প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
নবম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
‘মহাদেবের চরণে সেবা লাগে, হর হর মহাদেব’…ভক্তারা এসে দৈবী বাঁশ ঠেকালে চক্রবর্তী বাড়ির চালে।
সারাটা বছর জুড়ে দূর্গা, কালী, মনসা, শীতলা অথবা ষষ্টীমায়ের পুজো-পার্বণ চললেও পাড়া গাঁয়ে চোইত মাসের এ সময়টা একান্তই শিবের। গাঁয়ে গাঁয়ে চড়ক, হিঁদোলা, গাজনের আয়োজন,সকাল হলেই ভক্ত দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে পূজার রসদ সংগ্রহে ঠাকুরের নমস্কারী পতাকা লাগানো বাঁশ ঠেকিয়ে প্রণামী জোগাড়ে ঘুরে চলে, ওরা বাড়িতে এলে গৃহস্থের কল্যাণ হয়, এমনটাই ছোট্ট থেকে জেনে এসেছেন বিরজাসুন্দরী।
আজও যেন তাদের ডাকাডাকি শুনেই ঘুমের অতল থেকে জেগে উঠলেন, জ্ঞানে ফিরলেন অসুস্থ বৃদ্ধা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত বেভুল শরীরের মধ্যে জেগে উঠলো কবেকার শিশু প্রাণ;চোখের সামনে সেদিনকার শৈশব…
-’এমা! চারিদিক তো রোদে রোদাক্কার। কেউ ডাকেনি আমাকে?’
বিছানা ছেড়ে একদৌড়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো সে।
এখনও বছর শেষ হয়নি;তবু বাতাসে বেশ তাপ, এই সকাল বেলাতেই, গালে এসে সপাটে ঝাপট মারছে মাঠপারের শুকনো হাওয়া।
কয়েকদিন হলো কলকাতা থেকে বাপের বাড়ি ফিরেছে বিরজা, সবাই কত্তো কত্তো আদর করছে, কিন্তু কেন কে জানে, ভালো লাগছে না, কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।
অথচ আসার আগে, কতো কি ভেবে রেখেছিলো,ছিপ দিয়ে মাছ ধরবে সারা দুপুর; আমকুশি জারিয়ে খাবে নুন লঙ্কা দিয়ে,কলের পুতুল,বরের এনে দেওয়া রঙিন বই, সেমিজ এইসব দেখাবে সইদের ডেকে… কিন্তু এসে ইস্তক কিচ্ছু ভালো লাগছে না।পুকুরঘাটে বসেও ও বাড়ির কুয়োতলার কথা ভাবছে, কলের পুতুল, সেমিজ দেখাতে গিয়ে মায়ের কথা ভাবছে, জ্যাঠাইমার আঁচলে ঘাম আর ময়লায় মেশা বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছে, মায়ের গায়ে কি সুন্দর গন্ধ আতরের!...
বিকেলবেলা ঘানিপেষা নারকেল তেল মাখিয়ে চুল বাঁধতে বসে জবাকুসুমের গন্ধ নেই বলে মুখ ভার হচ্ছে, ইতিমধ্যেই বৌদিদি একদিন ‘বড়োলোকের বৌ’ বলে ঠাট্টা করেছে…ফেলে যাওয়া এই বাড়িটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে ছোট্টো মেয়েটার। বিশেষত গভীর রাতে জানলা পারের চাঁদ যখন গুটিসুটি বিছানায় এসে পড়ে, অথবা দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার শেষে যখন সবাই আলসে ভাঙতে খানিক ঘুমিয়ে পড়ে, দাওয়া পারের শীরিষ গাছ বেয়ে চৈতালী বাতাস ঝরঝর বয়ে যায়, বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগে। এবাড়িটাকে আর নিজের বাড়ি মনে হয়না। কয়দিন আগে পাওয়া বড় বড় জানলা, খিড়খিড়ি, লম্বা বারান্দা,মায়ের আদর, ঘুমোবার সময় হাতপাখা টানা মায়ের নরম বিছানাটাই বরং বেশী নিজের বলে মনে হয়।
তারমধ্যে গতকাল একটা বিদিকিচ্ছিরি কান্ড করে ফেলেছে সে। চান করে সিঁদুর পরতে গিয়ে সিঁদুর কৌটোটা মাটিতে পড়ে সারা দাওয়ায়,শাড়িতে,পায়ে ছড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হায়হায় করে বকাবকি করতে শুরু করলো, এমনকি জ্যাঠাইমাও।
বিরজার খুব মনে পড়ছিলো, ফর্সা, সুন্দর শাড়ি পরা মায়ের হাসিমুখ।ও বাড়িতে এমনটা করলে মা ওকে কিচ্ছুটি বলতো না,ও জানে।
অথচ এখানে সবাই ওকে জোর করে শিবের থানে নিয়ে গিয়ে মানসিক করিয়ে এলো, সারাদিন উপোস করালো।রাতে জ্যাঠাইমাও পাশে শুইয়ে বললো,
অমন করলে নাকি স্বামীর অমঙ্গল হয়।
বিরজা কিছুতেই বুঝতে পারছিলো না,সামান্য একটু সিঁদুর পড়ে গেছে বলে একটা গোটা ছেলের ক্ষতি হবে কেন? ওতো এই কয়দিন সিঁদুর পরছে, তাহলে, তার আগে কি হতো! ঐ তো এক গম্ভীর রাসভারী ছেলে! কথা বলে না,হাসে না…. বিরজার ভারী বয়েই গেছে ঐ ছেলের কথা ভাবতে,তার জন্য সিঁদুর পরতে, তার জন্য উপোষ করতে! হুঃ!
🍂
তারপরে অবশ্য শুয়ে শুয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলো, হোক না গোঁবড়ামুখো; পন্ডিত বর তো তার! দাদারাও সমীহ করে তাকে, তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। আজ নাহয় আরও একবার তার নামে মানত করে দেবে বিরজা!
এই সব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলো বিরজা,মনে নেই। জ্যাঠাইমা কখন উঠে গেছে, ডাকেনি তাকে।
আসলে, আগে জ্যাঠাইমার সঙ্গে উঠে দাওয়ায় ঝাঁটা দেওয়ার কাজ ছিলো তার। তারপর হাতপা ধুয়ে,গুড়মুড়ি খেয়ে পড়তে বসতো মেয়ে।
এবার এসে অবধি কোন কাজ করতে দেয়নি কেউ, বকাবকিও করেনি একবারও। ওও মহানন্দে পাড়া বেড়িয়ে গেছে, সইদের সঙ্গে হুটোপুটি করেছে,যা খুশি, তাই করেছে। শুধু গতকাল সিঁদুর ফেলার পরেই যা একটু বকাবকি করেছিলো সবাই মিলে।
সে কথা মনে পড়তেই আবার কেমন একটা খারাপ লাগা, নাকি দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিলো ছোট্টো মেয়েটির মনে।
সকাল বেলায় এসে দাঁড়ানো ভক্তাদলের দিকে তাকিয়ে আনমনে সে এসবই ভাবছিলো, এমন সময় তাদের দলের হরিকাকা এসে মাথায় হাত রাখলে,
-’কেমন আছিস, তারা? সউরঘর ভালো হইছে তো?’
মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়লো মেয়ে, মনে পড়লো, তার বিয়ের কয়েকদিন আগেই হরিকাকার মেয়ে মিনু সাপের কামড়ে মারা গিয়েছিলো, ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো বটে,কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
এলোপ্যাথিক চিকিৎসার কোন সুযোগই পাওয়া যায়নি।
কারণ,তখনও দেশে ঘরে চিকিৎসা বা শিক্ষায় সরকারী পরিসেবা পাওয়া যেত না, সে ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি।
সুতরাং, আধুনিক চিকিৎসা ও শিক্ষাবঞ্চিত বৃহত্তর দেশবাসীর ভরসা তখনও ছিলো ওঝা বা দেবতার থান। দেবদ্বিজে তাই অচলা ভক্তি ছিলো সাধারণ মানুষের।
যদিও জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বিরাজ বুঝেছেন, এসব ঠাকুর দেবতা ব্রত উপবাসে কিছুই হয়না, অলৌকিক কোন শক্তি কখনও কারো মঙ্গল বা অমঙ্গল ডেকে আনতেও পারেনা, আশ্রয় তো নয়ই। নিজেকেই হতে হয় নিজের নির্ভর। তবু বিষন্নতা, একাকীত্ব যখন ছেয়ে যায় জীবনে, কোন একটা ধরতাই লাঠি তো লাগে। উপায়হীন মানুষের সে লাঠির নামই ঠাকুর। তাঁর নামে ঘর পরিস্কার হয়,শুদ্ধাচারে ভোগ রান্না, আল্পনা আঁকা হয়, পুজোপাব্বন চলে, নিরানন্দ গতানুগতিক জীবনে খানিক জোয়ার ওঠে।
তাই বিশ্বাসে অথবা অবিশ্বাসে নাস্তিক মানুষও এসব মেনে নেন, চিরায়ত আনন্দ গানে বয়ে যায় সাধারণ মানুষের অসাধারণ যাপন যাত্রা…
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments