জ্বলদর্চি

গল্প /মেরুদণ্ডের জোর /মিলি ঘোষ

গল্প
চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ 

মেরুদণ্ডের জোর
মিলি ঘোষ

একমাত্র তিনতলা বাড়িটা আলোয় ঝলমল করছে। বাড়ির সামনে দারোয়ান। ভেতর থেকে কুকুরের সশব্দ আস্ফালন গ্রামের প্রতিটি ঘরের দরজা জানলা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে আমিই এক এবং একমাত্র। হয়তো, এই সারমেয়র কথা ভেবেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 
   "সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে,
    ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারই প্রভু-কোলে।"
পরীক্ষা হলের কড়া পাহারাদারের মতো গম্ভীর এ বাড়ি নয়। ঝিম ধরা বড়োলোক বাড়ির মতো শুনশান নিস্তব্ধ এ বাড়ি নয়। এখানে ছেলে ছোকরাদের আনাগোনা চলতেই থাকে। তবে তা দিনের বেলায়। রাতে আবার অন্য গল্প। 

যাতায়াতের পথে পড়ে এ বাড়ি। বাড়ির মালিক শিবনাথ মাইতি। শান্তিপ্রিয় মানুষ। সাধ করে তাই বাড়ির নাম রেখেছেন 'শান্তিকুঞ্জ'। খুব যে তাঁকে দেখেছে গ্রামের লোক, তা নয়। মাঝেমাঝে সাদা গাড়িটাকে হুশ করে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। গ্রামের লোকে ভয়ে ভয়ে পার হয় শান্তিকুঞ্জর সামনেটা। কখনও আড় চোখে হয়তো তাকিয়ে দেখেছে, তার বেশি সাহস হয়নি কারোর। গ্রামের মেয়ে বউদের অবস্থা আরও খারাপ। লোকের বাড়ি কাজে যাবার পথেই পড়ে ওই বাড়ি। ভোর ভোর যখন কাজে বেরোয়, তখন শিবনাথের মধ্যরাত। শান্তিকুঞ্জ তখন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। কিন্তু কাজ সেরে ফেরার সময় বাড়ির অন্য রূপ। মহিলাদের আপাদমস্তক জরিপ চলতে থাকে কোনও অদৃশ্য ফিতের সাহায্যে। 

তবে, শিবনাথের দয়ার শরীর। গ্রামের মানুষের ভালো মন্দের খোঁজ রাখেন। মা বোনেদের দুঃখে কষ্টে তাঁরও প্রাণ কাঁদে। সব ক্ষেত্রে তো আর নিজে যাওয়াটা মানায় না। সমীর, বাপিদের পাঠিয়ে দেন। তা ছাড়া শিবনাথ স্বভাব-লাজুক। মহিলাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই। 
সাত বছরের চুমকির জ্বর হয়েছে শুনে গণেশকে ফলমূল কিনে চুমকিদের বাড়ি পাঠালেন।
   বিকেলে গণেশের কাছে জানতে চাইলেন, "কেমন দেখলি?"
   গণেশ মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, "ভেতরে যাইনি। ওর মা'র হাতে দিয়েছি।"
   "কেন? পয়সা গাছে ফলে, না? ফল কিনতে টাকা লাগেনি আমার? তোকে পুষতে টাকা লাগছে না?" উঠে দাঁড়ান শিবনাথ।
   "মেয়েটার 'মায়ের দয়া' হয়েছে। তাই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে সাহস পেলাম না।"
   "মায়ের দয়া? ওহ্, পক্স। তাই বল। তোর হয়নি এর আগে, পক্স?"
   "সে তো স্যার, হাফ প্যান্ট পরার সময়।"
   "আর হবে না। তুই নিশ্চিন্তে যা। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মাঝেমাঝে খোঁজ নিবি। যা এখন, সামনে থেকে সর।" মাছি তাড়ানোর মতো করে বললেন শিবনাথ।
গণেশ চলেই যাচ্ছিল। শিবনাথ আবার হাত নেড়ে ডাকলেন।
   "এই শোন।"
চোখ ছোট করে বললেন, "কী যেন নাম বললি মেয়েটার, চুমকি। তা .... ওর মা'কে কেমন দেখলি? চলবে?"
   গণেশ বত্রিশ পাটি বের করে বলল, "দৌড়োবে।"
তারপরেই ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে গেল। 
    শিবনাথ গণেশের দিকে মুখ তুলে বললেন, "আবার কী হল? এই তো বললি, দৌড়োবে।"
    "বউটার মাইরি তেজ খুব।
    "কী রকম?"
    "ফলগুলো নিতে চাইছিল না।"
    "আচ্ছা!"
    "বলে, ও ফল আমার মেয়ে খাবে না। গরম দেখাতে, নিল।"
    "খাবে না! ওর ঘাড় খাবে। চুমকি সুস্থ হোক। তারপর বুঝে নেব। ঠিক কিনা?"
    "ঠিক। ঠিক।"
গণেশ ঘাড় দুলিয়ে বলে যায়।

🍂
শিবনাথ বুঝে নিয়েছে। শুধু চুমকি কেন? রুমকি, ঝুমকি সবাইকে বুঝে নিয়েছে। বালিকা থেকে প্রৌঢ়া যে কেউ। শিবনাথ নিরপেক্ষ। তাই বাছবিচার করেন না। তবে, শিবনাথের দুঃখ একটাই। ওর মনটা কেউ পড়তে পারল না। নরম স্বভাবের শিবনাথ কত ভালোবেসে পরম মমতায় সকলের সুখ দুঃখের খোঁজ নেন। মানুষ বুঝলে তো! অশিক্ষিত আর কাকে বলে। জ্যাঠার বয়সী মানুষটাকে কোথায় পায় হাত দিয়ে প্রণাম করবে, তা না  ওঁর নাম শুনলেই ভয় পায়। আরে শিবনাথ বাঘ না ভাল্লুক? 

১৪ই নভেম্বর গ্রামের শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার কথা ভেবেছেন শিবনাথ মাইতি। 
    বাপি, সমীর, চাঁদুকে ডেকে সব বুঝিয়ে বলেছেন, "কোথাও যেন এতটুকু ফাঁক না থাকে। মিডিয়াকে খবর দিবি। ব্যাস, আর ভাবতে হবে না। ঠিক কিনা?"
  সমস্বরে "ঠিক। ঠিক।" ব'লে ঘাড় দুলিয়ে যায় তিন অনুগত ভৃত্য। 
   চাঁদু বিশ্বস্ত হলেও বুদ্ধি একটু কমের দিকেই।
হঠাৎ বলে বসে, "স্যার, চোদ্দো তারিখ কি সান্ডে? না, মানে ওই দিন কী আছে?"
   "আ মোলো যা! এই বিশ্ব গবেটদের নিয়ে যে কী করি! আরে ওই দিন শিশুদিবস। গ্রামের সব শিশুদের ওই দিন ভালোবাসতে হয়। খাবার দিতে হয়। উপহার দিতে হয়।"
    "বুঝেছি স্যার। বুঝেছি। আর বলতে হবে না।"
চাঁদু হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। 

১৪ই নভেম্বর সকাল থেকে শিবনাথ মাইতির বাড়িতে সাজসাজ রব। মাইকে বারবার ঘোষণা হচ্ছে। গ্রামের সব মায়েরা যেন তাদের বাচ্চাদেরকে নিয়ে শিবনাথ মাইতির বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় জড়ো হয়। কিন্তু কোথায় কী! সব বাড়ির লোকেরা দরজা আটকে বসে আছে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। আহাম্মক আর কাকে বলে! মানুষ ভালো করতে চাইলেও এরা বুঝবে না। শিবনাথের মহৎ প্রাণ, মহৎ হৃদয়। তিনি পায় ব্যাথা নিয়েই হাঁটা লাগালেন। সঙ্গে দলবল। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদেরকে খাবারের প্যাকেট দিয়ে এলেন। 
    ওদের গাল টিপে বলে এলেন, "কী রে, আমাকে দেখে কি খুব রাগী মনে হয়?"
    ফোকলা দাঁতে হেসে ওরাও বলল, "না, না।"
ঘোমটা আর ওড়নার আড়াল থেকে সব লক্ষ করল ওদেরই মা দিদিরা। শিবনাথ সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। 

শিবনাথ মানুষের মঙ্গল চান। তাঁর দীক্ষিত শিষ্যগণও রোজ দু'বেলা মন্ত্র জপ করে। তাই শিবনাথ কোনও খাবার একা খান না। শিষ্যদেরকে প্রসাদ দেন। ওদের বঞ্চিত করার কথা তিনি ভাবতেও পারেন না। আত্মিক টান আছে বলেই না গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। আজকাল পায় ব্যাথা, কোমরে ব্যাথা হলেও শিবনাথের এমন কিছু বয়স হয়নি যে, এখনই মাছ মাংস খাওয়া বর্জন করবেন। বরং আমিষের প্রতি তাঁর আগ্রহটা একটু বেশির দিকেই। তবে শিবনাথ নিজের হাতে এ'সব কখনও কিনতে যান না। ভক্তরাই নিয়ে এসে শিবনাথের পায়ের কাছে নিবেদন করে। শিবনাথ চোখ বন্ধ করে সে স্বাদ গ্রহণ করেন। ভক্তরাও প্রসাদ পায়। 

এদিকে গ্রামের মা বউ বোনেদের রাতের ঘুম উড়ে গেল কোনও এক অজ্ঞাত কারণে। কারণ ছাড়া তো কার্য হয় না। তাই কারণ থাকলেও বাকি পৃথিবী তা জানতে পারল না। বাড়ির পুরুষ মানুষদেরকে বলেও খুব সুরাহা হলো না। কাজেই মেয়ে বউরাই পথে নামল। যার যার সমস্যা তার তার কাছে। তাদের মতো করে অন্য লোকে তো বুঝবে না। তাই শয়ে শয়ে চুমকি, তাদের দিদিরা, মায়েরা মুখ খুলল। মিডিয়াকে জানাল তাদের নিদ্রাহীনতার কারণ। কেউ মুখ আড়াল করে, কেউ সামনে থেকেই। সব মা বোনেদেরই এক কথা। এক অভিযোগ। বাইরের দুনিয়া নড়েচড়ে বসল। হট্টগোলে ধ্যান ভঙ্গ হলো গুরুজীর। কপালে তাঁর চিন্তার ভাঁজ। এমন শান্তিপ্রিয় গ্রামে হলোটা কী? এত হল্লা কীসের জন্য? 
গুরুজী নাওয়া খাওয়া ভুললেন। যে'টুকু আহার করেন, নিরামিষ। শিষ্যরাও তা'ই খায় আর হাই তোলে। ভাবখানা এমন, দূর .... ভাল্লাগেনা।

তারপর একদিন কাকভোরে শিবনাথের মৃতদেহ পাওয়া গেল, তাঁরই বাড়ির সামনে। রাতের প্রহরীটির শরীরেও প্রাণ নেই।
চারিদিকে চাপা গুঞ্জন। কে করল এ কাজ! শিবনাথ মাইতির মতো মানুষ! শরীরে যার রাগ বলে কিচ্ছুটি নেই। অমন সদাশিব মানুষের এই পরিণতি! 
রাজা, উজির, প্রজা সবাই দেখল, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বাঁকা শিরদাঁড়াও সোজা হয়।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments