্থে 'কান্টী'য় দর্শনের ব্যবহারিক দিক ও উপলব্ধিগত দিক' যত্নসহকারে  সমাদৃত ও আলোচিত। পুস্তক আকারে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই ''পরিচয়'' পত্রিকায় এই পুস্তকের প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হয়েছিল।
      সাহিত্যিক হুমায়ূন সাহেব ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বাংলা কাব্য ও কবিতার স্বরূপ সঙ্গে প্রকৃতি আলোচনা ''বাঙলার কাব্য''  গ্ৰন্থে স্থানলাভ করেছে।
প্রাবন্ধিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসকে পাথেয় করে 'বাঙালির প্রকৃত মানসিক সত্তা'কে আবিষ্কার করার অসাধারণ সফল চেষ্টা করেছেন । হুমায়ূন কবির "ভারতীয় সংস্কৃতি যে হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সংস্কৃতি"মূলতঃ তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন । মোঘল পাঠান শাসনে ইসলাম ও হিন্দু সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার হয়েছিল সেদিকের প্রতি গভীর আলোকপাত করেছেন কবির সাহেব। প্রাবন্ধিক ছয়টি অধ্যায়ে  'উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মুসলমান সমাজের চিত্তবৃত্তির অন্তরঙ্গ ' পরিচয় যত্নসহকারে প্রকাশ করেছেন ।
🍂

হুমায়ূন সাহেব রচিত''মার্কসবাদ'' গ্রন্থটি 'মার্কসীয় তত্ত্ব ও প্রয়োগ' ভাবনার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। অপরদিকে ''শিক্ষক ও শিক্ষার্থী'' পুস্তকটি শিক্ষানুরাগী শিক্ষাবিদ কবির সাহেবের শিক্ষাভাবনায় সমৃদ্ধ। বস্তুতঃ শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, হতাশা,আদর্শচ্যুতি ও  পদ্ধতিগত ত্রুটিবিচ্যুতি ইত্যাদি আলোচ্য গ্রন্থে যুক্তির ইন্দ্রজাল বিন্যস্ত ।
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে বাংলার জাতীয় লেখকের মর্যাদায়  ভূষিত করেছেন ।শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব ও মূলসূত্রকে সংক্ষিপ্তা ভাবনায় ''শরৎ সাহিত্যের মূলতত্ত্ব'' গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে। ফলতঃ শরৎচন্দ্রের বাংলার মানুষদের জন্য নতুন করে 'বাংলাদেশ'কে আবিষ্কার করে‌ নতুন পথে দিশা দেখিয়েছেন। সে দিকটি অসাধারণ দক্ষতায় প্রতিপাদ্য গ্রন্থে উপস্থাপিত ।
মহামহিম প্রাবন্ধিক  হুমায়ূন "চতুরঙ্গ' নামক' পত্রিকায় (আশ্বিন-১৩৫০) প্রকাশিতব্য ''ভারতবর্ষ ও সমাজতন্ত্রবাদ'' নামাঙ্কিত প্রবন্ধটিতে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি'র পরিচায়ক বহন করে। হুমায়ূন সাহেবের প্রবন্ধটি যুক্তিনিষ্ঠ শৃঙ্খলায় ও তথ্যের সমাহারে বিষয়টি সুখপাঠ্য। এই প্রবন্ধে আলোচিত বিষয়টিকে দৃষ্টান্তস্বরূপ  গ্রহণযোগ্য:-
        ১. "সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে সমস্ত পৃথিবী সংগঠিত না হলে যে মানুষের কল্যাণের কোনও সম্ভাবনা নাই, এ বিষয়ে বর্তমানে চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বোধ হয় সকলেই একমত।"
২."যতদিন মানুষ মানুষকে শোষণ করবে, ততদিন আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাতিক শোষণের শেষ নেই। যতদিন মানুষ মানুষকে দাস করে রাখবে, ততদিন মানুষের দুঃখ ও দৈন্যের অবসান হতে পারে না।"
৩."ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধান করে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন, "অনেকেই ভাবেন যে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এশিয়া বুঝি স্থান পায় না-তাঁরা ভুলে যান যে ইউরোপের নেতৃত্ব অত্যন্ত সাম্প্রতিক।"
৪. "দার্শনিক প্রত্যয় ও বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে লিখেছেন "প্রতি দেশেই আমরা দেখি যে একদিকে বিলাসের প্রাচুর্য ও প্লাবন এবং অন্যদিকে অভাব যন্ত্রণার নিদারুণ নিপীড়ন। সমাজের এ অসুস্থ অবস্থায় সমাজে শান্তি থাকতে পারে না, এবং সমাজের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত অশান্তি, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘর্ষে তাই আত্মপ্রকাশ করে"।
৫."সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বরূপ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক লিখেছেন, "সাম্রাজ্য অধিকার নিয়েই বিপ্লবী ফরাসীর সঙ্গে ইংরেজের সংঘর্ষ। সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্যই ইংরাজের সঙ্গে গত শতকে রুশ দেশের এবং বর্তমান শতকে জার্মানির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত। সেই সাম্রাজ্যের লোভেই আফ্রিকা ভাগাভাগি নিয়ে ইউরোপীয় শক্তিদের নির্লজ্জ ও উলঙ্গ কলহ।"
৬. "সমকালীন পৃথিবীর দুরবস্থার কারণ হিসেবে তাই তিনি 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফার লোভ'-কে দায়ী করেছেন এবং তা যথার্থ"।
৭. "প্রবন্ধের উপসংহারে ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির কামনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, "স্বাধীন ভারতবর্ষ তাই কেবলমাত্র ভারতবাসীর জন্য নয়, বরং সমস্ত পৃথিবীর কৃষক শ্রমিকের মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয়।...ভারতবর্ষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্থিতি, ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন-এই সমস্ত বিষয়ে বিবেচনা করে বর্তমান পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় করতে হবে, কারণ সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন ভারতবর্ষই হবে ভবিষ্যৎ বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ভিত্তি।"
বস্তুতঃ প্রাবন্ধিকের সেই আশা আজও অপূর্ণ থাকলেও তাঁর যুক্তনিষ্ঠ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা এখনো হারায়নি , ভবিষ্যতে নাও হারাতে পারে। করিম সাহেবের বক্তব্যের স্বচ্ছ 'দৃষ্টিভঙ্গি', 'ঋজুতা' ও  যুক্তিনিষ্ঠতা এবং সর্বোপরি ভাষারীতির একনিষ্ঠ বলিষ্ঠতা প্রবন্ধগুলিকে  মান্যতা দিলেও কালের অমোঘ নিয়মে আজ তা বিস্মৃতপ্রায় ।

Post a Comment

0 Comments