ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কবিতায় জগৎ পরিভ্রমণ ও কাব্য মীমাংসার রূপ ও স্বরূপ
দিলীপ মহান্তী
ঋত্বিক ত্রিপাঠীর নতুন কবিতার বইয়ের নাম: কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা। নামকরণের মাধ্যমেই তিনি বুঝিয়ে দেন যে তিনি তাঁর গূঢ় গোপন বক্তব্য খুব সোজাসুজি বলতে চান না। তাঁর বলার কথাগুলি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে তিনি এক নিজস্ব স্বর , এক নিজস্ব কাব্য ভাষা খুঁজে পেতে সচেষ্ট। আভাসে ইঙ্গিতে চিহ্নে প্রতীকে তিনি ফুটিয়ে তুলতে চান আপন কাব্যের জগৎ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মীমাংসা বা আলোকপাত করতে চান এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ও কাব্য জগতের কয়েকটি তত্ত্বের এবং পরিভাষার। বিশেষ করে সেই ধ্বনি, রীতি, অলংকার, রস ও কাব্যের অলৌকিক মায়ার জগতের।
গ্রন্থ নামের সূত্রেই আমরা পৌঁছে যাই প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতাতে। যেখানে এই কীলক লিপির ব্যবহার ছিল। এই লিপির আকৃতি ছোট্ট তীরের মতো হওয়ার কারণে একে কীলক লিপি বলা হত। সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ জন পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার পীঠস্থান মেসোপটেমিয়ায় এসে কীলক লিপিকে জনপ্রিয় করেছিলেন। এই লিপি বিশ্বের প্রাচীন লিপিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আনুমানিক ৩২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এই লিপি ব্যবহৃত হত। এটি বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রের সমন্বয়ে লেখার পদ্ধতি। প্রথম দিকে এটি চিত্রলিপি থাকলেও পরবর্তী কালে ক্রমে ক্রমে ভাষালিপি ও ধ্বনিলিপিতে পরিবর্তিত হয়। হামুরাবির আইন এই কীলক লিপিতেই লেখা হয়েছিল।
বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন ও চিত্রের সমন্বয়ে লেখার এই পদ্ধতিটি ঋত্বিক সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে। নামের ব্যবহার ব্যঞ্জনাধর্মী। তিনি তো সত্যি সত্যি কীলক লিপিতে লিখেছেন না কিন্তু তিনিও সংকেতের সাহায্যে, চিহ্নের সাহায্যে, আভাসে ইঙ্গিতে প্রতীকে এই বিশ্ব রহস্যকে ধরার চেষ্টা করছেন। তিনি কীলক লিপিতে বলতে চাইছেন ভূমি ও ভূমার কথা। অর্থাৎ এই পৃথিবীর কথা ও তার বহুত্বের কথা। প্রকৃতি ও পুরুষের কথা। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবলম্বন শব্দ। শব্দ তার আভিধানিক অর্থ অতিক্রম করে কোন বিশেষ রহস্য বা ব্যঞ্জনা নিয়ে আসছে তা জানার জন্য এই গ্রন্থ পাঠ জরুরি।
এই গ্রন্থ পাঠ আসলে এক আশ্চর্য ভ্রমণ। এই বিশ্বজগৎ পরিভ্রমণ। কখনো মহাবিশ্বের কখনো প্রাচীন কাব্য ও অলংকারের জগতে পরিভ্রমণে উঠে এসেছে জগতের বিচিত্র বিষয় ও রহস্য এবং তা প্রকাশের উপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ। যেমন আছে গ্রহ, গ্রহাণু, নক্ষত্র, উপগ্রহ, চন্দ্র, সূর্য, অক্ষরেখা, দ্রাঘিমারেখা, কক্ষপথ, সৌরকণা, ব্রহ্মান্ড, বিশ্ব, রামধনু, ব্ল্যাকহোল প্রভৃতি শব্দ। তেমনি আছে পদার্থের পিন্ড, মাধ্যাকর্ষণ, সরণ, অভিকর্ষ, প্রতিসরাঙ্ক অন্যদিকে বিভিন্ন জ্যামিতিক গাণিতিক পারিভাষিক শব্দ ও চিহ্ন যেমন সরলরেখা, বিন্দু, ত্রিভুজ, বৃত্ত, কেন্দ্র, সমকোণ, লম্ব, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, একক, দশক প্রভৃতি। জ্যামিতির পারিভাষিক শব্দ ও চিহ্নগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শাস্ত্রে বিভিন্ন ধর্মে প্রয়োগ আলাদা আলাদা। ব্যঞ্জনা আলাদা। ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত আলো ছড়ায়।
গ্রন্থের বর্ণময় ভুবনে উঠে এসেছে কাব্য ও অলংকার তত্ত্বের বিভিন্ন প্রস্থান ও পারিভাষিক শব্দ—ধ্বনি, রস, কাব্যের আত্মা, অলংকার, অভিধা, লক্ষণা, ব্যঞ্জনা, উপমা, উপমান, উপমেয়, অনুপ্রাস, সমাসোক্তি, শ্লেষ, ব্যাজস্তুতি, দ্বিরুক্তি প্রভৃতি। আছে আলংকারিক নায়িকার বিভিন্ন অবস্থার কথা ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের কিছু তত্ত্ব ও পারিভাষিক শব্দও: পূর্বরাগ, অনুরাগ, মিলন, বিরহ, অভিমান, অভিসার, প্রার্থনা, মাথুর, রাধাবিরহ, লীলা, সাধ্যসাধন, প্রেমবিলাসবিবর্ত প্রভৃতি। উঠে এসেছে রামায়ণ মহাভারতও। রাম, রাবণ, সীতা, চন্দ্রাবতী, ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা, নিরস্ত্র সৈন্য প্রভৃতি প্রসঙ্গ।
এছাড়াও আছে সাহিত্য প্রকরণ বিষয়ক শব্দ। যেমন — গদ্য, শ্লোক, স্ত্রোত্র, পালাগান, চিত্রনাট্য, নাট্য অঙ্ক, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রভৃতি। বিভিন্ন যতি চিহ্ন: কমা, পূর্ণচ্ছেদ, সেমিকোলন, বিরতি চিহ্ন প্রভৃতি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রসঙ্গ তা হল এই গ্রন্থে কবি ব্যাকরণ ও ভাষাবিজ্ঞানের অনেক জটিল ও আগ্রহ জাগানো আবর্তে প্রবেশ করেছেন। বিশেষ্য, বিশেষণ, সমাস যেমন আছে তেমনই ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, বর্ণনামূলক ও রূপান্তরমূলক ভাষাবিজ্ঞান, সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান ও উত্তর সাংগঠনিক মতবাদ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। জোর দিয়েছেন বাক্য গঠনের ওপর। ধ্বনিবাদ থেকে পৌঁছাতে চাইছেন পদগুচ্ছের সংগঠন রীতিতে। ধ্বন্যালোক থেকে সিনট্যাকটিক স্ট্রাকচারে। মগ্ন গঠন ও প্রাতিভাসিক গঠনে। প্রচলিত ধারণাগুলোর বিনির্মাণ করতে চাইছেন। বাক্য গঠনরীতির প্রাধান্যের কারণেই তাঁর কবিতায় আনন্দবর্ধন ও চমস্কি একই পংক্তিতে এসে যাচ্ছেন:
চমস্কি জানে দ্বন্দ্ব পরিণাম অন্যদিকে আনন্দবর্ধন
ধ্বনি না রস কোনটি হবে কাব্যের আত্মা!
অবয়ব সংস্থানও চাই নির্দোষ, মসৃণ ত্বকেই মগ্ন গঠন ও প্রতিভাস
ধর্মান্তর হওয়ার আগে বদলে যায় ব্যঙ্গ, অলংকার...(বিস্ময় চিহ্ন)
শুধু আনন্দবর্ধন ও চমস্কি নন আরও আছেন হকিং, জয়দেব, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, লিন্ডেম্যান প্রমুখ ব্যক্তি ও তাঁদের বিরাট কর্মময় জগৎ। এ যেন নিছক কবিতা গ্রন্থ নয় এত পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ ও ঘনঘটায় এ এক ভিন্নধর্মী কোষগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। সব শব্দ যে সোজাসুজি তার আভিধানিক অর্থ নিয়ে এসেছে তা নয় বরং উল্টো হয়েছে। শব্দের প্রয়োগ ও মুন্সীয়ানায় বার বার অভিধা লক্ষণা ব্যঞ্জনার প্রসঙ্গ এসেছে। কবিতার ভাষা যথেষ্ট পরিমার্জিত। প্রতি মুহূর্তে মনে হয় সাধারণ পাঠকের জন্য এই গ্রন্থ লেখা হয়নি। দীক্ষিত পাঠকও ধাক্কা খেতে পারেন। এভাবেই তিনি বাস্তব পৃথিবীর কথা মাটির কথা বলেন। পৌঁছাতে চান বিশ্বরহস্যে জীবন রহস্যে আর ব্রহ্ম সম্পর্কে পরম জ্ঞানে:
যেদিকে তাকাই, দেখি আলোয় আলো হয়ে আছে
ছোট বড় পুঞ্জ, গ্রহাণুর মতো তারা স্বাধীন, সপ্রতিভ
সরলরেখা দিয়ে যোগ করি একে অন্যকে, সারা রাত
সংখ্যাতীত আলো। সরলরেখাও ফুরোয় না...( আশ্চর্য নততল)
সেই বিশ্বরহস্যকে উদ্ঘাটিত করতে যারা সক্ষম সেই কবি ও মহাকবির প্রসঙ্গে তিনি নিজস্ব উপলব্ধির প্রকাশ ঘটান। ঋষির মতো একাগ্রতায় মীমাংসা করতে চান কাব্যতত্ত্বের:
তিনিই কবি যাঁর কবিতায় তিনি অন্তত একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিজের দেশের সীমা এড়িয়ে সমগ্ৰ পৃথিবীর নামে জয়ধ্বনি করেন। পৃথিবীর শুশ্রূষার জন্য ব্যাকুল হন। এই আওয়াজ তুললে কোনও না কোনও রাষ্ট্র ভুল বুঝতেই পারে। উন্মুখ হয়ে উঠতে পারে ফাঁসি কাঠ। সেই রাষ্ট্রকে তিনি পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখেন না - তিনি কবির কবি। আর সেই রাষ্ট্রকে যিনি ক্ষমা করেন ও আমাদের ছেড়ে যাবার আগে ফের কবিতা লেখার কথা বলে যান, তিনিই মহাকবি।
খালি পায়ে অচেনা তিনজন দাঁড়িয়ে এক নদীর বাঁকে, পাড়ে। তাঁদের থেকে সামান্য দূরে ব- দ্বীপ, নিস্পাপ। প্রথমজন বললেন: নদী বাঁক ও ব- দ্বীপ পরিপূরক। দ্বিতীয় জনের বক্তব্য: দ্বীপে জেগে উঠছে প্রাণ। তৃতীয় জনের উচ্চারণ: প্রাণ প্রাণকে চিনে নিচ্ছে। এই হল অভিধা লক্ষণা ব্যঞ্জনার এক জীবন উপাখ্যান। (মহাকবির ব্যঞ্জনা)
এক দার্শনিক প্রজ্ঞায় ও ভাষায় ঋত্বিক কবি, কবির কবি ও মহাকবির সংজ্ঞা নির্ণয় করেন। সেই দর্শন আশ্চর্য সুন্দর কবিতাও হয়ে ওঠে। একটি উদাহরণের সাহায্যে অভিধা লক্ষণা ও ব্যঞ্জনাকে স্পষ্ট করেন এবং বলেন: মহাকবিই আবিষ্কার করেন ব্যঞ্জনার পথ।
এই গ্রন্থে কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী শব্দ প্রয়োগে ও ভাষ্য নির্মাণে বার বার জোর দিয়েছেন অভিধা লক্ষণা ও ব্যঞ্জনার ওপর। অভিধা হল শব্দের সেই প্রথম শক্তি, যার দ্বারা মুখ্যার্থের জ্ঞান হয়। লক্ষণা শব্দের আর এক শক্তি বা বৃত্তি বিশেষ। মুখ্যার্থের বাধা ঘটলে যে শক্তি দ্বারা মুখ্যার্থের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত অন্য অর্থ স্পষ্ট হয় তা হল লক্ষণা। আর ব্যঞ্জনা হল কাব্যের নিগূঢ়ার্থ প্রকাশক শক্তি বা বৃত্তি বিশেষ। কোনো শব্দ উচ্চারিত হলে যদি অভিধা ও লক্ষণা শক্তির সাহায্যে বক্তার অভিপ্রায় পরিস্ফুট না হয়, তখন অর্থ বোধের জন্য অন্য যে শক্তির সাহায্য খুবই আবশ্যক হয় তা হল ব্যঞ্জনা শক্তি।
এই অভিধা লক্ষণা ও ব্যঞ্জনার সাহায্যেই কবি এক জীবন উপাখ্যান রচনা করতে চেয়েছেন। আর সেই জীবন উপাখ্যান রচনা করতে গিয়ে আত্মজ্ঞানের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করেছেন।
এবার আমরা আলোচ্য গ্রন্থের 'অভিজাত ডুবোজাহাজ' কবিতার কাছে যাই:
ভাষা নির্জনতার নামে কক্ষমানত, তথ্যসূত্র ভান্ডার
কক্ষের নামে স্বস্তি শুশ্রূষা, স্বমহিম পুরুষ প্রকৃতি
.............
অভিজাত ডুবোজাহাজে শুদ্ধ হয় ক্ষত, দ্বীপ ও ভূমি
লোভ ও জলবায়ু এড়িয়ে বৃত্তের কেন্দ্র থেকেই জেগে ওঠে
অপার্থিব নদী সহনীয় চাঁদ (অভিজাত ডুবোজাহাজ)
এই কবিতায় পরিস্ফুট হয় সৃষ্টি রহস্য। তা জীবের, কাব্যের, বিশ্বের সবকিছুরই হতে পারে। সৃষ্টির মাধুর্য, যন্ত্রণা ও আনন্দ খুবই মার্জিত ভাবে আভাসে ইঙ্গিতে রূপকে সযত্নে নির্মিত হয়েছে। প্রকৃতি ও পুরুষের কথাই তো কবি বলতে চান এই গ্রন্থে। তার বহুত্বের কথা, তার ব্যাপকতার কথা। তার আসক্তি ও বিষাদের কথা।
যেহেতু তিনি বিশ্ব রহস্যের কথা ব্রহ্মান্ডের কথা কবিতায় বলতে চান তাই বারবার ঈশ্বরের প্রসঙ্গ আসে। কখনো আসে ঈশ্বর ও শয়তানের প্রসঙ্গ, কখনো ঈশ্বর অভিসার, কখনো ঊর্ণনাভের ঈশ্বর প্রভৃতির মাধ্যমে এক মায়াময় জগৎকে উপলব্ধি করেন। তাঁর আধ্যাত্মিকতা জুড়ে ঈশ্বর বা এক শক্তির প্রসঙ্গ আসে আবার কখনো তিনি অবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তৃতীয় নেত্রকে অস্বীকার করে স্টিফেন হকিং -এর জগৎকে বেশি স্পষ্ট করেন। মহাজাগতিক কথা, মহাকর্ষ, মহাবিশ্ব, সৃষ্টি তত্ত্ব, ব্ল্যাকহোল, বিকিরণ, সময় প্রভৃতি প্রসঙ্গ আসার সূত্রে খুব স্বাভাবিক ভাবে বিশ্ব তাত্ত্বিক হকিং - এর নাম এসেছে:
বিশেষ্য বিশেষণে ক্লান্ত পিঠে পিঠ লাগিয়ে গ্রহ - উপগ্রহ
হারিয়ে অন্য নক্ষত্রলোকে দাউ দাউ আগুন সর্বস্ব মহানন্দে
অপার্থিব অভিসার, জঙ্গলে দিগ্বিদিক হরিণ- হরিণী
এহো বাহ্য। উপমাহীন কৃষ্ণবিবরে লীন পাথরের শ্বাস
খন্ড- অখণ্ড নিয়ে সমাসবদ্ধ প্রবন্ধ লিখছেন হকিং
যেহেতু, পরবর্তী ভ্রমণ কাহিনি তৃতীয় নেত্র অনুযায়ী
নাও হতে পারে।
(মহাকাশ - উত্তর কথা)
আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি আধ্যাত্মিকতা থেকে সরে আসতে চাইছেন। ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে সরে এসে বিজ্ঞানের ওপর জোর দিতে চাইছেন। সেজন্য সৃষ্টি রহস্য বা সকল শক্তির উৎস রহস্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন থেকেও মহাকাশ - উত্তর কথাকে বিজ্ঞান নির্ভরতার সঙ্গী করছেন। আসলে তিনি আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন এক গভীর জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। এর শুরু ও শেষ কোথায়?
স্টিফেন হকিং-এর মনেও প্রশ্ন জেগেছিল যে, রাজনৈতিক সামাজিক ও পরিবেশগত ভাবে বিশৃঙ্খল এই পৃথিবীতে মানবজাতি কীভাবে আরও ১০০ বছর টিকে থাকবে? তিনি বলেছেন এর উত্তর তাঁরও জানা নেই। মানুষকেই এর উত্তর ভাবতে হবে। হকিং বিশ্বাস করেন মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য মহাশূন্যে ভ্রমণ ও মহাশূন্যে উপনিবেশ স্থাপন করা প্রয়োজন। হকিং নিজেকে নাস্তিক বললেও তাঁর ভাবনাতে ঈশ্বর উপস্থিত। তিনি মনে করেন পৃথিবী বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই চলে এবং এটা হতে পারে নিয়মগুলো ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন।
এই দেখার চোখ সবার থাকে না। প্রকৃত কবির থাকে। এক গূঢ় তত্ত্ব কথা থেকে আমরা পৌঁছে যাই আর এক তত্ত্ব কথায়:
ভক্তি যোগেই মধুর, নততল, স্মরণীয় সূক্ষ্মকোণ...
সাধ্যসাধন শেষে প্রেমবিলাসবিবর্ত, সমপ্রাণতা
ফের শূন্যতার আত্মবিলোপ ছায়ার পিরামিড
(পিরামিড/পিরামিড)
প্রান্ত দিয়েই ঘেরা আছে কেন্দ্র। প্রান্তিক মানুষরা ব্রাত্যজনরাই সমাজের মূল চালিকাশক্তি। এই দিকটিও যথেষ্ট আলোকিত হয়েছে একটি কবিতায়:
প্রান্তের খোঁজে কে দেবে বরাভয় সাযুজ্যে অধোগতি
উদ্ধারে সাধ্যাতীত জললিপি, মাঠ পেরোচ্ছে শুকুন মান্ডী
গ্রামের মধ্যে গ্রাম ঢুকে পড়ছে মাঠের বিপরীতে
সেখানেও এক পৃথিবী, আত্মীয়েরা সব অপেক্ষার বাউল
শেষ হবার নয়, এই হেঁটে যাওয়া উপাখ্যান দৌড়
ব্যঞ্জনার আদি নেই, নেই অন্ত, এক মাত্রার মাঠ দু' অক্ষরে
প্রান্তের খোঁজে জন্মান্তর, ফের অনিবার্য শালুক পাতার জল
শুকুন হাঁটছে, পাশে আমরাও সুখে অসুখে দ্বিধা হীন...
....
(মাঠ পেরোচ্ছে শুকুন মান্ডী)
কেন্দ্র ও প্রান্তের লড়াই সর্বক্ষেত্রে। রাজনীতি, সাহিত্য ও শিল্পের জগৎ সব জায়গায়। মানুষের মধ্যেও। তাই প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া। গ্রামকে মহিমান্বিত করা। গ্রামের ভেতর গ্রাম। গ্রাম পেরিয়ে মাঠ পেরিয়ে হাঁটা। সেই হাঁটা কি শহরের দিকে? কর্মমুখরতার দিকে? সভ্যতার সংকটের দিকে? বিশ্বরহস্যে সব কিছুই স্থান পায়। এই আরও আরওর চাহিদায় হেঁটে যাওয়ার রূপ শিল্পিত ভাষায় ফুটে উঠেছে।
এই কেন্দ্র ও প্রান্তের লড়াই, বৈপরীত্য পৌঁছে যায় গদ্য ও পদ্যের লড়াইয়ে, মিত্রতায়। গ্রাম জীবন, প্রান্তিক জীবন আলোকিত হয়:
ভয় ও সংকর ধানের হে প্রিয় গ্রাম
পিঠে পিঠ, দৌরাত্ম ও গ্লানি, অভিমানেই
ধ্বংস, অভিমানেই শত গদ্য পদ্যমুখী
আসলে বৈপরীত্যেই বন্ধুত্ব নিবিড়, আত্মশুদ্ধি...
পৃথিবীর তিনভাগের একভাগ স্থল।
স্থল হয়ে উঠছে শ্লোক —ঋত্বিকের কবিতায়। যার মধ্যে আছে অখণ্ড মিলিত অনুরাগ। সেই শ্লোক ভাগকে তিনি ভরিয়ে দিতে চাইছেন ভাষার এক নতুন আঙ্গিকে। অন্য বাংলা ভাষার আকাশে। যে ভাষায় পুরাণের কাহিনি উঠে আসছে আভাসে, ইঙ্গিতে। সীতা ও রাবণের প্রসঙ্গ, কর্ষণ ও আকর্ষণের ব্যঞ্জনা, কৃষি চেতনার রূপক। রাধাবিরহের অনন্ত স্রোতে কবি লিখেছেন সমাসবদ্ধ রোদনের গান:
১.
স্বনামধন্য সংসারেই থাকে নশ্বরতার প্রখর রোদ
এই তো চিরায়ুষ্মান গন্ডিরেখা, আত্মার প্রতীক সীতা
রাবণের প্রতিরূপে ঘুমিয়ে,স্বপ্নে ত্রিভুজ উপধ্বনি
চন্দ্রাবতী জানেন স্বগত শ্রুতি ও আধুনিক অনুষঙ্গ
কর্ষণ অযোগ্য জেনেও গড়ে ওঠে ভূমি ও ভূমা...
.......
(কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা)
পরিশেষে আবার ফিরে যাই এই আলোচনার গোড়ায়, সেই নামকরণে। কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমায় কবি অনেক আড়াল রেখেছেন। সোজাসুজি ভাবে এই দগ্ধ ও অবিশ্বাসী সময়কে প্রকাশ করতে হয়তো তাঁর অসুবিধা বা বিপদ আছে। কারণ তিনি জানেন: সময় চলে গিয়েছে আশ্চর্য চিতার আগুনে বা বাস্তুতন্ত্রের ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে চিল। পরিণাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে তিনি এক নিজস্ব কাব্য ভাষার সন্ধানে অবতীর্ণ। শেষ পর্যন্ত সেই নিজস্ব কথন রীতি তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর কবিতায় বারবার অভিধানের প্রসঙ্গ এসেছে। অভিধানের অর্থ শব্দকোষ হলেও অন্য একটি অর্থ আছে যা কথন বা কথনরীতিকে বোঝায়। সব কিছু নিয়েই সেই অসীমের দিকে যাত্রা:
বর্ণ করো বিশ্লেষ, অকাতর বাংলা ভাষার রীতি
গাছের ছায়ায় হাওয়ায় অলৌকিক নির্বাক রামধনু
ছড়িয়ে পড়ছে পরিত্রাহি প্রাণ, বৃষ্টি শেষে
অরূপ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ তারা, ব্রহ্মান্ড ও বিশ্ব...
শব্দ দিয়ে সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত রচনা করার এই বিপুল আয়োজন ব্যর্থ হত যদি না তা কবিতা হয়ে উঠত। এখানে শব্দ তার আভিধানিক অর্থ এবং অভিধা ও লক্ষণাকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে রসের নদী। প্লাবিত হয়েছে রসিক হৃদয়। আমরা মুখোমুখি হয়েছি এক বিপন্ন বিস্ময়ের। জ্বলে উঠেছে আলো। জন্ম হয়েছে কবিতার, শিল্পের।
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা
ঋত্বিক ত্রিপাঠী
সিগনেট প্রেস
প্রচ্ছদ দেবাশিস সাহা
২৫০টাকা
---------------
🍂
0 Comments