বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯৫
বিজ্ঞান প্রেম মানুষ ইত্যাদি
পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা
(১)
সাউন্ড অব আর্থ
"বেহায়া! হতচ্ছাড়ি! পোড়ার মুখী! চরিত্রহীনা! কুলটা! কী নামে ডাকব তোকে? লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে কেন গেলি রেকর্ড রুমে? এতটুকু লজ্জা-শরমের বালাই থাকতে নেই! পুরো বিশ্বের কাছে নিজের সতীত্ব বিকিয়ে এলি? কী আস্পর্ধা!
চুম্বন করলি গোপনে, ঠিক আছে। তা বলে, সে-চুম্বনের রেকর্ড তৈরি করে গোটা পাড়া (পড়ুন, মহাবিশ্ব) বিলিয়ে আসা! এ কেমন বেহায়াপনা; শুনি! এতে কার না মাথা গরম হবে, বল দেখি! এত বড় ধাংড়ি মেয়ে হয়েছিস। এতকাল তোকে লোকচক্ষুর আড়ালে সযত্নে লালনপালন করে বড় করেছি। এখন সোমত্থ হয়েছিস। ভালো সম্বন্ধ দেখে দু'দিন পরে বে-থা'র কথাবার্তা পাড়া হবে। তার আগেই একটা উটকো ঝামেলা পাকিয়ে ফেল্লি! ভালো করেই জানিস― পাড়ায় (পড়ুন, পৃথিবীতে) একটা সম্মান আছে আমাদের। সকলে খুব সম্ভ্রম করে চলে তোর বাবাকে, আমাকে। কই, কেউ একটা কটু কথা বলবার সাহস পেয়েছে এতকাল? অথচ আজ যা করলি, সমাজে লোকের কাছে মুখ দেখাব কী করে! ঘটে কি তোর গোবর ভরা আছে? জ্ঞান গম্যি কবে হবে কে জানে!
হা ভগবান! কী সব্বনাশ হলো গো আমার। তুমি সব জান্তা, করুণাময়ী। অন্তরভেদী। দীনের উদ্ধার কর্তা। রক্ষা কর, হে প্রভু। রক্ষা কর। এ যাত্রায় বিপদ থেকে উদ্ধার করো। সকল শঙ্কা বিনাশ করো।"
উপরের সংলাপগুলো হয়তো কাল্পনিক, কিন্তু বিপথগামী মেয়ের পরিবারে ভীষণ রকম বাস্তব! ব্যাপারটা কী?
ভালোবাসার চুম্বনের আওয়াজ কেমন হবে? খাঁটি প্রেমের চুম্বনের শব্দ কি আলাদা? চুম্বন কি শুধু যৌন চাহিদা আংশিক পূরণের একটা ব্যবস্থা মাত্র? না-কি, চুম্বনেরও রকম ভেদ আছে? কালচার ও প্রতিযোগিতা-তর্কবিতর্কের উপর যার যাবতীয় সত্তা লুকিয়ে থাকে! নিঃশব্দ চুম্বনের গভীরতার পাল্লা বেশি, না-কি সশব্দ চুমুর তীব্রতা? পৃথিবী জুড়ে যত রকমের ভালোবাসা আছে; তাদের সবার আওয়াজ কি অভিন্ন? এমনতর হাজারো প্রশ্নে উদ্বিগ্ন মিস অ্যান ড্রুয়ান (জন্ম – ১৩ জুন ১৯৪৯)-এর অশান্ত মন।
ভয়েজার মহাকাশযানের গোল্ডেন রেকর্ড-প্লেট
সেটা ১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মের ঘটনা। খুশির খবরটা শুনলে আনন্দে নির্ঘাৎ বাকরুদ্ধ হবেন নাসার ভয়েজার স্পেস-প্রোজেক্ট ডিরেক্টর জ্যোতির্বিজ্ঞানী
ড. কার্ল সাগান (১৯৩৪–১৯৯৬)। খুশির খবরটা কী? আড়াই হাজার বছরের পুরনো মিউজিকের একটি কলি 'ফ্লোয়িং স্ট্রিম' (Flowing Stream)। চাইনিজ ভাষায় বাজানো। তিল তিল করে খুঁজে মিলেছে এ ধরনের এক ইউনিক পিস আইটেম। খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটে গেছে মিস অ্যান ড্রুয়ান-এর। ওফ! বহু কষ্টে পাওয়া গেছে সেটি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। সত্যিই এক রেয়ার কালেকশন! এ হেন দুর্লভ মিউজিক উদ্ধার করে রীতিমত উত্তেজিত মিস ড্রুয়ান। নিজের উত্তেজনা গোপন রাখা মুশকিল হচ্ছে তাঁর। ড. সাগন'কে তথ্যটি শেয়ার করতে ল্যান্ডফোনে ডায়াল করলেন মিস ড্রুয়ান। অন্যথায় তাঁর এ উত্তেজনা প্রশমিত হবার নয়। গুরুত্বের দিক থেকে অজ্ঞাত বৈজ্ঞানিক ঘটনা আবিষ্কারের তুলনায় কোনও অংশে কম নয় তাঁর এ অনুসন্ধান। ওদিকে, হোটেলের রুমে টেলিফোন বেজে বেজে কখন যে বন্ধ হয়ে গেল! ফোনকল কেউ রিসিভ করল না। অগত্যা হোটেলের রিসেপশনে টেলিফোন মারফত একটি সংলাপ-মেসেজ রেখে নিজের কাজে মন দিলেন ড্রুয়ান। যদিও অস্থিরতা তাঁর মনে, হৃদয়ে।
ঘণ্টা খানেক বাদের ঘটনা। হোটেলে ফিরে এসেছেন ড. সাগন। রিসেপশনে মেসেজ দেখে তক্ষুনি ফোন ডায়াল করলেন তিনি:
― 'হ্যালো! মিস ড্রুয়ান, বলুন?'
―'মি. সাগন, সত্যি বলছি একটি গ্রেট ইউরেকা মোমেন্ট! একটি বড় সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটেছে আজ'― চিৎকার করে গড় গড়িয়ে সব কথা বলে গেলেন মিস ড্রুয়ান; ফোনের ও প্রান্ত থেকে। কারণ তখনও তাঁর উত্তেজনা স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ নেই। এ হেন ফোনকলের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে বৈকি! ওই ফোনকলের সূত্র ধরেই মিস অ্যান ড্রুয়ান আর ড. কার্ল সাগন প্রেমে পড়লেন। একঘণ্টা আগেও দুজনে সম্পূর্ণ প্রফেশনাল এবং ভালো বন্ধু ছিলেন। ড. সাগন ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড প্রোজেক্টের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আর মিস ড্রুয়ান তার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। অথচ, ফোনকলের অব্যাবহিত পরে দুজন দুজনের অন্তরঙ্গ হলেন। কোয়ালিটি সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন তার পর। চার বছরের প্রেম পর্ব শেষে চার হাত এক হল ছাতনা তলায়। সেটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। চার্চে বিয়ে সারলেন তাঁরা। বহুচর্চিত তাঁদের শাশ্বত প্রেমের গোল্ডেন সময়ের বাতি নেভে ১৯৯৬ সালে, ড. সাগন-এর মৃত্যুতে। তবে তাঁদের বিখ্যাত প্রেমের কাহিনী শেষ হয়েও শেষ হল না। কারণ প্রথম প্রেমে পড়ার মিস অ্যান ড্রুয়ান-এর সেই দুর্দান্ত অনুভূতিকে অমরত্বের শিরোপা দিয়েছে মহাকাশ যান ভয়েজার।
গভীর প্রেমের সুক্ষ্ম অনুভূতি ধরা রয়েছে ভয়েজারের গোল্ডেন প্লেট রেকর্ডে। যদিও আইডিয়াটা সম্পূর্ণ মিস ড্রুয়ান-এর। ভালোবাসার চুম্বনের আওয়াজ কেমন হবে? খাঁটি প্রেমের চুম্বনের শব্দ কি আলাদা? চুম্বন কি শুধু যৌন চাহিদা আংশিক পূরণের একটা ব্যবস্থা মাত্র? না-কি, চুম্বনেরও রকম ভেদ আছে? কালচার ও প্রতিযোগিতা-তর্কবিতর্কের উপর যার যাবতীয় সত্তা লুকিয়ে থাকে! নিঃশব্দ চুম্বনের গভীরতার পাল্লা বেশি, না-কি সশব্দ চুমুর তীব্রতা? পৃথিবী জুড়ে যত রকমের ভালোবাসা আছে; তাদের সবার আওয়াজ কি অভিন্ন? প্রেমে পড়লে ব্রেনের গ্রাফ কেমন হবে? এমনতর হাজারো প্রশ্নে উদ্বিগ্ন মিস অ্যান ড্রুয়ানের অশান্ত মন। নারী কিংবা পুরুষ― যে কেউ প্রথম প্রেমে পড়লে তার সুক্ষ্ম আবেগের কারণ কী? প্রেমে পড়লে হৃদয়-মন কেন উৎফুল্ল থাকে, মস্তিষ্কের কোষ কেমন আচরণ করে, প্রেমের টিউনে কতটুকু উত্তেজিত থাকে ব্রেনের নিউরনগুলি ― এমন সব উদ্ভট আজগুবি অথচ সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি ধরে রেখেছে ভয়েজার।
মিস অ্যান ড্রুয়ান (জন্ম – ১৩ জুন ১৯৪৯) এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিস্টার কার্ল সাগন (১৯৩৪–১৯৯৬)
আড়াই বছরের পুরাতন ওই চাইনিজ সংগীতটি একজন বৈজ্ঞানিকের জীবনে গ্রেট সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের চাইতে তাই কোনও অংশে কম উত্তেজনা বয়ে আনলো না! এমনই তার ক্রেজ! মাহাত্ম্য! কারণ, এর হাত ধরে নতুন করে তাঁর প্রেমে পড়া। মিষ্টি প্রেমের সদর্ভ ঘোষণা দুজনের। সেই বিখ্যাত প্রেমালাপের কয়েক দিন পরের ঘটনা। ৩-রা জুন ১৯৭৭ সাল। নিউইয়র্ক সিটির বেলভিউ হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটলেন ড্রুয়ান। উদ্দেশ্য খুব সিম্পল ― মানুষের ব্রেন ও নার্ভ সিস্টেমের ইলেকট্রিক্যাল পালস্ গণনা। সেই পালস'কে প্রথমে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত করা। তারপর উৎপন্ন তরঙ্গকে ভয়েজার-এর গোল্ডেন রেকর্ডে ধরে রাখা। হাজার মিলিয়ন বছর পরে রেকর্ডটি যখন দূর গ্রহস্থিত কোনও এলিয়েন-এর হাতে পড়বে, তখন তার মধ্যে সদ্য প্রেমে পড়া মিস ড্রুয়ান-এর অনুভূতির টাটকা তথ্যখানি সহজে যেন চিন্তায় বদলে ফেলতে পারে অজানা প্রাণীটি― হাসপাতালের বেডে শুয়ে এ কথা ভাবছিল সে। একটু বাদে তাঁর মেডিটেশন শুরু হল। মেডিটেশন চলাকালে সারাক্ষণ 'The wonder of love, of being in love' ভাবছিল সে। অর্থাৎ, প্রেমে পড়া সে তখন প্রেমের বিস্ময়ের কথা ভাবছে। একটু পরেই তাঁর শরীর, মন ও ব্রেনের সাউন্ড রেকর্ড করে বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে প্রেমের আবেগ আপলোড করা হয়েছিল ভয়েজার মহাকাশযানের গোল্ডেন প্লেটে।
(২)
"তুমি আশা,
তুমি আমার জীবন।'
শুনে সে বলল :
'এতদিন তোমার জন্যেই
আমি হাঁ করে বসে আছি।" — কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা 'যেতে যেতে'। উপরের লাইন ক'টায় অমর ভালোবাসার যে-আবেগ চিত্রায়িত হয়েছে, তার কারণ বা উৎস কী? ভালোবাসা কি শুধুই পারস্পরিক নির্ভরতা? কোত্থেকে আসে তেমন প্রেরণা? ভালোবাসা কি দ্বিমুখী? একমুখী ভালোবাসার কি অস্তিত্ব থাকতে নেই? প্রেমময় ভালোবাসার সংজ্ঞা ও প্রকৃতি কেমন? 'ক্লাউড নাইন'ই বা কী? এমন হাজারো প্রশ্ন মনে ভেতর ঝাঁকের কই-এর মতো উদয় হয়।
মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে নাকি 'ক্লাউড নাইন'-এ থাকে। ক্লাউড নাইন! সে আবার কী জিনিস? হঠাৎ প্রেমে পড়া মানুষ ভালোবাসার এত অনুভূতির সমুদ্রে ডুবে থাকে যে, মানসিক সুখের সপ্তম আকাশে বিরাজ করে সে। স্বর্গসম এ হেন মানসিক অবস্থার নাম 'ক্লাউড নাইন'। তাহলে ক্লাউড নাইনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী হবে? মানুষের আবেগ, অনুভূতি আর প্রেম বা ভালোবাসার কলকাঠি নাড়ে শরীরের কোন অংশ অথবা কোন উপাদান? প্রেমে পড়লে গাল লাল হয়ে যায় কেন? কেন হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায়? প্রেমে পড়ার সঙ্গে হাতের তালু ঘেমে ওঠার কী সম্পর্ক? কীভাবে এত কাণ্ড ঘটে? একটার সঙ্গে আরেকটার কী সম্পর্ক?
আসলে প্রেমে পড়া মানুষের একধরনের প্রবৃত্তি। প্রেমে-পড়া-মানুষের শরীরের ভেতরে এক গণ্ডা রাসায়নিক পরিবর্তনের রহস্যময় ব্যাপার স্যাপারই প্রেমে পড়ার জন্য দায়ী। যদিও এর পেছনে মাস্টারমাইন্ড মূলত একজনই। গুটিকয়েক হরমোন ও রাসায়নিক উপকরণ। নিঃসৃত হরমোনের কারসাজিতে মানব শরীরে-জীবনে একগুচ্ছ পরিবর্তন বয়ে আনে।
প্রেমময় ভালোবাসা ❤️
এ প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখ্য রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ হেলেন ফিশার এবং স্নায়ুচিকিৎসক লুসি ব্রাউন, আর্থার অ্যারোন প্রমুখ বৈজ্ঞানিক। প্রেমে পড়া স্টুডেন্টদের উপর তাঁদের গবেষণার ফলাফল রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। কী সেই রিসার্চের রেজাল্ট? প্রত্যেকের ভালোবাসার মানুষটির সুন্দর একখানা ছবি রাখা হয় একঝাঁক প্রেমিক-প্রেমিকার সামনে। ওই সময় তাদের মস্তিষ্কের ফাংশনাল এমআরআই (fMRI) পরীক্ষা করা হয়। তাতে এক অদ্ভূত রেজাল্টের সন্ধান মিলল। দেখা গেল, এ সময় তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল ও কডেট অংশ উদ্দিপ্ত হচ্ছে। উদ্দিপিত জায়গা থেকে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামের এক রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ গভীর তাৎপর্য বহন করে। ডোপামিন নিঃসৃত হলেই যে মানুষ প্রেমে পড়বে, তা অবশ্য নয়। নন-রোমান্টিক কারণেও, যেমন গাঁজা কিংবা কোকেইন সেবন, ডোপামিন নিঃসৃত হয়। তখন ভালোবাসায় আক্রান্ত মানুষের আচরণ, ডোপামিন নিঃসরণে, তীব্র ঘোরের ভেতর আবর্তিত হতে থাকে। তাই বলা যায় — ভালোবাসার রসায়নের ভিত্তি প্রস্তর অক্সিটোসিন, ভাসোপ্রেসিন সহ একগুচ্ছ হরমোন। এখন প্রশ্ন হল তীব্র প্রেমের অবকাশগুলোতে কেন দ্বিগবিদ্বিগশূন্য নেশার ঘোর লাগা ভাবের উদয় হয়? কেন বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারে লোপ পায়? আসলে এর নেপথ্যের কারণ খুব জটিল এবং কঠিন। প্রেমে পড়া থেকে শুরু করে পরিণতি অব্দি বিভিন্ন পর্যায়ের কার্যকলাপ বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদানের সমষ্টিগত গণিতের কারসাজি।
🍂
আরও পড়ুন 👇
বিজ্ঞান মতে, প্রেমের তিনটি স্তর। প্রতিটি স্তরে ভিন্ন ভিন্ন জৈব রাসায়নিক উপকরণের খেলা।
প্রেমজ জৈবিক পরিবর্তনের প্রথম ধাপ লালসা কিংবা ভালোবাসার ইচ্ছে। এর জন্য প্রত্যক্ষভাবে কেউ দায়ী নয়। পুরো দোষ লালসা জাগানিয়া দুটি হরমোনের। টেস্টোস্টেরন আর ইস্ট্রোজেন। টেস্টোস্টেরন হরমোনের ক্ষরণ ঘটে স্তন্যপায়ী প্রাণীর বেলায় পুরুষের শুক্রাশয়ের লিডিগ কোষ এবং নারীর ডিম্বাশয় থেকে। স্বল্প পরিমাণে টেস্টোস্টেরন ক্ষরিত হয় অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। নারী শরীরের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হরমোন ইস্ট্রোজেন। মহিলা হৃদয়ে যৌন আকাঙ্ক্ষা উৎপন্ন করে এই হরমোন। হরমোন দুটির প্রভাবে ভালোবাসার কবলে পড়লে মানুষ এমন ভাবে তাড়িত হয় যে সে মহানুভবতা কিংবা হিংস্রতা প্রদর্শন করে।
প্রেমে পড়ার দ্বিতীয় ধাপ আকর্ষণ। লালসার কারণে মানুষ একে অপরকে দৃঢ়ভাবে আকর্ষণ অনুভব করে। ভালোবাসার মানুষ ব্যতীত বিকল্প চিন্তা তার মাথায় আসে না। নাওয়া-খাওয়া, ঘুমোনো সবকিছু ভুলে যাওয়া স্রেফ জলভাত। এসময় একমাত্র প্রায়োরিটি ভালোবাসার মানুষ। তার ভাবনায় চব্বিশ ঘণ্টা আচ্ছন্ন থাকে মন। এই পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয় একগুচ্ছ স্নায়ুকোষ – মনোয়ামাইন। এদের অন্যতম স্নায়ুকোষ হল ডোপামাইন। এ হেন স্নায়ুকোষ প্রেমানুভূতিতে যে-সাড়া দেয়, তা কোকেন কিংবা নিকোটিনের প্রভাবে সৃষ্ট প্রেমের অনুভূতির চাইতে কোনো অংশে কম নয়। ডোপামাইন সক্রিয় হলে নড়েচড়ে বসে অ্যাড্রিনালিন। এ হেন হরমোনের প্রভাবে হাতের তালু ঘামতে শুরু করে। গাল লাল হয়ে যায়। হৃদস্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পায়। আকর্ষণের এই ধাপে প্রেমাসক্ত যুগলকে সাময়িক পাগল বানিয়ে ফেলে এক রাসায়নিক উপাদান। তার নাম সেরোটোনিন।
সম্পর্কের শেষ তথা উচ্চতর মার্গ সম্পৃক্ততা অথবা সংযুক্তি। সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ধারিত হয় এই স্তরে। বিয়ে ও সংসারের স্বপ্নে বিভোর থাকে প্রেমিক-যুগল। এই পর্যায়ে সম্পর্কে স্থায়িত্ব আনয়নের জন্য পুরো কৃতিত্ব দুটি হরমোনের। ভাসোপ্রেসিন ও অক্সিটোসিন। সন্তান প্রসবের সময় মাতৃদেহ থেকে নির্গত অক্সিটোসিন নামক উদ্দিপকের জন্য মায়ের সঙ্গে সন্তানের মধুর বন্ধন তৈরি হয়।
দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে হরমোনের পাশাপাশি মানুষের জিন বড় ভূমিকা পালন করে। জিন আর হরমোনের যুগলবন্দী ও যুগ্ম তথ্য সম্পর্কের ভবিষৎ বাতলে দিতে সক্ষম। যদিও এখনও সহজলভ্য নয় এই বিজ্ঞান।
প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রভাব বেশি গুরুত্ব পায়। সুন্দর চেহারা প্রেমের অনুঘটকের মতো কাজ করে। ভূমিকা আছে গন্ধেরও। শব্দ ও স্পর্শের যোগ সম্পর্কে অন্য মাত্রা বয়ে আনে। মানসিক অসুস্থতায় মানুষের মাথা কিংবা ব্রেন যেভাবে কাজ করে, প্রেমে পড়লে মাথা ও ব্রেন একই রকম উত্তেজিত থাকে। এই রকম উত্তেজনার কী কারণ? শরীরে, মাথায়, হৃদয়ে এত এত রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে কার ইশারায়? কে বা কী চালিত করে মন? এর পেছনে রয়েছে একটি ফিল্ড। মানুষের হৃদয় থেকে নিঃসৃত তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র। আবেগের মাত্রার উপর নির্ভর করে কতখানি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড উৎপন্ন হবে এবং কতদূর পর্যন্ত সেটা বিস্তৃত হতে সক্ষম? কখনও কখনও মানুষের শরীরের চতুর্দিকে কয়েক ফুট পর্যন্ত এই ফিল্ডের রেশ পাওয়া যায়।
তা না হয়, হল। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। চোখ বন্ধ রেখে প্রেমে পড়া যায় কি? তাহলে প্রেমের সঙ্গে মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের কী সম্পর্ক?
(৩)
সখি, ভাবনা কাহারে কয়?
ভালোবাসা একধরনের ইতিবাচক অনুভূতি। এ হেন ইতিবাচক আবেগের পেছনে এক গোপন তাগিদ কাজ করে। ভালোবাসায় মনুষ্যের ভিতর যেমন অফুরান শক্তি সঞ্চালিত হয়, তেমনি নিজের ভেতরকার সুপ্ত শক্তিও আত্মপ্রকাশ করে। জাগ্রত হয় নব উদ্যম। এখন প্রশ্ন হল, কোত্থেকে আসে এত এত শক্তি? কীভাবে সঞ্চারিত হয় দেহ-মনে? শক্তি সঞ্চারণে আবেগের কতখানি ভূমিকা? আবেগের বহিঃপ্রকাশ কার ইশারায় ঘটে? আবেগ ছাড়া আর কী কী উপাদান শক্তি সঞ্চালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
আবেগ সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। অনেকে আবেগের সঙ্গে অনুভূতিকে গুলিয়ে ফেলে? বাস্তবে আবেগ এমন এক মানসিক অবস্থা, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্ভব হয়; সচেতন উদ্যম থেকে নয়। এর সঙ্গে কখনও কখনও বক্তার শারীরিক পরিবর্তন প্রকাশ পায়। সেক্ষেত্রে আবেগকে অনুভূতির উৎস বলা যায়; যদিও অনুভূতি শারীরিক ও মানসিক উভয়ই হতে পারে। সুতরাং, আবেগ মূলত মানসিক। তাই বলা যায়, শারীরিকভাবে মসৃণ পেশী এবং বিভিন্ন গ্রন্থির কারণে শরীরের অন্তর্নিহিত পরিবর্তনই হল আবেগ। সামগ্রিকভাবে চেতনার যে অংশ অনুভূতি বা সংবেদনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, তাকে আবেগ বলে।
শরীর-মনে আবেগের আমদানি পাঁচখান উপাদান নির্ভর। আবেগের মানসিক বা আত্মনিষ্ঠ অনুভূতি। শারীরিক উত্তেজনা। শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি। মৌখিক-ভাষাগত-অঙ্গ সঞ্চালনমূলক বহিঃপ্রকাশ। এবং সংশ্লিষ্ট প্রেষণামূলক অবস্থা। এ হেন উপাদানগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটে হরমোন-সহ একগুচ্ছ রাসায়নিক উপাদানের ক্রিয়া-বিক্রিয়ার খেলার উপর। উপকরণগুলোর প্রভাবে যে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, তা মনুষ্য-জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বদলে ভুমিকা রাখে। আবেগ নির্ভর অনুভূতি বহিঃপ্রকাশে যে-দুটি হরমোনের অবদান সবচাইতে বেশি, তাদের একটি স্ত্রী হরমোন – ইস্ট্রোজেন এবং অন্যটি পুরুষ হরমোন – টেস্টোস্টেরন।
নারী পুরুষের শারীরিক গড়ন নির্ভর করে এই দুই হরমোনের আনুপাতিক ভাগ-হারের উপর। যে সকল রাসায়নিক উপাদানের বিক্রিয়ার ফলে প্রেম-ভালোবাসা এবং তীব্র মানসিক আবেগ-অনুভূতিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিয়ন্ত্রিত হয়; তাদের অন্যতম এমফিটামিনস, ফিনাইলথ্যালামিন বা পি-পদার্থ, নরইপিনেফ্রিন, অক্সিটোসিন, সেরোটোনিন ইত্যাদি।
মোহণীয় চাহুনি কিংবা হাসির আবেদনে অপটিক স্নায়ুকোষের মধ্য দিয়ে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে যখন তড়িৎ সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছয়, অথবা হঠাৎ স্পর্শে যখন স্বল্প মাত্রার ইলেকট্রিক সিগন্যাল ক্ষণিকে ব্রেনে এসে হাজির হয়, মস্তিষ্কে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমফিটামিনস-এর নিঃসরণ ঘটে। সেই সঙ্গে নিঃসৃত হয় ফিনাইলথ্যালামিন বা পি-পদার্থ এবং নরইপিনেফ্রিন। ক্ষরিত পি-পদার্থ আদপে ভালোবাসার তীব্র আকুলতা জাগায়। এ হেন পদার্থের স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণ মাত্রা সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত হ্রাস পায়। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি – একই মুখ, একই চোখ, একই স্পর্শে প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা কমতে থাকে। এমনকি বিচ্ছেদের অশনিসংকেত বেজে ওঠে। এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও যদি ভালোবাসা দীর্ঘায়িত হয়, অদৃশ্য মায়ার বাঁধন শক্ত থাকে; তাহলে তার পেছনে পি-পদার্থের কোনো ভূমিকা নেই। পর্দার আড়াল থেকে তখন হাজির হয় অন্য দুই মুখ — এন্ডরফিনস নামের ব্রেনের রাসায়নিক উপাদান এবং অক্সিটোসিন হরমোন।
ভালোবাসার মানুষদ্বয়ের ভিতর শান্ত সৌম্য নিরাপত্তার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এন্ডরফিনস। সম্পর্কে স্থায়িত্ব এনে দেয়। পি-পদার্থের মতো উত্তাল অনুভূতি তৈরি করে না। উল্টোদিকে, দাম্পত্যে পারস্পরিক সহানুভূতি এবং যত্নশীল হওয়ার পেছনে অক্সিটোসিন হরমোনের বড় হাত রয়েছে। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে যত বেশি অক্সিটোসিন নিঃসৃত হবে, তত বেশি মজবুত হবে সম্পর্ক। উভয়ে পরস্পরের কাছে যাবে। অনেক সময় অব্যাহত অকৃত্রিম দেহমিলনের ফলে দরকারি রাসায়নিক উপকরণ দেহের ভেতর উৎপন্ন হয় এবং এন্ডরফিনসের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় অক্সিটোসিন হরমোন। যদিও ক্রোধ, উত্তেজনা অথবা মানসিক চাপে অ্যাড্রিনালীন হরমোন বেশি মাত্রায় নিঃসরণ হয়। এদিকে, অ্যাড্রিনালীন হরমোনের নিঃসরণ অক্সিটোসিন নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করে। ক্রোধে অন্ধ মানুষের শরীরের অক্সিটোসিনের অভাব ভালোবাসার টান, উত্তেজনা শিথিল করে। বরং প্রেমিক প্রেমিকার হাতে হাত, চোখে চোখ, নিবিড় আলিঙ্গন, একসঙ্গে রোমান্টিক মুভি দেখায় অক্সিটোসিন লেভেল বাড়ে। সেজন্য সম্পর্কের শিথিলতায় বেরসিক সঙ্গীকে অযথা দোষারোপ না করে দেহে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষরিত না হওয়া অক্সিটোসিন লেভেলকে দোষী সাব্যস্ত করা উচিৎ।
অনেক সময় মনে বাড়তি উল্লাস তৈরি করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে জরুরী উপকরণ সেরোটোনিন। অল্প বিস্তর গোটা শরীরে (মূলত পেটে) ক্ষরিত সেরোটোনিন যৌন কামনা-বাসনা সৃষ্টি করে। এর নিঃসরণ কমে যাওয়া যৌন অনুভূতির ঘাটতি বয়ে আনে। রোমান্স আর সেক্সী মেজাজ নির্মাণ করে আরও এক রাসায়নিক উপকরণ – ডোপামিন। মূলত সেরোটোনিন ও ডোপামিনের বদৌলতে ভালোবাসার অফুরন্ত সুবাতাস বয় প্রাণে। সুস্থ মনের জন্য এই জৈব রাসায়নিক পদার্থ দুটির স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ মাত্রার নিঃসরণ একান্ত জরুরী।
(৪)
গবেষণায় প্রকাশ — একজন মানুষ বিপরীত মেরুর তথা লিঙ্গের আরেকজনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মস্তিষ্ক মোট চার মিনিট নব্বই সেকেন্ড সময় নেয়। প্রেমে পড়ার জন্য কিছু বিষয় বিবেচনা করে। তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ হচ্ছে অঙ্গ-ভঙ্গি এবং বাহ্যিক রূপ। বাকি ৩৮ শতাংশ কণ্ঠস্বর , কথা বলার ভঙ্গি। মাত্র সাত শতাংশ আকৃষ্ট হয় মূল বক্তব্য ও ব্যক্তিত্বের জোরে।
সর্বোপরি প্রেমে পড়লে তবেই কিনা দেহ মনে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া! তারপর হরমোন নিঃসরণ। রাসায়নিক উপকরণ ক্ষরণ! এসবের জন্য সবার আগে প্রেমে পড়া জরুরী। প্রেমে পড়ার রসায়ন কী? আজ পর্যন্ত এর কোনো সদুত্তর নেই। কালো মানুষেরও প্রেমে পড়তে পারে দেখতে-সুন্দর তথাকথিত ফর্সা নর-নারী। তার বেলা! প্রেমে পড়ার জন্য একটা ক্ষণই যথেষ্ট; সেখানে জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ-গন্ধ-ধনী-গরীব-উঁচু-নীচু-বয়স ফ্যাক্টর করে না। দেখতে হবে – প্রেমে পড়লে যেন গাল লাল হয়ে যায়। হৃদস্পন্দনের গতি যেন বাড়ে। হাতের তালু যেন ঘর্মাক্ত হয়।
তাই, দেহ-মনের জটিল রসায়নের মূলমন্ত্রে সারাবছর উজ্জিবিত হোক চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি। অকৃপণ প্রেমের অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গ উদ্ভাসিত হোক প্রতিটি প্রেমময় হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে। সুস্থ সুখী দাম্পত্যের মজবুত চৌকাঠে পূর্ণতা পাক চিরকাঙাল ভালোবাসার বাড়ি।
তথ্যসূত্র :
(১) সৃষ্টির পথ — সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র
(২) ভালোবাসাও বিজ্ঞান, ভালোবাসার বিজ্ঞান, ভালোবাসার বিজ্ঞান দর্শন ইতিহাস, ভালোবাসার ব্যবচ্ছেদ প্রভৃতি অনলাইন পেজ
(৩) উইকিপিডিয়া
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments