জ্বলদর্চি

বসন্ত কুমার সরকার (স্বাধীনতা সংগ্রামী, গড়বেতা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯৪
বসন্ত কুমার সরকার (স্বাধীনতা সংগ্রামী, গড়বেতা) 

ভাস্করব্রত পতি

আজকের গড়বেতা কলেজ স্থাপনে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। ১২.৮৮ একর জমি দান করেছিলেন তিনি। এখানকার সন্ধীপুর এলাকায় তাঁরই উদ্যোগে স্থাপিত হয় নেতাজীনগর শ্রীপতি শিক্ষা সদন। এই সন্ধীপুরে ভবানী মেলার সূচনা করেন বসন্ত কুমার সরকারের ভাই রাঘব চন্দ্র সরকার। ভাইকে পাশে নিয়েই মেদিনীপুর হুগলি সীমান্তবর্তী এলাকায় সাম্প্রদায়িক হিংসা থেকে বাঁচাতে ১৯৪৬ সালে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। সন্ধিপুরের মানুষ তাঁকে চেনে 'বীরপুরুষ' নামে। 

১৮৮৬ এর ১৮ ই মে গড়বেতার সন্ধিপুর অঞ্চলের কাতরাবালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী বসন্ত কুমার সরকার। যদিও আজ তাঁর জন্মদিন পালন হয়না। কেবল অনাড়ম্বর ভাবে মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। এই অকুতোভয় দেশপ্রেমিকের মৃত্যু হয় ১৯৬৫ এর ৫ ই এপ্রিল। জমিদার শ্রীপতিচরণ সরকারের ছয় ছেলের মধ্যে বসন্ত কুমার সরকার ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এ পড়তে থাকতেন হিন্দু হোস্টেলে। সেখানেই অনুশীলন সমিতির সদস্য হন। লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, তরোয়াল খেলা শিখে নেন তখন। ব্রিটিশ বিরোধী ভাবধারায় আকৃষ্ট হন। বর্ধমান রাজ কলেজে এফ এ  (ফার্স্ট আর্টস) পড়ার সময় বিপিনচন্দ্র পালের বক্তব্য শুনে বিপ্লবী ভাবধারায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি নিজের গ্রাম কাতরাবালিতে স্থানীয়দের নিয়ে লাঠিখেলার আখড়া গড়ে তোলেন। মাদাম কামার পাঠানো লাল পতাকা তোলা হয় এখানে। 
সস্ত্রীক বসন্ত কুমার সরকার

১৯০৭ সালে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নেন। বিপ্লবী কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ প্রয়োজন। তাই জালনোট ছাপানোর জন্য টাঁকশালের মিস্ত্রিকে আনতে লখনউ গিয়েছিলেন বসন্ত কুমার সরকার। বাঁকুড়ার শৈলেন চক্রবর্তীকে সঙ্গে করে অস্ত্র ভর্তি ট্যাঙ্ক নিয়ে শিয়ালদহ থেকে গোয়ালন্দ গিয়েছিলেন তিনি। কেউ কিছুই করতে পারেনি তাঁর। তবে 'খুলনা যশোর গ্যাংকেস'এ তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। পরেও বহু বার কারারন্ত্ররালে থাকতে হয়েছে তাঁকে। ১৯১৪ সালে বাঘা যতীন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীরা যখন বিদেশ থেকে ম্যাভেরিক জাহাজে করে অস্ত্র আনার চেষ্টা করেছিলেন তখন সেই অস্ত্র গোপনে রাখার যাবতীয় ভার পড়েছিল এই বসন্ত কুমার সরকারের ওপর। তিনি বালেশ্বরের চাঁদিবালিতে এজন্য একটি বাসাও ভাড়া করেছিলেন। যদিও সেই অস্ত্র আনা সফল হয়নি টেগার্ট সাহেবের আক্রমণের জন্য। বুড়িবালাম নদীর তীরে বিপ্লবীদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধে বাঘা যতীন মারা যান। সেই সময় বসন্ত কুমার সরকারের ঘর তল্লাশি করে পুলিশ। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

১৯২৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে যোগদান করেন তিনি। সেই সভায় তাঁর কোঁচড়ে ছিল পিস্তল। ১৯৩০ এ লবন আইন অমান্য আন্দোলন করে জেলে যান। ১৯৪২ এও কারারুদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। একসময় বীনপুরের কুইকাকো স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগদান করেন। ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর এই চাকরি কেড়ে নেয়। মেদিনীপুরে আইন নিয়ে পড়তে গিয়েও বাধার মুখে পড়েন। মেদিনীপুরে 'জর্জ লাইব্রেরি' নামে এক বইয়ের দোকান খোলেন রোজগারের জন্য। সেখানেও ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি ছিল সবসময়। 

স্বাধীনতা লাভের পর এক লেখায় বসন্ত কুমার সরকার লিখেছিলেন, "ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন বিপ্লবীদের রক্তে রঞ্জিত। কত অজানা, অচেনা অসমসাহসিক, নির্ভিক, তেজস্বী, দেশপ্রেমিক যুবক আত্মাহুতি দিয়েছে -- তাঁহাদের যোগ্যতার স্বীকৃতিদান করা হয় নাই"।

Post a Comment

0 Comments