অষ্টম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সে বছর ফাগুন মাসের শেষ থেকেই আবহাওয়া বড়ো উষ্ণ ঠেকছিলো কলকাতায়। চামড়ায়-ঠোঁটে শুকনো টানটান ভাব, হল্কা-হল্কা বাতাস যখন তখন মুখে হাতে এসে লাগছে;চারিদিকে কেমন যেন মনখারাপ মনখারাপ ভাব।
এমন গরমকালের সঙ্গে বিরজার পরিচয় ছিলো না তখনও।
এমনিতে দেশে ঘরে গরম পড়লেও গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় বয়ে যাওয়া ঝিরঝিরে হাওয়ায় তা তেমন মালুম হয় না। তাছাড়া পাঁকজমা পুকুরে তো রোদ পড়ে না। জল শীতল। সেখানে অফুরন্ত স্নানের আরাম,সবাই মিলে সাঁতার কাটা, হুটোপুটি,পুকুর ধারের গাছে বসে বসে দোল খাওয়া তো আছেই।
কিন্তু শহরে তো আর সেসবের উপায় নেই। মাপা জল, মাপা স্নান, তায় গাছপালা নেই, চারিপাশে শান বাঁধানো। গরমে গরম; আকুলি বিকুলি করে ওঠে যেন গ্রাম বালিকার প্রাণ।
তাছাড়া নিয়ম মানা জীবন তো আছেই। সব মিলিয়ে খুব বেশি দিন একটানা কলকাতায় থাকতে
একটুও ভালো লাগে না বিরজার। মায়ের কাছে কয়দিন ধরেই বায়না করেছিলো তাই বাপের বাড়ি যাওয়ার। এমনিতে দ্বিরাগমনের নিয়ম থাকলেও মা-মরা মেয়েটিকে নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছিলেন তিনি, মেয়ের বাবারও তেমন আপত্তি ছিলোনা। তবে জ্যাঠাইমা বড়ো ভালোবাসতেন যে, কয়দিন না দেখলেই হাঁপিয়ে উঠতেন। তাই যাতায়াত চলতো এবাড়ি-ওবাড়ি।
চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের মেলায় বাপের বাড়ি আসার কথা ছিলোই, অগত্যা এবারেও পাঠাবার কথা ভেবেছিলেন;জ্যাঠামশাই নিজে গিয়ে নিয়ে আসবেন, এমনই কথা ছিলো। সেই মতো বিরজাও আশায় আশায় ছিলো;বাপ ঘরের আমগাছ, কাঠবিড়ালি,ছিপে ধরা পড়ার জন্য অপেক্ষমাণ পুকুরের পুঁটিমাছ তাকে ডাকছিলো; কলকাতার কলের পুতুল, সেমিজ, রঙিন চুড়ি, ফিতে….এসবও তো দেখাতে হবে সইদের, আদর খেতে হবে জ্যাঠাইমার।কতোদিন যে দ্যাখা হয়নি! বড়ো মন কেমন করে বিরজার…
যদিও শ্বশুর ঘর করার সময়কাল তাঁর খুব অল্পই, তবু সেসব দিনের কথা জীবনভ’র মনে তো পড়েই বিরজাসুন্দরীর। -------
🍂
মনে পড়ে, এমন সব তপ্ত দুপুরবেলায়, কাজকর্ম খাওয়া দাওয়ার পরে জানালার খিড়খিড়ি বন্ধ করে ভিজে কাপড় দিয়ে মেঝে ও মাদুর মুছে, মা ওকে নিয়ে শুয়ে পড়তেন রোজ, হাতে থাকতো লেস বসানো হাতপাখা। খানিক পরে মা ঘুমিয়ে পড়লে, হালকা হালকা নাক ডাকার সঙ্গে দুলতো হাতপাখার লেস; সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কখনও বা বিরজারও ঝিমুনি এসে যেত;কখনও বা পা টিপে টিপে নেমে আসতো নীচে, কুয়োতলার পেয়ারা গাছে চড়ে বসতো কোমরে কাপড় বেঁধে;কখনো কখনো দোতলার জানলা দিয়ে একটা মুখ উঁকি দিতো; লক্ষ্য রাখতো বিরজা… দেখতে পেলেই পেয়ারা ছুঁড়ে মারতো জানলায়। তারপরে, এক দৌড়ে পৌঁছে যেত দারোয়ান চাচার কাছে।
এমনি করে মাঝেমধ্যেই চলে যেতো, দারোয়ান চাচার সঙ্গে গল্প করে আসতো ভাঙা বাংলা-ভাঙা হিন্দীতে।
প্রথম প্রথম চাচা ওকে ভেতর বাড়িতে ফিরে যেতে বলতো,
-’বহুজী, অন্দর যাইয়ে, ইঁহা মৎ রহিয়ে।’
ও শুনতো না, গল্প করেই যেত চাচার সঙ্গে মাটিতে বসে, ধুলো লাগতো কাপড়ে। পরে পরে, দারোয়ান চাচাও তার সঙ্গে তার দেশের কথা বলতো, ছেড়ে আসা বাবা-মা-মেয়ে-ক্ষেতজমি-ভুট্টাচাষ- আখচাষ আরও কতো কি। কেউ কারো কথা সম্পূর্ণ বুঝতো না,তবে মত বিনিময়ে তাতে সমস্যা হোত বলে মনে হয়না। আসলে, ওদের গাঁয়ে তো চাকর-বাকর ছিলো না, চাকর-বাকরদের সঙ্গে যে বাড়ির লোকেদের গল্প করতে নেই, তা তখনও জানতো না বিরজা। তাই গল্প করতে যেত।
কিন্তু এমনই একদিন, দুপুরে, বামনী বুড়ি তা দেখে ফেলে মাকে বলে দেয়, মা ওকে আড়ালে ডেকে বুঝিয়ে ছিলো সব, সেদিন থেকে আর নীচে যাওয়া হয়নি।
সে রাগ তো ছিলোই, প্রতিশোধ নিতে তারই মধ্যে একদিন নীচের বারান্দার খাঁচা থেকে দুটো চন্দনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলো বিরাজ ইচ্ছে করে; পাখি দুটো বামনী বুড়ির খুব পছন্দের ছিলো…প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাদের হরিনাম শেখাতো বুড়ি,আর তারা ঝিমোত;দেখে দেখে হাসতো বিরজা;রেগে মেগে গাল পাড়তো বুড়ি।
তো সেদিন সন্ধ্যায়ও খাঁচা খালি দেখে যা নয় তাই বললে বুড়ি বিরজাকে; মা সব শুনেও মুখে শব্দটিও করলে না, বরং এবারে বৌমাকেই আবার বকলে। এমন নাকি করতে নেই।
এমনিতেই বদরাগী, একগুঁয়ে মেয়ে;সবাই মিলে বকতে আরও রেগে গিরগির করতে করতে পায়ে পা ঠুকেছিলো বিরজা, শান বাঁধানো মেঝের তো কোন ক্ষতি হয়ই নি, উল্টে তার পাটাই ব্যথা করতে লাগলো। এরা কেউ তাকে ভালোবাসে না; রাগে অভিমানে তার চোখ ফেটে জল এলো।
সেই দিন, শুধু ঐ একটি মাত্র দিনই শ্বাশুড়ীর বিদ্যাবাগীশ ছেলে পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মাকে বলেছিল,
-’মা! ওকে কয়টা বই কিনে দাও না। বই পড়লে, এমন দস্যুপনা করতে পারবে না হয়তো’
শ্বাশুড়ী বলেছিলেন,
-’বই তো দিতেই পারি। কিন্তু ওকে পড়াবে কে! তুই?’
-’না। না। ঐ বিচ্ছু গেছো মেয়েকে আমি পড়াতে পারবো না।তুমি মাষ্টারনী রাখো‘
বিরাজ এতোক্ষণ মা-ছেলের কথা শুনছিলো, এবার মুখ নাড়লে,
-’আমি পড়তে জানি,কাউকে পড়াতে হবে না,আমি নিজেই পড়বো। দ্বিতীয় ভাগ পড়েছি। নামতাও জানি নয়ের ঘর পর্যন্ত। এ, বি, সি, ডি লিখতেও পারি।বই পড়তে ভালোলাগে আমার‘
-’সত্যি!তুমি পড়তে জানো! বলোনি কেন এতোদিন?’
এখনও মনে পড়লে হাসি পায়, সেই প্রথম বরের সামনে ঘোমটা খুলে অহঙ্কারী মেয়েটি বলেছিলো,
-’পারি বইকি!
মজার ছলে রসিক কিশোরের উত্তর ছিলো,
-‘বই দিলে দুষ্টুমি করবে না? ‘
-’না’
তবে তার পরে আর কোন কথা হয়নি। পুতুল বর পড়ার ঘরে ফিরে গিয়েছিলো,পুতুলবৌ সংসারে।
খেলা শুরুর আগেই খেলা ভেঙেছে তাদের; বরবৌয়ের কথা, ভাব ভালোবাসার কথা বলার মতো বয়স যে তখনও দুজনের কারোরই হয়নি।
পরের দিন, অনেকগুলো বই এনে দিয়েছিলো তার দিগগজ বর; খানিক পড়েছিলো, এখনও পড়ে; মুখখানি ভুলে গেলেও বরের উপহার বলে কথা! এখনও সেগুলো রাখা আছে ট্রাঙ্কের তলায়; একান্ত শ্রেয় উপহার যে।
গোপনে একা একা দোর দিয়ে বিরজাসুন্দরী সেগুলি ছুঁয়ে দেখেন, অনুভব করেন আসঙ্গসুখ… বাসনাহীন কামগৌরবে বিন্দু বিন্দু নিষিক্ত হয় আকুমারী চিরায়ত রাধা হৃদয়!
পূষণের স্পর্শ সুখে প্রাচী
নীশিথের অমাভাঙা লজ্জারুণ আঁখি
মেলে চায়। পথ চেয়ে আছি…
ওগো প্রেম! নীলাব্জ আমার!
তুমি আজও একা, আমিও একাকী।
জানলার ফাঁক দিয়ে আসা প্রভাত সূর্যের দিকে আনমনে তাকিয়ে বৃদ্ধার মনে গুণগুণিয়ে উঠলো কথা কয়টি… কার রচনা! অজস্র পড়া কোন পংক্তি! না নিজেরই ভাবনা ফসল তা মনে পড়লো না, শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো অকারণের স্বস্তিতে… তাকিয়ে রইলেন;তাকিয়ে রইলেন আলোর দিকেই।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments