জ্বলদর্চি

“কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা”: লক্ষণা ব্যঞ্জনার এক অমোঘ উপাখ্যান/সালেহা খাতুন


“কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা”: লক্ষণা ব্যঞ্জনার এক অমোঘ উপাখ্যান
                                        
সালেহা খাতুন
(অধ্যাপিকা : বাংলা বিভাগ, মেদিনীপুর কলেজ)


কবি ও সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীর ত্রয়োদশ কাব্যগ্রন্থ “কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা” গ্রন্থটিকে নিরপেক্ষ পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কবিকে নির্দ্বিধায় সিম্বলিস্ট অভিধায় অভিহিত করা যায়। ফলে এ কাব্য দ্রুতগতিতে পড়লে এর রস অনুধাবন করতে পাঠক হিমসিম খাবেন। পাঠোদ্ধার করতে হবে ধীরে ধীরে, বলা ভালো ধীর গতিতে। তবেই এর আত্মাকে বোঝা যাবে। এ কাব্যের সৌন্দর্য, উচ্চতর অর্থ, চিত্রকল্প তরল প্রকৃতির নয়। কবিতাগুলি থেকে কবির আত্মাকে চিনতে শনাক্ত করতে সেনসেটরি অর্গ্যানগুলোকে সবসময় সজাগ রাখতে হবে। কেননা এর শৈলী, এর দর্শন, এর নান্দনিকতা বিচার-বিশ্লেষণে অমনোযোগী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সচরাচর প্রচলিত প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক ভাষায় লিখিত নয় এ কাব্য। যদিও শব্দ দিয়েই তা লেখা হয়েছে। তবে বাছাই করা শব্দে। শব্দের পর শব্দ গেঁথে পাঠককে গোলকধাঁধায় ফেলে এক রহস্যের আবরণে আবৃত করে। শব্দের শিকড়ে পৌঁছলে তবেই কবির ইনার ভয়েস শ্রুতিগোচর হবে। কবির ব্যবহৃত শব্দ সাধারণ ব্যবহারের বাহন না হয়ে থেকে সংবেদনের ঊর্ধ্বে পরম বাস্তবতাকে উৎসারিত করে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তিনি পাঠককে এক অভিধা অতিরিক্ত অনুভূতির জগতে পৌঁছে দেন।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

 উদাহরণস্বরূপ ‘ত্রিভুজ’ শব্দটিকে নেওয়া যাক। একাধিক কবিতা – ‘দ্বিখণ্ডিত’, ‘মহাকবির ব্যঞ্জনা’, ‘প্রবন্ধসার’, ‘পিরামিড পিরামিড’, ‘আকর্ষণ ও অনুবাদ’, ‘ত্রিভুজ’ কবিতায় এই শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
‘দ্বিখণ্ডিত’ কবিতায় কবির উচ্চারণ –
 ‘ত্রিভুজকে দু’ভাগ করো। সংখ্যা : চার।
       ...
 ত্রিভুজকে দু'ভাগ করো। সংখ্যা : তিন।’

‘মহাকবির ব্যঞ্জনা’য় বলেছেন –
 ‘হতে পারে তিনবাহু তিনসত্তা। 
ত্রিভুজের মধ্যে বৃত্ত। বৃত্তের কেন্দ্র একটাই।’ 
‘প্রবন্ধসার’-এও ত্রিভুজ দৃশ্যমান –
 ‘সান্ধ্যত্রিভুজমায়ায় ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে প্রামাণ্য ভরকেন্দ্র 
  তিন ভাগের এক ভাগ শ্লোক, অখণ্ড মিলন অনুরাগ’

‘পিরামিড পিরামিড’-এও ত্রিভুজ প্রতীকায়িত।
 ‘মাথা তোলে  ত্রিভুজ, অতঃপর স্নায়ু, সাক্ষী পিরামিড 
 একান্ত বংশীনাদেও সমীচীন নয় প্রতিক্রিয়া, যেহেতু
 অক্ষদণ্ডের বামে ও ডানে প্রতিপাদ্য ক্রীড়া সন্তর্পণে...’

‘আকর্ষণ ও অনুবাদ’-এ কবি বলছেন – 
 ‘ত্রিভুজের সূচিমুখে আমরা কিশোর রাক্ষস ফের দাঁড়ালাম...’

 এমনকি ‘ত্রিভুজ’ নামে একটি আস্ত কবিতাও রয়েছে –
 ‘রক্তাক্ত আকাশ থেকে নুনের শরীর
 চুড়োমণি তোমার ফাঁকা দুপুরবেলায় 
  আমি ত্রিভুজ এঁকেছিলাম’
শেষ কবিতা ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’তেও রয়েছে ত্রিভুজের কথা – ‘স্বপ্নে ত্রিভুজ উপধ্বনি’।
ত্রিভুজ এখানে কীসের প্রতিনিধিত্ব করছে? প্রাচীন মিশরে ত্রিভুজকে ভালোবাসার উপযুক্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বৌদ্ধ শ্রীযন্ত্র মণ্ডলার প্রাথমিক উপাদান ত্রিভুজ যার মাধ্যমে প্রেমের স্বর্গীয় অনুভূতির চরম শিখরে পৌঁছানো যায়। মূলত ত্রিভুজের তিন কোণের মাধ্যমে বাবা মা ও সন্তানের দৃঢ় বন্ধনকে বোঝানো হয়। 
জেনেটিক্সে পুরুষদের বোঝাতে ত্রিভুজ আর মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বোঝাতে বৃত্তের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। জেনেটিক স্টাডিতে লিঙ্গ বোঝাতে জ্যামিতিক আকার গ্রহণ করা হয়।
 আবার ত্রিভুজ ত্রিত্ব(ত্রয়ী), নারীত্ব এবং আধ্যাত্মিকতাকেও উপস্থাপিত করে। মন ও আত্মাও এর দ্বারা প্রতীকায়িত হয়। আর দৈনন্দিন জীবনের বহু ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিক্স, আর্কিটেকচার, অ্যাস্ট্রোনমি, কন্সট্রাকশন, ফিজিক্স, নেভিগেশন সর্বত্র  ত্রিভুজের গুরুত্ব অপরিসীম।
 ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি কবিতাগুলিতে ব্যবহৃত ত্রিভুজ শব্দটি নির্দিষ্ট কোনো সংবাদ না দিয়ে আভাস দিচ্ছে। ইঙ্গিত দিয়ে জাগিয়ে তুলছে পাঠক মনকে। খাঁটি অর্থ পাওয়ার জন্য ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান তোলপাড় করে ফেললেও পাঠক প্রকৃত অর্থ সহজে ধরতে পারবেন না। এ যেন পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে অন্তর্দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা।
 কবি যেন মুচকি হেসে রবীন্দ্রনাথের মতোই ভাবছেন ‘কে বোঝে কে না বোঝে সে কথার বিচার আমি করতে যাব কেন - তোমাদের মতো অধ্যাপকদের আক্কেল দাঁতের চর্ব্যপদার্থ না রেখে গেলে ছাত্রমণ্ডলীদের ধাঁধা লাগাবে কী  উপায়ে?’
মননশীল স্রষ্টার কবিতায় উচ্চারিত হচ্ছেন হকিং, চমস্কি, লিণ্ডেম্যান, আনন্দবর্ধন, পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, দিব্যা ভারতী, কবি জয়দেব আর প্রসঙ্গক্রমে আসছেন সীতা-রাবণ-রাম-রাধা-চন্দ্রাবতী।
অনুভব অনুভূতি প্রায়শই প্রকাশ পাচ্ছে গাণিতিক সংকেত চিহ্নের মাধ্যমে। মিলে যাচ্ছে কবির বিশ্বাস আর পাঠকের প্রতীতি –
‘পাই বা না পাই অন্তত সচেষ্ট হই। খুঁজি যোগ
খুঁজি বিয়োগ, গুণ, ভাগ ফের যোগ, গুণ ভাগ
চিহ্নের খোঁজে প্রতীক, প্রতীকের খোঁজে যেটুকু সমন্বয়
দেখি সিঁড়ি, ওপর থেকেও যা নীচ থেকেও তাই
আশ্চর্য নততলের আনন্দভৈরবীতে মজে আছি
কোনও দুঃখই দুঃখ নয়, এখন আমার।’
কমা, সেমিকলন, পূর্ণচ্ছেদ এও তো চিহ্ন! একক দশক ডিগ্রিকোণ আরো নানান প্রসঙ্গ আসছে। 
শরীরে মনে একেবারে আধুনিক কাব্য ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’তে নতুন পুরাতনের এক আশ্চর্য সমন্বয় লক্ষণীয়। কাব্য নামেও সে প্রতিফলন আছে। কাব্যদেহেও এর চিহ্ন লক্ষ করা যায়।
 ‘এইতো চিরায়ুষ্মান গণ্ডিরেখা, আত্মার প্রতীক সীতা
 রাবণের প্রতিরূপে ঘুমিয়ে,’
 ‘নিষিদ্ধ চারণভূমি’তেও চিত্রকল্প রূপে উঠে এসেছে লক্ষণরেখার কথা। অসামান্য অভাবনীয় আরো সব চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়েছে এ কাব্যে – 
 ১.‘ঘুঘু ও গৃহস্থ বাঘ একসঙ্গে মশারি টাঙায়’
 ২. ‘অজুহাতের স্বাস্থ্যবৃদ্ধি ঘটে’,
 ৩. ‘গল্প মানে সমগ্রের খণ্ডকাল’। 
 ৪. ‘চন্দ্রাহত নদীরা সব গাছ’। প্রভৃতি।

কবি কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীকে। উৎসর্গের পরেও ঋণ স্বীকার করে যে ‘আত্মস্বীকার’ লিপিবদ্ধ করেছেন তাতেও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর মুখাবয়ব-
 ‘বাম গালে  তিল, সেখানে সন্ধে লেগে আছে...’
 আত্মস্বীকারে দু’হাত পেতে চেয়ে নেওয়া ভালোবাসা যেমন আছে তেমনি আত্মস্বরূপকে দু’হাতে ঢেকে রাখার কথাও রয়েছে। এখানেই কবি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। মনে পড়ছে শক্তি বলেছিলেন, ‘অভিনব দুটি হাতে দেয়াল দরজা’ সব খুলে দেওয়ার কথা। ‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’র কবি আসলে কিছু উচ্চারণ খুবই ব্যক্তিগত করে রাখতে চেয়েছেন। ‘ঋতরূপ’ কবিতাটিও এমনই। যেখানে কবি আত্মজ প্রসঙ্গে উচ্চারণ করেছেন –
 ‘ এ সেই অবশ্যম্ভাবী জলাধার
 মায়ার শরীরে রূপক আমার সন্তান
 যেখানে লুকিয়ে আছে আলোকবর্তিকা, শেষ নিশ্বাস’
 সমগ্র কাব্য পরিক্রমা করে কবিকে চিহ্নিত করতে পারি বিশ্বনাগরিক রূপে। যথার্থ তাঁর উচ্চারণ –
 ‘চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয়’
বিবেকানন্দের মতো কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর সমগ্র চেতনা জুড়ে আছে মানুষ—
 ‘মানুষের কথা মানুষকেই বলতে হয়, বেশি করে।’ 
‘কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা’ আসলে প্রকৃতি ও পরমাত্মার মিলনের কথাই বলে। এ কাব্য চোখ এবং মনকে এমন ভাবে আকৃষ্ট করে যে চাইলেও দ্রুত পাঠ করা প্রায় অসম্ভব। এ কাব্য বারবার থামাবে। ভাবাবে। চল্লিশটি কবিতা কমপক্ষে চল্লিশ দিনের সাধনা দাবি করে। কবির জীবন, পাঠকের বিশ্বাস, সময়ের প্রেক্ষিত, প্রত্যেকটি শব্দের প্রয়োগ মাথায় রেখে কবিতাগুলিকে পাঠ করলে আমরা পৌঁছে যাব ‘অলৌকিক প্রকল্প’, কিংবা ‘জল-সম্পর্কিত’ রূপকথা’র কাছে। ‘হলুদ বিকেল’, ‘শেষবেলা’, ‘মরচে পড়া,মৃদু দহন’-এর ‘চিত্রনাট্য’ সাজিয়ে আমরা বুঝতে পারবো ‘কোনও দুঃখই দুঃখ নয়, এখন আমার’।
 মহাকবির মতোই ‘সোনার কাঠি রুপোর কাঠি’র ছোঁয়ায় তিনি আমাদের সংজ্ঞা ফিরিয়ে দেন – ‘যেদিকেই তাকাই, দেখি আলোয় আলো হয়ে আছে’।
--------------
কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা / ঋত্বিক ত্রিপাঠী
প্রচ্ছদ : দেবাশিস সাহা
সিগনেট / ২৫০/-


Post a Comment

0 Comments