উদয়ের পথে
দ্বিতীয় পর্ব
মলয় সরকার
জাপান যাওয়ার শুরুতেই পেয়েছিলাম বাধা। মুম্বাই এয়ারপোর্টে কিছু কাগজপত্রের সমস্যায় একটা দিন নষ্ট হয়। আমরা যাত্রা করি নির্বিঘ্নেই পরের দিন। ওদিকে আমেরিকা থেকে আসার কথা ছিল মেয়ের। সে ঠিক সময়েই এসে হাজির হল। আমরা এসে পৌঁছালাম টোকিওর এয়ার পোর্টে। রাস্তায় আমার গিন্নী বুলবুলের প্রচণ্ড শরীর খারাপ।ও তো সারা রাস্তা প্লেনের কোন খাবার খেতেই পারে না। সারাক্ষণ সঙ্গে আনা মুড়িই ভরসা। কিন্তু এই যদি যাত্রা শুরুর অবস্থা হয়, ওখানে পৌঁছে কি করবে রে বাবা, ঘুরবেই বা কিভাবে! আমি তো ভীষণ চিন্তায় পড়লাম।
যাক,নরিতা এয়ারপোর্টে এসে আমরা তো প্রথমে মাল খুঁজে পাই না। একটি ছেলেকে বললাম, ওদেরই স্টাফ। সে তো প্রথমে শুনেই এক চোট হেসে নিল, যেন খুব মজার একটা জিনিস বলেছি। ওদিকে আমার মুখ শুকোচ্ছে।সে কিন্তু , কাজের বেলায় ঠিক আছে। আলাদা করে রাখা আছে দেখলাম, বেশ কিছু ব্যাগ। সেখান থেকে বেশ খানিকটা খুঁজে আমাদের ব্যাগগুলো বের করল। তাকে খুশী হয়ে ধন্যবাদ দেব কি, সে হেসেই খুন! এর মধ্যে এত হাসির কি আছে বুঝলাম না, একেবারে শিশুর মত প্রাণখোলা হাসি।আমিও বোকার মত তার সঙ্গে হাসার চেষ্টা করলাম।
এর মধ্যে একটি স্টাফ তো আবার এক জাঁদরেল কুকুর এনে হাজির। সে তো সব শুঁকবে। আমরা ভাবলাম সারমেয় খাদ্য তো কিছু নেই, আর বোমার মশলাও নেই, কি আর শুঁকবে! বের করে দিতে বললে , বের করে দেব কিছু মুড়ির প্যাকেট, যা পাতি বাঙ্গালীর চির এবং অকৃত্রিম ভালবাসার জিনিস, বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গের।শেষে সে পরীক্ষাতেও সসম্মানেই পাশ করা গেল। আগের ছেলেটি আবার হাসতে হাসতেই, আমাদের হাতে সব মাল গচ্ছিত করে যেন, একটা বড় দায়িত্ব মুক্ত হয়েছে এমন ভাব নিয়ে এগোল অন্য দিকে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
যাক, টোকিওর নরিতা এয়ারপোর্টে পৌঁছে বুলবুল বলল প্রথম, আমার খুব খিদে পেয়েছে।পাওয়া তো উচিতই। সারা রাস্তায় শুধু কয়েকটি মুড়ি ছাড়া কিছু খায় নি, নিশ্চিন্ত হলাম।শুনে কান এবং প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল। বেরোনোর আগেই মোটামুটি পেট ভরে খাইয়ে নেওয়া হল। বুঝলাম, এর অনেকখানিই ছিল দুশ্চিন্তার কারণে। আর সেটা কেন? না, মেয়েটা ঠিক মত আসতে পারবে তো? ছেলে মেয়ে দুনিয়া চষছে আর এখানে আসার নামে তার মায়ের চিন্তায় শরীর খারাপ হচ্ছে- কি আর বলি! বাঙালী মায়েরা বোধ হয় এই রকমই।”রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি”।
যাক,বাইরে বেরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়াতেই পাওয়া গেল ট্যাক্সি। বাইরে ঝকঝকে আলো। ট্যাক্সি ছুটল তার নিজের পথে। এই নরিতা এয়ার পোর্টটা আসল টোকিও শহর থেকে বেশ দূরে। তাই ড্রাইভার শুরুতেই জিজ্ঞসা করল, হাই ওয়ে দিয়ে যাবেন, না ভিতর দিয়ে? প্রথমটা বুঝি নি। পরে বুঝলাম, হাইওয়ে দিয়ে গেলে যেমন সময় কম লাগবে, তেমন তার টোল ট্যাক্স ইত্যাদিতে চার্জ দিতে হবে। আর ঘুরে গেলে এ সমস্ত যেমন লাগবে না, দূরত্ব বেশি হবে, সময় বেশি লাগবে। আমরা বললাম, হাই ওয়ে দিয়েই চল।
টোকিও শহরে দুটো এয়ারপোর্ট আছে , একটি হানেদাতে,শিনাগাওয়া অঞ্চলে এবং দ্বিতীয়টি নরিতাতে শিবা অঞ্চলে।আগেই বলেছি, এই নরিতা থেকে টোকিও শহর কিন্তু বেশ দূর , প্রায় ৭০-৮০ কিমি মত। ট্যাক্সিতে আসতে প্রায় এক ঘন্টা মত লাগে। অবশ্য আরও অনেক রাস্তা আছে শহরে যাওয়ার, হাইস্পীড ট্রেন আছে, Keisei Skyliner এর বাস আছে। যেখানে ট্রেনে যেতে লাগে মাত্র ৩৬ মি, বাস কিংবা ট্যাক্সিতে লাগে প্রায় এক ঘন্টা।
হানেদা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টই হল টোকিওর সবচেয়ে গুরুত্বপূরণ এয়ারপোর্ট। এটি ২০২১ সালে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল ডোমেস্টিক এয়ারপোর্টের খ্যাতি লাভ করে।
নরিতা এয়ারপোর্ট হল এদিকে আবার, জাপানের সবচেয়ে বড় এয়ারপোর্ট। এটি প্রায় ৬০ কি মি লম্বা।
আমরা এগোলাম হাই ওয়ে দিয়ে। চারধার মোটামুটি ফাঁকাই।উল্লেখযোগ্য কিছু নেই , শুধু শেষ বিকালের ক্লান্ত সূর্যদেব তখন দিনপথ অতিক্রমের একরাশ ক্লান্তি নিয়ে হৃতবল হয়ে ফিরে চলেছেন বিশ্রামালয়ে। আর চারিদিকে ধীরে ধীরে স্নিগ্ধ মোলায়েম চাদর জড়িয়ে দিচ্ছেন প্রকৃতির গায়ে পরম আদরে সন্ধ্যা দেবী।
আমরা ছুটে চলেছি নতুনের দিকে। পেরিয়ে এলাম একটি স্বচ্ছ তোয়া, নাম Sumida নদী। বুকে তার মরালের মত সঞ্চরমান যন্ত্রপোত।
প্রবেশ করলাম শহরে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন।শুধু পরিচ্ছন্ন নয়, ঝকঝকে। অবশ্য এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ঢোকার মুখে রাস্তা সবাই পরিষ্কার রাখে, নতুন অতিথির কাছে নিজের মালিন্য দেখাতে কেউ চায় না। আমাদের কোলকাতাও তাই চেষ্টা করে, ভিতরে যত ক্লেদাক্ত অবস্থাই থাক, সেগুলো অতিথিকে প্রথমে আমরাও দেখাতে চাই না।দেখা যাক, ভিতরে কেমন।
একটা সাধারণ বড় শহর যেমন হয়, চারিদিকে বিশাল বিশাল ঝকঝকে রাস্তা আর সুউচ্চ হর্ম্যরাজি । এর মধ্যে কোন বৈচিত্র্য নেই আমার কাছে। যতই ঢুকছি ভিতরে , জায়গাটা একেবারেই হোটেল পাড়া তো নয় দেখলাম, বরং বেশ কিছুটা বসতি পাড়া বলেই মনে হল। এটা তেমন কোন বাস রাস্তার উপরেও নয়। জিপিএস দেখেও খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।বুঝছি, আশেপাশেই কোন গলি, কিন্তু ঠিক যেন পৌঁছানো যাচ্ছেনা। আসলে বড় হোটেল আর দূর থেকে তার সাইন বোর্ড দেখব, তেমন নয়ই ব্যাপারটা, বরং এটি একটি সাধারণ একজনের বাড়ি, যে বাড়ীটাকে ভাড়ার জন্য দিয়েছে , ওই এ আর বি এন বি আর কি!।বাড়ির দরজায় ছোট করে নাম লেখা আছে।বয়স্ক, প্রায় বৃদ্ধ ড্রাইভার ।আমরা ভাবছিলাম, নিশ্চয়ই এত ঘুরবে না, না পেয়ে কাছাকাছি এনে ছেড়ে দিয়ে বলবে , আর পারি না ,তোমরা খুঁজে নাও।তা নয়, সে এক এক ছোট ছোট গলিতে এগোয়, পিছোয় আর চিন্তিত মুখে বাড়ির নেমপ্লেট পড়ে।শেষে যখন আধো আঁধারী এক দশতলা বাড়ির দরজায় এনে ফেলে দেখাল, এই তোমাদের সেই অভীষ্ট লক্ষ্য, তার মুখে সে কি সফলতার হাসি।
তার জন্য তার বিরক্তি তো নেইই , বরং এক সাফল্যের আনন্দ।
ধীরে ধীরে যেন বোধগম্য হচ্ছে, জাপানীদের সাফল্যের চাবিকাঠি। ভ্রমণের শেষে মন্তব্য করব। আমি ভাবছি, এরা কি সবেতেই হাসে, কাজে বিরক্তি নেই, আর আমাদের মত দায়সারা ব্যাপারটা নেই? এদের সাথে আমাদের তফাত কত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই ভ্রমণে, সেটা পরে প্রকাশ্য।
আমরা নেমে হোটেলের থুড়ি, বাড়ির দরজায় গেলাম। আতিথ্য করার জন্য কেউ নেই। ডিজিটাল লক। আমাদের কাছে পাঠানো কোড, আর দরজার পাশে কাগজে লেখা নিয়মকানুন দেখে দরজা খোলা গেল। ভিতরেও কেউ নেই।শুধু তির চিহ্ন দেওয়া আর নিয়ম দেওয়া আছে।পৌঁছালাম লিফটে করে ঘরের দরজায়। আবার কোড। লকে সেটি দিতেই খুলে গেল ঝকঝকে ঘরের দরজা।
টোকিও টাওয়ার বা সুমিদা টাওয়ার
এ যেন ভূতের বাড়ি , সব ঝকঝকে তকতকে, সাজানো গোছানো কিন্তু কেউ নেই বলার জন্য বা বোঝানোর জন্য। কোন অসুবিধা হলে কি করব, তাও জানি না।সব জিনিস, যা যা দরকার, ঠিক ঠাক জায়গায় রাখা আছে।
ঢুকেই বলা আছে, জুতো এখানে খুলে রাখ। শুনেছি, এই জুতোর ব্যাপারে ওদের খুব পিটপিটানি আছে। এ ব্যাপারটার সাথে কবিগুরুকেও মুখোমুখি হতে হয়েছিল। অনেক জায়গাতেই, জুতো খোলার জায়গাতেই, ঘরে পরার জুতো বা চটি দেওয়া থাকে। সাধারণ ভাবে, কোথাও কেউ জুতো পরে ঘরের ভিতর যায় না।
আমরা ঘরে ঢুকে , একটু ফ্রেশ হতে গিয়ে প্রথম ধাক্কা খেলাম, বাথরুমে।সেখানে দুটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, প্রথমতঃ স্নানের জায়গা আর শৌচালয় আলাদা অর্থাৎ একঘরে নয়, আলাদা ঘরে।এছাড়া দ্বিতীয়টি হল, কমোডটি সম্পূর্ণ ইলেক্ট্রনিক অটোমেটিক পদ্ধতিতে চলে।এ জিনিস আমি , এর আগে এত দেশ ঘুরেছি, কোথাও পাই নি।কমোডের সিটটি অটোমেটিক, বসার উপযুক্ত গরম হওয়া থেকে শুরু করে ফ্লাশ হওয়া পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়। মাঝের শৌচ কাজের জন্য বিভিন্ন ধরণের সুইচ আছে, যেটি প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহারযোগ্য।
যাই হোক, সঙ্গে আনা খাবার দিয়ে প্রাথমিক পর্ব সারলেও পরের দু দিনের ব্যবস্থা, আগামী কাল সকালে বেরোতে হলে তার জোগাড় ইত্যাদি করার জন্য বেরোতেই হল।বেরিয়ে দেখি, কোথাও কোন আওয়াজই নেই। দু একজন মানুষ হয়ত হাঁটছে, আর কেউ কোথাও নেই।কিছু কথা বলার বা জিজ্ঞাসা করার মতও কেউ নেই।
সামনেই বাড়ির কাছেই রয়েছে একটি ছোট মলের বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মত দোকান, যেমনটি ইউরোপ আমেরিকায় হয় আর কি। রাস্তা গুলো ছোট বটে, রাস্তার দুপাশে কিন্তু ঝকঝকে সাদা পরিষ্কার রেখা টানা আছে, হাঁটা বা সাইকেলের জন্য। এগুলো অবশ্য পাড়ার মধ্যের রাস্তা। একটা লোকালয় এত নিঃশব্দ যে হতে পারে, এমন কি দিনের বেলাতেও , তা আমার জানা ছিল না। নিজেদের মধ্যে অভ্যাসবশতঃও জোরে কথা বলতে সংকোচ হচ্ছে।সমস্ত রাস্তা ঝকঝকে ও পরিবেশ ছবির মত। রাস্তাগুলো একেবারে সোজা সরল রেখায়।আর বৃষ্টি নিয়মিত হওয়ার কারণে কি জানিনা, সমস্ত যেন ধোয়া মোছা।
সঙ্গে থাকুন আগামী পর্বেও-
ক্রমশঃ-
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments