সালেহা খাতুন
জ্ঞানীরা যেখানে পা ফেলতে ভয় পায় মূর্খরা সেখানে ছুটে যায়। কথাটা কতটা সত্য তখনই বুঝতে পারি যখন দেখি ভাষাতত্ত্ব বা ভাষাবিজ্ঞানের ভ-ও জানেন না যাঁরা তাঁরা নিজেদের পণ্ডিত ভাবেন। আসলে দীর্ঘদিন রামেশ্বর শ’ এবং পরেশচন্দ্র মজুমদারের ক্লাস করার সরাসরি অভিজ্ঞতা থেকে মনে হতো ঐ মানে পৌঁছাতে গেলে অনেক সাধনা করতে হবে। এ কথা আমার বন্ধুরা সবাই মানে।
পরেশচন্দ্র মজুমদার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব দুটি স্বতন্ত্র বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ডি. লিট. উপাধিতে ভূষিত হন তাঁর A Historical Phonology of Oriya গ্রন্থটির জন্য। তাঁর রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ক্রমবিকাশ বইটি এম.এ ক্লাসে আমাদের প্রায় গুলে খাওয়াতেন। কী অমায়িক তাঁর ব্যবহার। বিদ্যা যে বিনয়ী করে তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। চক ডাস্টার অবলম্বনে ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের ক্লাস নিয়ে যেতেন।
একবার ক্লাসে একটি চড়ুই পাখি ঢুকে পড়ে। যাঁরা আশুতোষ বিল্ডিংয়ের দশ নম্বর রুমটি চেনেন তাঁরা জানেন উঁচু ছাদ থেকে সিলিং ফ্যান ঝোলানো থাকতো লম্বা লোহার দণ্ডের সাহায্যে অনেকটা নীচু করে। শুধু দশ নম্বর রুমই নয় সব ক্লাসরুমেই ঐ ব্যবস্থা থাকতো। চড়ুই পাখিটি উড়তে উড়তে ফ্যানের ব্লেডে ধাক্কা খেল। আহত হয়ে পড়ে গেল। স্যার বোর্ডওয়ার্ক ফেলে পাখিটিকে নিয়ে ছুটে গেলেন বাইরে। বেসিনের কল খুলে জল দিয়ে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
আর একবার সরস্বতী পুজোর সময় ক্যাম্পাসের কোয়ার্টার থেকে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের দল চাঁদা চাইতে এসে স্যারের ক্লাসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। স্যার বললেন তোরা যদি সরস্বতী বানান সঠিক বলতে পারিস তবেই চাঁদা দেবো। তারা উত্তর দিল। তখনকার দিনে উনিশশো পঁচানব্বই সালে স্যার পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে তাদের দিলেন। স্যারের থেকে দূরে এসে এখন অবলম্বন স্যারের – পৃথিবীর ভাষা : ইন্দো-ইউরোপীয় প্রসঙ্গ, নবচর্যাপদ, আধুনিক ভারতীয় ভাষা প্রসঙ্গে, বাঙলা বানানবিধি, বাঙলা ভাষা পরিক্রমা ও আরো বিভিন্ন গ্রন্থ।
ক্লাসের বাইরে কোনোদিন স্যারের সঙ্গে কথা হয়নি অথচ তিনি হৃদয়ে গেঁথে আছেন আমাদের মতো সাধারণ গ্রাম্য পড়ুয়াদের। আর আজ কথায় কথায় শিক্ষার্থীরা যে কোনো সময় ফোন করে তাদের শিক্ষকদের। কোভিড এসে তাতে আরো বেশি করে অগ্নি সংযোগ করেছে। মেসেজ সঙ্গে সঙ্গেই দেখতে হবে। তাদের ধৈর্য কমছে। মি টাইম বলে আজকের শিক্ষকদের যেন কোনো সময় থাকতে নেই।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আজকাল চারিদিকে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আমরা যখন ঐ চুরানব্বই ছিয়ানব্বইয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছি তখনও এ বড়ো বালাই ছিল। খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেখি অধ্যাপক রামেশ্বর শ’ আমাদেরই সমবয়সী একজন মেয়েকে খুঁজছেন যে কিনা তাঁর ঐ একই বয়সী মেয়েকে কিছুটা দেখভাল করবে। আমাদের ক্লাসের আরাধনা বললো আমি আবেদন করবো। ও এমনই ছিল। মিলিটারি ছেলেদের প্রতি ওর সহৃদয় মনোভাব ছিল। বলেছিল বিয়ে করলে এমন পাত্রকেই করবে। বাড়িতে বোঝাবে। টুকটুকে লাল আপেলের মতো ওর গাল। ছেলে মেয়ে নির্বেশেষে আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। তাহলে মেয়েরা কি সমকামী হয়ে গেল নাকি? হ্যাঁ সমকামী বন্ধুদেরও আমরা পেয়েছি।
🍂
আরও পড়ুন 👇
অধ্যাপক রামেশ্বর শ কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন। আমাদের প্রত্যেক শনিবার ক্লাস নিতেন। একবার জার্মান ভাষার একটি বর্ণের উচ্চারণ আমাদের দেখিয়েছিলেন। যেটা আলজিহ্বা দিয়ে উচ্চারণ করতে হয়। সাবধান করেছিলেন বাড়িতে গিয়ে ওটা যেন প্র্যাকটিশ না করি। তাহলে আলজিহ্বা ছিঁড়ে যাবে।
তাঁর “সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা” বইটি কেনার একটি গল্প আছে। অবশ্য আত্মকথা তো গল্পের মতো করেই বলছি। আসলে সবই তো গল্প। কেমিস্ট্রি টিচার যেমন বলেন দুই অনু হাইড্রোজেন আর এক অনু অক্সিজেনের জলে পরিণত হওয়ার গল্প, অঙ্কের টিচার বলেন এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের গল্প, ভূগোলের টিচার বলেন নদীনালা পাহাড় পর্বত রাস্তাঘাট দেশ বিদেশের গল্প ইত্যাদি।
রামেশ্বর শ’র বইটা কিনতে হবে বলতে বাবা বললেন যারা লেখকের রেগুলার ক্লাস করে তাদের বই কিনতে হয় না। কিন্তু আমি কিনবই। সে সময় পোস্ট অফিসে মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা এই ধরনের নামে একটা প্রকল্প ছিল। মেয়েরা তিনশো টাকা জমালে নির্দিষ্ট সময় পর তিনশো পঁচাত্তর টাকা পাওয়া যেত। ঐ প্রকল্পে বাবা আমাকে টাকা জমাতে তিনশো টাকা দিয়েছিলেন। সেটা ম্যাচিওর হতে তিনশো টাকা বাবাকে ফেরত দিই আর পঁচাত্তর টাকায় ঐ বইটি কিনি।
বই কেনার অনেক গল্প আছে। হাওড়া থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে জ্যামের কারণে প্রায় দু'ঘণ্টা চলে যেতো অথচ হাওড়া স্টেশন থেকে হেঁটে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যেতাম। ব্যস সময় আর পয়সা দুইই বেঁচে যেতো। তখন সেই জমানো পয়সা দিয়ে দে’জ-এ গিয়ে নানান বই কিনে ফেলতাম।
(ক্রমশ)
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments