জ্বলদর্চি

ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে অসীম ভুঁইয়া


ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে অসীম ভুঁইয়া


অসীম ভুঁইয়া: বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে কখনো পাশ্চাত্য কখনো সংস্কৃতকে অন্ধ অনুকরণ করা হয়েছে। স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ বইগুলো সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য ব্যাকরণের জোড়াতালি দেওয়া অনুবাদ যেন। ফলে স্ববিরোধীতাও প্রচুর। ছাত্র /ছাত্রীদের ব্যাকরণ বোঝাতেও সমস্যা হয়। বাংলার কি নিজস্ব রীতিতে কোনও ব্যাকরণ তৈরি হতে পারে না? বা এধরনের নিজস্ব বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ আজও লেখা হয়েছে কি না?

পবিত্র সরকার: দুটো প্রশ্ন করেছ। এক, ব্যাকরণ তত্ত্ব বিষয়ক। পাশ্চাত্য বা সংস্কৃত বলে কিছু নয়। ভাষাকে বিশ্লেষণের নির্দিষ্ট তত্ত্ব পৃথিবীতে আছে কিনা?  তা ইংরেজি, সংস্কৃত  যেকোনও ভাষাতেই হতে পারে। ভাষাতত্ত্ব বা ভাষাবিজ্ঞান ঠিক করে দেয় ব্যাকরণ কেমন হবে? বস্তুতপক্ষে সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রাচীন ভাষাবিজ্ঞানের ঐতিহ্য বহন করছে, পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিকভাবে যখন ভাষাবিজ্ঞান চালু হয়নি তখন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদরা বৈজ্ঞানিকভাবে ভাষাকে বিশ্লেষণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হবে ব্যাকরণের ক্ষেত্রে। দুই, কিন্তু স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ লেখা হয় লেখার ভাষা শেখানোর জন্য। যদিও লেখার ভাষার ব্যাকরণ মূলত মুখের ভাষাকে নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। মুখের ভাষারও অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে মুখের ভাষার মধ্যে ভাষার সমস্ত সম্ভাবনা ফুটে ওঠে না,লেখার ভাষার মধ্যেই ভাষার সমস্ত সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই  লেখার কথা ভাবতেই হয়। স্কুলের ব্যাকরণ লেখার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থাকা দরকার। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য থাকায় স্কুলের ব্যাকরণ সংস্কৃতকে অনেকটাই অনুসরণ করে, যা সবক্ষেত্রে দরকার নেই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কবেই বলে গেছেন বাংলায় সমাস দরকার নেই। ইংরেজিতে সমাস শেখানো হয় না। আসলে বাংলায় লেখার ভাষা না মুখের ভাষায় ব্যাকরণ লিখব, এটি একটি সমস্যা। প্রমিত বাংলা ভাষায় সে চেষ্টা হয়েছে। বাংলা আকাদেমি আমার এবং বাংলাদেশের রফিকুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রমিত বা চলিত বাংলা ব্যাকরণের একটা আদল তৈরি হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ বলে দাবি করব না।  আমার লেখা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণে অনেকটা সে চেষ্টা করেছি। যেমন: সম্প্রদান কারক নেই বলেছি আমি। যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আগেই বলে গেছেন। তা সত্ত্বেও বামনদেব চক্রবর্তী রেখে দিয়েছিলেন সম্প্রদান কারক। সংস্কৃত আদল রাখার চেষ্টা পুরনো পন্থীরা করেছেন। বামনদের ব্যাকরণটা জানতেন। তবে অন্যরা টুকে বা না বুঝে অনুসরণ করেছেন। তবে নতুন ব্যাকরণ লেখার চেষ্টা কিন্তু রয়েছে এবং হচ্ছে।

অসীম: বামনদেব চক্রবর্তী সংস্কৃতের মতো করে বাংলা ব্যাকরণ লিখেছেন। বিশেষ করে নানা শ্রেণি বিভাজনের ক্ষেত্রে অকারণ সংস্কৃত ভাবনাকে রেখে দিয়েছেন। বিশেষ করে অব্যয়ের ক্ষেত্রে। আপনি তো বলেছেন অব্যয়ের ধারণা বাংলায় ভ্রান্ত। কারণ এগুলো যোজক, অনুসর্গ,ল বা কখনো ক্রিয়া বিশেষণের ভূমিকা পালন করে।

পবিত্র: হ্যাঁ। তবে সুনীতি কুমার তার ভাষা প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থে এর ইঙ্গিত দিয়ে গেছেনম যদিও এটাকেও আমি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ বলে মনে করি না। 

অসীম: আপনাদের লেখা প্রমিত বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ আমরা পড়েছি এবং সেটি সত্যি একটি নতুন ব্যাকরণের আদল দাবি করতেই পারে। বাংলাদেশের বর্তমান সিলেবাসে এই  ব্যাকরণকে অনুসরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু এই নতুন ব্যাকরণ পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়নি। সম্ভবত আপনার বা সুভাষ বাবুর সঙ্গে তেমন কোনও আলোচনা হয় না ল, যার ফলে পুরনো ব্যাকরণ, ভ্রান্ত ব্যাকরণ কিন্তু আমাদের সিলেবাসে থেকেই গেছে।

পবিত্র: না। আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। তোমাদের সঙ্গেও বোধহয় ওরা আলোচনা করে না। আসলে আমি হয়তো বামপন্থী বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে এই বিভাজন তো লজ্জার ব্যাপার।

অসীম: কিন্তু এর ফলে তো বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণই পিছিয়ে যাচ্ছে।

পবিত্র: হ্যাঁ। আমি যেমন "পুরুষ" পরিভাষাটি বদলে "পক্ষ' করেছি। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা তা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এখানে গ্রহণ করেনি।

অসীম: এখানের সিলেবাসে বেশ কয়েক বছর আগে "পক্ষ" পরিভাষাটিকে গ্রহণ করা হয়েছিল।

পবিত্র: হ্যাঁ। এখন আবার পরিবর্তন করে দিয়েছে।

অসীম:  পুরুষ বোঝাতেও তো সমস্যা। ইংরেজি থার্ড পারসনের বাংলা অনুবাদ প্রথম পুরুষ। এভাবে করলে তো ফার্স্ট পারসনের অনুবাদই প্রথম পুরস্কার উচিত। তাছাড়া পুরুষ বললে কেমন যেন একটা নারী- পুরুষের ব্যাপার চলে আসে। যার ফলে ব্যাকরণ পাঠকদের বোঝাতেও অসুবিধা হয়।

 এখান থেকে কি বেরোনোর কোনও পথ নেই?

পবিত্র: আমার ধারণা এভাবে করলে  কিন্তু ব্যাকরণ পিছিয়ে যাবে। তবে আমি কিছু বললে, (হাসি) বলবে দেশদ্রোহী।

অসীম: স্যার, বাংলা বানান নিয়ে আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। সেই কবে ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরোধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন করে বানানবিধি তৈরি করেছিল। সেখানে বেশ কিছু সংস্কৃত বানানকে বিকল্প হিসেবে রেখে দিয়েছিলেন তারা। পরবর্তীকালে মূলত আপনারই তত্ত্বাবধানে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি নতুন বানান বিধি চালু করে, সেখানে বিকল্প বানানগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে বাদ দিয়ে আরও একটু সহজ এবং সময়ের  সাশ্রয়ের দিক মাথায় রেখে আপনারা বানান সংস্কারে মনোনিবেশ করেছিলেন। তারই সমান্তরালে আনন্দবাজার, গণশক্তি এবং সংসদ তাদের নিজস্ব বানান বিধি তৈরি করেছে। এদের প্রত্যেকের মধ্যে কিছুটা হলেও বানানের পার্থক্য রয়েছে। স্কুলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বানানবিধিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু তারা পরবর্তীকালে  যখন আনন্দবাজার, গণশক্তি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে লেখালেখি বা লেখার মাধ্যমে ভাব বিনিময় করতে চাইবে তখন কিন্তু তাদের বানানবিধি মান্য করতে হবে। এতে করে সাধারণ মানুষ কী করবে? তাদের ক্ষেত্রে এত বানান শেখা কি সম্ভব? বা শিখেই বা কী লাভ? একটি নির্দিষ্ট মান্য চলিত বানানবিধিকে কি নিয়ম নির্দিষ্ট ভাবে করা যায় না?

পবিত্র: এরা বোঝে না। স্বতন্ত্রতার  নাম করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ভীষণ সমস্যা হয়। বানানের ক্ষেত্রে কিছু পত্রপত্রিকা ইগো থেকেই এমনটা করছে। বাংলাদেশেও প্রথম আলোতে এই ব্যাপারটি রয়েছে। আমি ছাত্র ছাত্রীদের বলি স্কুলের বানানটা  আগে শেখো। পরে তোমরা অনেক বানান দেখবে এবং ধীরে ধীরে তা শিখে নেবে। অনেকে জুলুম করে আবার বানান লেখায়। কাগজগুলোতে বানান জানা লেখক খুবই কম। তাই ভুলও হয় প্রচুর।

অসীম: এই সমস্যার সমাধান কি? সরকার কি বাধ্যতামূলক ভাবে কোনও একটি নির্দিষ্ট বানানকে মান্যবিধি হিসেবে বিবেচনা করতে পারে না?

পবিত্র: সরকার এভাবে বদলাতে পারে না।এটা গণতান্ত্রিক সরকার তাই। সরকার নিজের দপ্তরের ক্ষেত্রে হয়তো তা করতে পারে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে কীভাবে তার জুলুম করবে? সরকার বলবে আর সবাই তা গ্রহণ করবে এটা ঘটবে না।  তাছাড়া ত্রিপুরা, আসাম প্রভৃতি রাজ্যেও তো বাংলা রয়েছে। তাই সার্বিকভাবে এটা করা সম্ভব হবে না।  তবে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমির অনেক প্রতিপত্তি থাকায় ও শক্তিশালী হওয়ায় প্রায় সকলেই তাদের বানানবিধি মেনে নেয়, প্রথম আলোর মতো দু একটি কাগজ ছাড়া।

🍂

অসীম: তৎসম বা সংস্কৃত উচ্চারণ থেকে বাংলা উচ্চারণ তো পৃথক। বানানে তৎসম অথচ উচ্চারণ কিন্তু অতৎসম। সেক্ষেত্রে মূর্ধন্য ন দন্তন ন - র বানান কেন রাখব?

পবিত্র: তবে না রাখলেও হয়। এটা তোমরা ভাবতেই পারো। আমরা হয়তো সবটা পারিনি। তোমাদের প্রজন্মের জন্য এগুলো রেখে আমরা আমাদের প্রজন্মের কাজ শেষ করেছি, এটুকু বলতে পারি।

পবিত্র: হ্যাঁ এখানে পরিবর্তন তোমরা করতেই পারো তোমাদের প্রজন্ম আরও এগিয়ে যাবে তোমরা আবার নতুন করে বৈজ্ঞানিকভাবে বানানবিধি করতেই পারো আমরা আমাদের প্রয়োজনমের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই শেষ করলাম এভাবে ধরতে পারো।

অসীম: আরেকটি বিষয় খুব বলতে ইচ্ছে করছে। তা হল, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে যে ধরনের কাজ করেছিলেন তা নতুন বাংলা ব্যাকরণের সম্ভাবনার ক্ষেত্রকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। সমাজবিষয়ক ভাবনায় তিনি সমাজ পরিবর্তনেরও চেষ্টা করে গেছেন। তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়েছিল।কিন্তু তার কাজ দ্বারা তার  যতটা  জনপ্রিয়তা ও সম্মান পাওয়া উচিত ছিল, তা তিনি পাননি। এর কারণ কি?

পবিত্র: হুমায়ুন খুব পরিষ্কার কথা বলে. তার প্রশংসা করলে মৌলবাদীরা হয়তো চটে যাবে, সেই ভয়ে অনেকে হুমায়ুনকে এড়িয়ে চলত। নানাভাবে হুমায়ূন আক্রান্ত হয়েছে। সে নিজেও কথার দ্বারা আক্রমণ করেছ। তবে আমার খুবই স্নেহভাজন ছিল সে।  ওর অনেক বেশি কদর হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। তবে তারও নির্দিষ্ট বেশ কিছু পাঠক কিন্তু ছিলই।

অসীম: আমার শেষ প্রশ্ন:  আপনি ব্যাকরণের এক মহাসাধক ।একদিকে ব্যাকরণ চর্চার গভীরতা, সিরিয়াসনেস, অন্যদিকে আপনার সরস রচনার সাবলীলতা। তপতী থেকে প্রকাশিত আপনার দুই খন্ডে রচিত ছলছুতো এক  অসাধারণ সরস গদ্য গ্রন্থ। তো একদিকে সরস সাহিত্য অন্যদিকে ব্যাকরণের জটিলতা: এ দুয়ের সমতা  বিধান করতে কি কোনও সমস্যা হয় না? বা কীভাবে সমতা বিধান করেন?

পবিত্র: আমার তো কোনও সমস্যা হয় না। ব্যাকরণের জটিলতাকে বোঝা ও বোঝানোর চেষ্টা করি আর শিশুদের ভালো লাগে। মজা করে কথা বলতে ভালো লাগে। কথাই তো মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে। এটা আমার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। আমার শিক্ষক প্রমথনাথ বিশি, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে আমি এগুলো শিখেছি। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমার গুরুর মতো। উনারা সব অসাধারণ কথা বলতেন। তাই আমার সরস কথা বলার কৃতিত্ব আমার থেকে উনাদের অনেক বেশি।

অসীম: অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার, আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য।

পবিত্র: তোমাকে ও জ্বললদর্চি কেও আমার শুভেচ্ছা। ভালো থেকো।

সংগ্রহ করতে পারেন 👇


Post a Comment

0 Comments