জ্বলদর্চি

ঘেঁটু /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল পর্ব -৮
ঘেঁটু

ভাস্করব্রত পতি

'ভাঁট আঁশ শ্যাওড়ার বন
বাতাসে কী কথা কয় বুঝি নাকো, 
বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে;
পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নাই আমি, 
হায়, এমন বিজন'। -- জীবনানন্দ দাশ

ঘেঁটুগাছ পরিচিত 'ভন্টাকি', 'ভাঁট', 'ভাঁইট', 'ভাঁইটা', 'ভাত ফুল', 'চৈতঘাড়া' 'বনজুঁই' গাছ নামেও। অনাদরে রাস্তার পাশেই এঁর জন্ম। ৪ ফুট দীর্ঘ গুল্মজাতীয় এই গাছটির উল্লেখ মেলে চরক সূত্রস্থান এর ২৬ তম অধ্যায়ে। শাখা প্রশাখা কম! শাখার অগ্রভাগে ৮ - ১২ ইঞ্চি লম্বা পুষ্পদণ্ড বের হয়। ফাল্গুন চৈত্র নাগাদ ঘেঁটু ফুলের দেখা মিলবে গ্রামাঞ্চলে। অথচ এই ঘেঁটুকে নিয়ে যে সংস্কৃতির বাতাবরণ, তা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। ঘেঁটুকে সংস্কৃতে বলে ‘ঘন্টাকর্ণ', 'ঘন্টুক' এবং 'ভাণ্ডীর'। ওড়িয়াতে 'গেঙ্গুটি'', ইংরেজিতে Hill Glory Bower, নেপালিতে রাজবেলি, হিন্দিতে 'ভাঁট ফুল' বলে। তবে লোকায়তিক নাম 'ঘেঁটু'। 

ভারত ছাড়াও এটির বাসস্থান হিসেবে মায়ানমার, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের নাম উল্লেখযোগ্য। এই ঘেঁটুর বিজ্ঞানসম্মত নাম Clerodendrum infortunatum। এছাড়াও এর অন্যান্য যেসব প্রজাতির দেখা মেলে, সেগুলি হল --
Clerodendrum viscosum Vent.
Clerodendrum calycinum Turcz.
Clerodendrum inerme
Lamiaceae গোত্রের সাদা ফুলটি গুচ্ছাকারে ফোটে। ভিন্ন ধরণের গন্ধ। সর্বাঙ্গই তেতো। ফলগুলো পাকলে ঘোর লাল রঙের হয়। প্রাচীন বৈদ্যগণের মতেও ঘেঁটুই হল ভাঁটফুল। আর 'ভাণ্ডীর' থেকে এসেছে 'ভাঁট' কথাটি। এই ঘেঁটু গাছের ফুলই ঘেঁটুঠাকুরের পূজার মূল উপকরণ।
বিভিন্ন এলাকায় চৈত্র মাস নাগাদ প্রচুর পরিমাণে জন্মে এই গাছ। রাস্তার ধারে নিতান্ত অযত্নে এবং অবহেলায় বেড়ে ওঠে এই গাছ। একসময় ঘেঁটু পূজার চল ছিল দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে। এখনও কিছু কিছু এলাকায় এই লােকাচার লক্ষ্য করা যায়। চর্মাদি রােগের অধিদেবতার নাম হল ঘেঁটুঠাকুর। ইনি আসলে মঙ্গলপুত্র। এই দেবতাকে ঘণ্টেশ্বর, ঘন্টাকর্ণ বলা হয়। শিব কর্তৃক সৃষ্ট ঘণ্টাকর্ণ ব্যাসদেবের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন শিবভূমি কাশী। এই ঘণ্টাকর্ণের দুকানে দুটি ঘণ্টা বাঁধা এবং মাথায় সােনার মুকুট। সেই থেকে প্রতিবছর ফাল্গুন সংক্রান্তিতে পুজো হয় ঘেঁটু পূজা। ঘেঁটু ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন শীতলাদেবীকে। 'স্কন্দপুরাণ’-এর ‘কাশীখণ্ড’তে এ তথ্য মেলে। 

দেহত্যাগের পর সতী ফের হিমালয়ের রাজকন্যা রূপে জন্মগ্রহন করেন। সেই শিবের সাথেই তাঁর বিয়ে হল। কিন্তু শিব তো ভয়ানক গরিব। দরিদ্র ভিক্ষুক। সেখানে বউটি হলেন রাজকন্যা উমা। ভিক্ষার অন্নে তাঁদের পেট চলে। ফলে উমা প্রমাদ গুনলেন। পিতা তথা হিমালয় রাজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উমা কাশীতে একটি নতুন পুরী নির্মান করেন। দুর্গাই তাঁর নাম দেন 'কাশীধাম'। শিব তা দেখলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে উমা তাঁর অনুচরদের নিয়ে সেই কাশীধামে বসবাসের জন্য যাবেন ঠিক করলেন তার আগেই তা দখল করে বসলেন ব্যাসদেব। তিনি সেখানে শিবনিন্দার সাথে সাথে শ্রীহরি বন্দনা শুরু করলেন। মহা বিপদ! কাশীধামে তখন শিবের 'নো এন্ট্রি'। প্রমাদ গুনলেন উমা। বাধ্য হয়ে শিব নিজের মহাশক্তি থেকে জন্ম দিলেন এক বিকট রুদ্রানুচরের। তাঁর মোটা মোটা পা। মুখখানি প্রায় নেই বললেই চলে। গলা নেই। লম্বা লম্বা বড় বড় দুটি ঘন্টা বাঁধা। সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেল 'ঘন্টাকর্ণ'। সেই ঘন্টাকর্ণ শিবের আদেশে চললেন কাশীধামে।

দারুনভাবে দুলতে লাগলো কানের ঘন্টা। বিকট তার আওয়াজ। সারা কাশীধাম চমকিত। ভয়ে ভীত। উদভ্রান্ত। সেইসাথে বড় বড় নিশ্বাস। যে যেদিকে পারলো ছুটে পালালো। বিপদ দেখে ব্যাসদেবও পালালেন কাশীধাম ছেড়ে। নগরী জনশূন্য হল ঘন্টাকর্ণের দাপটে। এরপর উমা এবং শিব এলেন কাশীধামে। শুরু হল জোর জনরোল। মুখরিত হল কাশীধাম।

মহাভারত রচনার বহু আগেই ভারতের অন্যতম চর্চিত এলাকা এই কাশীধাম। বৈদ্যশাস্ত্রের রচয়িতা ছিলেন কাশীরাজ দিবোদাস। কাশীকে ঘিরে পুরাণের এই কাহিনী আজও স্মরণযোগ্য। স্কন্দপুরাণের 'কাশীখল্ড'তেও হদিশ মিলবে ঘন্টাকর্ণ সম্পর্কে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গলে'ও আছে একটি সরস কাহিনী। সেই কাহিনীর নায়ক ঘন্টাকর্ণের কানের দুলের মতোই দেখতে ঘেঁটু গাছের ফুল। এটি একটি ভেষজ গাছ। নানা শারীরিক ব্যাধির নিরাময়ে ঘেঁটুর ব্যবহার প্রশ্নাতিত। এর শেকড় দিয়ে দাঁত মাজলে খুব উপকার মেলে। 

পুরাণের ঘন্টাকর্ণের কাহিনীকে স্মরণ করেই প্রতিবছর ফাল্গুন সংক্রান্তি তথা 'ঘেঁটু ভাঙা সংক্রান্তি'তে এই বাংলায় পূজো করা হয় ঘন্টাকর্ণ বৃক্ষ বা ঘেঁটু গাছকে। কোথাও কোথাও ফাল্গুন সংক্রান্তির পরে তিনদিন ধরে বা সাতদিন ধরে ঘেঁটুর পূজা হয়। তবে পূজা চলাকালীন বৃষ্টি হয়ে গেলে ঐ বছরের মতো স্থগিত করে দেওয়া হয় পূজা। কেননা, বৃষ্টির জলে ঘেঁটু অন্ধ তথা কানা হয়ে যায়। আর 'কানা ঘেঁটু'র পূজা হয়না। আশুতোষ ভট্টাচার্য ঘেঁটু পূজার সময় হিসেবে ফাল্গুন সংক্রান্তিকে তুলে ধরলেও আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তাঁর 'চিরঞ্জীৰ বনৌষধি'তে লিখেছেন ঘেঁটুপুজা হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন যে, চৈত্র মাসের কুড়ি তারিখে ঘেঁটুর পূজার কথা। 'গণদেবতা'তে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'সমস্ত মাস ধরিয়া ঘেঁটুর গান গাহিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া বেড়ায়। চাল, ডাল, সিধা মাগিয়া মাসান্তে গাজনের সময় উৎসব করে'। যেহেতু গাজন হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে, তাই 'সারা মাস' অর্থে চৈত্রকেই বোঝাচ্ছে। তিনি 'হাঁসুলি বাঁকের উপকথা'তেও লিখেছেন, 'চৈত্র আসছে ঘেঁটু গানের পালা। তারই উদ্যোগপর্ব চলছে'। তবে দার্জিলিং জেলায় নেপালীরা শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীর দিন 'গঠে মঙ্গল' অর্থাৎ ঘন্টাকর্ণ পূজা করে। জীবনানন্দের কবিতায় আছে, 'ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায় / বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো কেঁদেছিল তার পায়'। 
চর্মাদি রােগের অধিদেবতার নাম হল ঘেঁটুঠাকুর। ইনি আসলে মঙ্গলপুত্র। এই দেবতাকে ঘণ্টেশ্বর, ঘন্টাকর্ণ বলা হয়। তিনি খোস পাঁচড়ার দেবতা। এই ঘেঁটু ঠাকুরের বিয়ে হয়েছিল শীতলার সাথে। তিনি আবার বসন্ত বা মসূরিকা রোগের দেবী। এই বসন্তও এক প্রকার চর্মরোগ। বসন্তকালেই দেখা যেত। এখন অবশ্য প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে রোগটি। স্বামী স্ত্রী দুজনেই চর্মরোগের দেবদেবী। বসন্তকালেই দেবী শীতলা প্রাণীদের দয়া করতেন। লোকে বলত 'মায়ের দয়া' হয়েছে। অর্থাৎ বসন্ত হয়েছে। একসময় ভরা ফাল্গুনে সাধারণ মানুষের চর্মরোগের প্রাদুর্ভাব হত। তা থেকে রেহাই পেতে মানুষ ঘেঁটু পূজার প্রচলন করে। বলা বাহুল্য, চর্মরোগ বা চুলকানি, খোস পাঁচড়া, কুষ্ঠের উপশমে ঘেঁটু গাছের ভূমিকার কথা জানতো গ্রামবাসীরা। একসময় যে গ্রামবাংলায় মানুষজন বিব্রত থাকতো চর্মরোগ নিয়ে, তা বোঝা যায় ঘেঁটুঠাকুরের মতো দেবতার বাড়বাড়ন্ত উপচার দেখে। এ ধরনের অধিদেবতার পূজার্চনা আজকাল তেমন নেই চর্মরোগের নানা ঔষধ আবিষ্কৃত হওয়ায়। একদিকে দৈবিক ঘটনা, অন্যদিকে ভেষজ উপকারিতা -- এই দুইয়ের মাঝে পড়েই কি রোগ উপশমে ঘেঁটুপূজার প্রচলন শুরু হয়েছে? 

ঘেঁটুগাছ যে একসময় আমাদের সমাজ জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। দিন বদলের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন লোকায়তিক উপচার। হয়তো একদিন দূরন্ত গতির নগরায়নের প্রভাবে রাস্তার পাশ থেকে হারিয়ে যাবে নিতান্ত অপাংক্তেয় এই 'ঘেঁটুগাছ'। আর হারিয়ে যাবে ঘেঁটু তথা ঘন্টাকর্ণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক লোকায়তিক সংস্কৃতি। কেবল কবি জীবনানন্দ দাশ ‘কোথাও মাঠের কাছে’ কবিতায় রয়ে যাবে ঘেঁটু তথা ভাঁট ফুলের কথা -- 
‘বেতের বনের ফাঁকে- 
জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায় 
রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায়, 
সাদা ভাট পুষ্পের তোড়া …’।

Post a Comment

0 Comments