জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪১/ বিজন সাহা

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪১ 

বিজন সাহা 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা প্রথমে গেলাম সেই মিউজিয়ামে যেখানে ৫০০ কিলগ্রাম ওজনের কোরআন রাখা আছে। নীচের তলায় আছে বিভিন্ন সময়ের পোশাক পরিচ্ছদ, অনেক ছবি আর দোতলায় একটি কাঁচের ঘরে কোরআন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে গেলাম উসপেনস্কি সাবরে। দেখলাম ছোট মিনার, খানদের সমাধি। পাশেই বিশাল সামিয়ানা, মনে হয় প্রাচীন আমলের তাঁবুর অনুকরণে তৈরি। এখান থেকে বহুদুর পর্যন্ত ভোলগা দৃশ্যমান। হয়তো কামার কিছু অংশও। প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যি দেখার মত। বরাবরের মতই পর্যটকদের ভিড়। গল্প করতে করতে যাই জাদুঘরের দিকে।  উদ্দেশ্য যাদুঘর দেখব আর দুপুরের খাবার খেয়ে নেব। যাদুঘর সত্যি দেখার মত। সেই প্রাচীন কাল থেকে মানে বুলগার রাজ্যের উত্থান থেকে বর্তমান পর্যন্ত এদের ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র, বাসনপত্র, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জিনিসপত্র। আসলে এখানে জাদুঘরগুলো বেশ সমৃদ্ধ। বিভিন্ন মনাস্তিরের জাদুঘরগুলোর কথা আগে বলেছি। প্রায় সব জনপদের আছে আঞ্চলিক জাদুঘর। ধীরে ধীরে চলে আসি একেবারে নীচের তলায়। সেখানে বিভিন্ন স্যুভেনিরের দোকান। দিলীপ কিছু কেনাকাটা করে। আমিও। এরপর হাঁটতে হাঁটতে যাই ভোলগার তীরে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে পিতেরবুরগ নামে এক জাহাজ। আমার মনে প্রশ্ন জাগে এখানে ঘাঁট থাকতে আমরা কেন দুই বছর আগে বেশ দূরে জাহাজ থেকে নেমেছিলাম?

এরপর ঠিক হল উপরে উঠব আমরা পায়ে হেঁটে, সিঁড়ি বেয়ে। মাঝ পথে পড়বে ক্যাফে। সেটাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এর আগে ঘুরে আসা গির্জা, মসজিদ ইত্যাদি ভিন্ন রূপে দেখা দিল। বেশ কিছু ছবি তুলে ঢুকলাম ক্যাফেতে। ফ্রেশ হয়ে খাবার অর্ডার দিলাম। কী ২০১৯, কী ২০২১ – মেন্যু প্রায় একই রকম। ধীরে সুস্থে খেয়েদেয়ে একটু গল্প করে আবার রাস্তায় নামলাম তিনজন। এবার আমাদের লক্ষ্য উলিয়ানভস্ক।     

দিলীপ, দেমিদ আর আমি তিন জনেই ফটোগ্রাফার। দিলীপের এটা পেশা। ও ফটো জার্নালিস্ট। দেমিদের নেশা হলেও সময় সুযোগে এটা পেশা হিসেবে ব্যবহার করে। ও যাকে বলে ফ্রি ল্যাঞ্চার। আমি একান্তই সৌখিন ফটোগ্রাফার। শুরু সেই ১৯৮৩ সালে। মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ছবি কিনলেও এবং কেউ কেউ পয়সা দিয়ে ছবি তুলতে চাইলেও সেটা এড়িয়ে যাই। কারণ যখন কেউ পয়সা দেয় তখন তার পছন্দ মত কাজ করতে হয়, নিজের স্বাধীনতা থাকে না। প্রায়ই দেখেছি কারও ছবি তোলার পর বিভিন্ন বিবেচনায় যে ছবিগুলো আমি বেছে নিয়েছি তারা করেছে তার উল্টোটা। দেমিদ এবার অবশ্য ক্যামেরা আনেনি। যা তোলে তা আই ফোনে। মূলতঃ ভিডিও। আর খুব ভালো এডিট করে। তৈরি করে ছোট ছোট একশন মুভি। দিলীপ তোলে অনেক ভেবে চিন্তে। ঠিক আগে যেমন আমরা ফিল্ম গুনে গুনে ছবি তুলতাম। আসলে ও খোঁজে এন্ড রেজাল্ট। অর্থাৎ এই ছবিটা কোন পত্রিকা বা বইয়ে যাবে কি না সেটা ভেবে। আর আমি একটার পর একটা ছবি তুলে যাই বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন এঙ্গেলে। এই একটা গির্জার ছবি তুলছি তো পরের মুহূর্তে একটা পাতা বা শিশির বিন্দু। দিলীপকে আমি আমার সাইটের এলবাম দেখাই। কোথাও ধোঁয়া, কোথাও কুয়াশা, কোথাও ররফের উপর কোন ছায়া আবার কোথাওবা জলের মধ্যে কালির খেলা। দিলীপ দেখে। যদিও মুখে বলে ইন্টারেস্টিং তবে চোখে প্রশ্ন "কেন?" কীভাবে এল কে আদভানির বিখ্যাত ছবি তুলেছিল সেই গল্প শোনায় দিলীপ অনেক সময় নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে। জানি দিলীপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন। এখানে সে ফটোগ্রাফ। আর সব শুনে বুঝলাম এটা তার পেশাগত জীবনে তোলা ফটোগুলর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। অথবা বিভিন্ন রাজনৈতিক মুভমেন্টের। ওর প্রতিটি ছবির পেছনে আছে দেশের বা সমাজের ইতিহাস। আমার ছবির পেছনে শুধুই ভালবাসা। 

দিলীপ জিজ্ঞেস না করলেও দেমিদ ঠিকই জিজ্ঞেস করল।

আচ্ছা, দিলীপ বা আমি ছবি তুলি পেশা হিসেবে, তুমি কেন ছবি তোল? তাও আবার একটা দুটো নয়, অনবরত ছবি তুলেই যাচ্ছ।  

আমার সুবিধা হল আমি কোন  দায়িত্ববোধ থেকে ছবি তুলি না, তুলি মনের আনন্দে। তুমি যে প্রশ্নটা করলে সেটা আমাকে করেছিল তাতিয়ানা ২০০৯ সালে আমার দ্বিতীয় ছবি প্রদর্শনীতে। “আমাদের সন্তানেরা” নামে সেই প্রদর্শনীতে ছিল ১৫০ টার মত ছবি, পোরট্রেট, আমার ছেলেমেয়েদের, ওদের বন্ধুদের আর আমার বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের। বলতে পার এক থেকে ষোল বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা ছিল এই প্রদর্শনীর নায়ক নায়িকা। তাতিয়ানা “জ্যান্ত টুপি” নামে এক বাচ্চাদের পত্রিকার সম্পাদক, মূলত বাচ্চারাই ঐ পত্রিকার সাংবাদিক। তখন আমি এভাবে উত্তর দিয়েছিলাম।

🍂

আমি ছবি তুলে শুরু করি রাশিয়া আসার পরে। এখানে যে থেকে যাব সেরকম কোন পরিকল্পনা ছিল না। তখন ছবি তুলতাম দেশে ফিরে গিয়ে রাশিয়ার স্মৃতিচারণ করার জন্য। তাই এখন বলতে পারি আমি ছবি তুলি আজকের আমিকে সুদূর ভবিষ্যতে দেখার জন্য।

পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, কলিগ এসব থাকার পরেও প্রতিটি মানুষই একা। সে যেমন একা আসে পৃথিবীতে আবার একাই চলে যায়, সেভাবেই জীবনের অনেকটা সময় সে নিজের সাথেই বাস করে। সেদিক থেকে ফটোগ্রাফি আমার একাকিত্বকে রাঙ্গিয়ে তোলে, অর্থময় করে তোলে, যেমন করে বই বা অন্য কোন শখ। তাই তাই ছবি তুলি আমার একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাবার জন্য।

বিভিন্ন কাজে প্রায়ই আমাকে অনেকের সাথে মিশিতে হয়, অনেকে সাথে চলতে হয়, অনেক সময় অনেক মানুষের সাহচর্যে কাটাতে হয়। তবে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি আমার নিজের সঙ্গ। আমি সারাদিন নিজের সাথে কথা বলতে পারি, তর্ক করতে পারি, নিজের সঙ্গ উপভোগ করতে পারি। বলতে পার অন্যদের কোম্পানিতে আমি প্রায় হাঁপিয়ে উঠি। তাই অনেক লোকের ভিড়ে আমার যখন নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, আমি ক্যামেরা হাতে তুলে নেই। কারণ তখন কেউ সাধারণত আমাকে বিরক্ত করে না। ছাত্রজীবনে যখন একা থাকতে ইচ্ছে করত তখন চলে যেতাম আরবাতে। এটা মস্কোর ব্যস্ততম রাস্তার একটি, লোকে লোকারণ্য। তবে কেউ তোমাকে চেনে না, তুমি কাউকে চেন না। এ যেন জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া। তাই বলতে পার আমি ছবি তুলি নিজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার জন্য।  

এটা ছিল তাতিয়ানাকে বলা আমার উত্তর। তোমাদের আমি সেটাই বলতে পারি।



দিলীপ এখন মুখ খুলল।
আচ্ছা তুমি সব সময় আমি আমি কর কেন? যেকোনো কথায়ই শুধু আমি আর আমি।
দেখ, আমাদের লোকজন আমরা বলতে পছন্দ করে। তারা মনে করে তাদের এই কথা তার একার নয়, অনেকের কথা। আমি তো রাজনীতি করি না, কেউ আমার সাথে একমত কিনা সেটাও জানি না। তাই আমি কীভাবে অন্যদের দায়িত্ব নেব। আমি যা করি বা যা বলি, সেটার দায় দায়িত্ব একান্তই আমার। তাছাড়া আগে আমিও মাঝে মধ্যে আমির বদলে আমরা ব্যবহার করতাম। মনে আছে আমার ডিএসসি থিসিস প্রিডিফেন্সের কথা। আমি কয়েকবার আমরা বলায় ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর বললেন তুমি কি জার দ্বিতীয় নিকোলাই? আসলে রাশিয়ার জার সব সময় নিজেকে বহুবচনে প্রকাশ করতেন, আমি নিকোলাই না বলে বলতেন আমরা নিকোলাই। এটা অবশ্য তিনি করতেন এ জন্যে যে তাঁর কথা শুধু তাঁরই ছিল না, ছিল রোমানভ বংশের, ছিল তাঁর সভাসদদের। আমি তো জার নই। তাই আমরা না বলে আমিই বলি। 

আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় উলিয়ানভস্কের দিকে। দেমিদ ইতিমধ্যে সেখানে এক বাসা ভাড়া করে ফেলে। তাই তেমন তাড়া নেই। দিলীপের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা সেখানে রাত কাটাব আর পরের দিন সকালটা সেখানে কাটিয়ে রওনা হব সামারার পথে। এখন আর রাস্তার দু ধারে ঘন বনের দেখা মিলছে না, নেই বড় বড় পাইন, বার্চ, ক্রিস্টমাস ট্রি। তাদের পরিবর্তে রাস্তার দুধারে এখন বিস্তীর্ণ প্রান্তর। অনেকটা বাংলাদেশের মত। চারিদিকে ধু ধু মাঠ। নেই কোন জনপদ। বিশাল মাঠের উপর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে চলে গেছে রাস্তা, চলে গেছে দিগন্ত অতিক্রম করে, আমরা সেই রাস্তার উপর দিয়ে চলছি পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।      

ধোঁয়া
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=29

জল কালি
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=62

উড়ন্ত বন

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=207

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments