জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ /স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
স্বপন কুমার দে

                       মুখবন্ধ

প্রকৃতির কী বিচিত্র রূপ! ততোধিক বিচিত্র মানুষ, মানুষের মন, মানুষের সম্পর্ক। ওপরে নীল আকাশ, তার নীচে মাটির এই পৃথিবী। এখানে বাস করে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সত্তা, মানুষ। সময় পরিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে মানুষও বদলে নিচ্ছে নিজেকে।বদলাচ্ছে সমাজ, - তার অর্থনীতি,সমাজনীতি। বদলে যাচ্ছে চাহিদা, চিন্তা,রুচি।উঠে আসছে নতুন মত,খুলে যাচ্ছে নতুন নতুন পথ।লুপ্ত হচ্ছে সংকীর্ণতা, ঘটছে চেতনার নতুন সূর্যোদয়।

ঊনিশশতকে রামমোহন- বিদ্যাসাগরের হাত ধরে নারীমুক্তির যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল আজ সে লড়াই পৌঁছে গেছে সর্বত্র। অন্দরমহলের অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে তারাই এখন পথ পরিচালিকা। কিন্তু, বিপরীতমুখী প্রতিবন্ধকতার জগদ্দল পাহাড় অনেক সময় বাধার পাঁচিল তুলে দেয়। অনেককে থামিয়ে দেয়।হারিয়ে যায় স্বপ্ন। ফুরিয়ে যায় দম।

কেউ কেউ রুখে দাঁড়ায় । ভেঙে ফেলতে চায় অন্ধকারের কারা প্রাচীর। স্বপ্ন তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।তারা আঘাত পায়,রক্তাক্ত হয়, কিন্তু থামে না। এই গল্পের চন্দ্রমল্লিকা সেই রকমই একজন। সে আকাশ ছুঁতে চায়। লড়াইয়ের অপর নাম চন্দ্রমল্লিকা। তার সামনে যে বাধা আসে, তার বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে। হারার আগে হারে না। সে মাটির ওপর বৃন্তহীন চন্দ্রমল্লিকা।

                          পর্ব--১

সাধারণতঃ রাত দশটা সাড়ে দশটা বাজলেই স্টেশন চত্বরটা অনেকটা ফাঁকা হয়ে যায়। দোকানের ঝাপগুলো নামতে থাকে। রাস্তার দখল নিতে থাকে কুকুরগুলো। সারাদিন অ্যাতো মানুষের আনাগোনা, ব্যস্ততায় এখানটা গম্ গম্ করতে থাকে। আলাদা করে কাউকে দেখবার সময় থাকে না। অটো,টোটোগুলো প্যাসেঞ্জার নিয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। নিত্য যাত্রীদের সকালবেলায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়া আবার ফেরার সময় তাদেরই রঙ্গ রসিকতা, হালকা মেজাজ-- সবই গতানুগতিক। সেই জায়গাটাই রাত বাড়লেই আস্তে আস্তে কেমন যেন শুনশান হয়ে যায়। তখনও দু'একটা টোটো রয়ে যায় এগারোটা পাঁচের লোকালটার জন্য। দু'একজন প্যাসেঞ্জার পেলেও অনেকটা পুষিয়ে যায়। আর থাকে বটতলার কাছটায় নিমাইদার রিকশ। সিটটার ওপর বসে মাঝে মাঝে বিড়ি ধরায় আর টোটোওয়ালাদের সাথে বাক্য বিনিময় করে।

নতুন যুগের জোয়ার যখন আসে তখন সেই জোয়ারে  অনেক কিছুই ভেসে যায়। যা এতদিন আঁকড়ে ধরেছিল, প্রবল ঝটকায় তা কালের গতিকে হারিয়ে যায়। থেকে যায় ইতিহাসের পাতায়। মানবদেহের লুপ্ত প্রায় অঙ্গের মতো সমাজেও লুপ্ত প্রায় যানবাহনের তালিকায় ঢুকে পড়েছে প্যাডেল রিকশ। প্রথমে অটো রিকশ, পরে টোটো দ্রুত বাজার দখল করতে নেমে পড়েছে। আগে ছিল রিকশওয়ালাদের দাপট, তারপর বহু রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের শেষে অটো থেকে বর্তমানে টোটো রাজত্ব কায়েম করেছে। বলা যায় তাদের দৌরাত্ম্যে প্রাণ ওষ্ঠাগত।

এতকিছু পরিবর্তনের মাঝে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে কিছু রিকশওয়ালার অস্তিত্ব। যেমন নিমাইদা। সেই কবে থেকে বাবার হাত ধরে এই পেশায় নেমে ছিল তা এখন ঠিক ঠাওর করতে পারে না। তখন মোড়ে মোড়ে রিকশ্ স্ট্যান্ড থাকত পাকাপাকিভাবে। বাস,ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীরা উঠে বসত এক একটা রিকশতে। সেই নিয়ে কত দর হাঁকাহাঁকি, ঝগড়া, -- কত কী।আবার সম্পর্কের মধুরতাও ছিল। একদিন একজন যাত্রী, তাঁর পছন্দের নির্দিষ্ট রিকশ ছাড়া উঠতেন না।রিকশওয়ালা নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করত।রাস্তায় চলতে চলতে তাদের মুখ থেকে হাজারও ঘটনার বর্ণনা শোনা যেত। সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা ছিল।

ক্রমশ রাত বাড়ে, শুনশান হয় রাস্তা। সন্ধ্যেবেলায় এক পশলা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই বৈশাখ মাসের হাঁসফাঁস করা গরম আর নেই। মানুষ একটু শান্তিতে ঘুমোতে পারবে। রাস্তার পাশে পাশে কোথাও কোথাও জল জমে আছে।কৃষ্ণ পক্ষের ক্ষয়িত মাথার ওপর। দিনের অগ্নি বলয় পেরিয়ে রাত্রির চাঁদ শান্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিতে এসেছে যেন। মায়াবিনী রাতের মোহময়ী রূপ যেন ঝরে পড়ছে মাটির পৃথিবীতে। এ রূপ দেখবার মত চোখ চাই, আস্বাদ করবার মত অনুভূতি চাই।

এগারোটা পাঁচের হাওড়া লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। প্যাসেঞ্জারের আশায় নিমাইদা স্টেশনের মেইন গেটটার দিকে চেয়ে রইল। দু'জন প্যাসেঞ্জার এসেই এগিয়ে গেল সামনের ফোর হুইলারটার দিকে। তাদের জন্যই গাড়িটা এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। আরও চার পাঁচজন এগিয়ে গেল বাইক স্ট্যান্ডের দিকে।এরপর একটা গ্রুপ নামতেই দুটো টোটো ভরে গেল। আজ আর কোনো রোজগার নেই দেখে নিমাইও তৈরি হল তার ত্রিচক্রযান নিয়ে বাসায় ফেরার জন্য ।ঠিক তখনই তার নজরে পড়ল ঊনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ে দূর থেকে 'রিকশ' 'রিকশ' বলে হাঁক পাড়ল। তার সঙ্গে মধ্যবয়স্ক একজন। মনেহয়  লোকটি অসুস্থ। তার চলার গতি ধীর।মেয়েটি অন্য হাতে লোকটিকে ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে আসছে। নিমাইদা লোকটিকে উঠতে সাহায্য করল।তার পাশে মেয়েটি উঠে বসল। নিমাইদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, "কাকু,একটু আস্তে চালাবেন।" নিমাইদা বলল, "কোনও চিন্তা নেই মা,আমি ঠিকভাবেই তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবো।"

🍂
রিকশতে যেতে যেতেই নিমাইদা এক এক করে মেয়েটির কাছ থেকে সবকিছু জেনে নেয়। মেয়েটির বাবা কিডনির জটিল অসুখে ভুগছে। তাই কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল। দেরি হয়ে যায়।তাই এত রাত্রি। লেখাপড়া জানা মেয়ে। কথাবার্তায় বিনয় ,ভদ্রতা।মেয়েটির নাম 'চন্দ্রমল্লিকা'। সে বলল,"সবাই আমাকে 'মল্লিকা' বলে  ডাকে। আপনি তো আমার কাকুর মত,আপনিও আমাকে 'মল্লিকা 'ডাকতে পারেন।

পনের কুড়ি মিনিটের মধ্যেই নিমাইদার গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছল।ভাড়া মেটাতে গিয়ে নিমাইদা দেখল,মেয়েটি খুব অসুবিধায় পড়ে গেছে। কিছুতেই ভাড়ার পুরো টাকাটা জোগাড় করতে পারছে না।শেষ মেশ ইতস্ততঃ করে বলল,"কাকু,এখন দশ টাকা রাখুন কাল স্টেশনে বাকি টাকাটা দিয়ে আসবো।মল্লিকার চোখ মুখ দেখে নিমাইদা বুঝতে পারল ।তার মধ্যে কপটতা নেই। হয়তো বাবার চিকিৎসার, বাবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে সব টাকা খরচ হয়ে গেছে।তাদের সাদামাঠা পোশাক, ভাঙাচোরা টিনের বাড়ি দেখে মনেহয় না বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল।
" মা,কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?"
মল্লিকা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, " হ্যাঁ,বলুন।"
" বলছি,তোমাদের বাড়িতে আর কে কে আছে? তুমি কী কর?"
" বাড়িতে আমরা দু'জন, আমি আর আমার বাবা। বাবা এতদিন হকারি করতো,এখন সে কাজও আর করতে পারে না। আমাদের যেটুকু ছিল, বাবার চিকিৎসার জন্য তাও শেষ। আমি কলেজে পড়ি। দু'চারটে টিউশন করে সংসার চালাই।" কথাগুলো বলার সময় তার ঠোঁট দু'টি কাঁপছিল। একজন অপরিচিত লোকের সামনে নিজেদের এতটা ছোট করতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। কিন্তু, ভাড়া দিতে না পারার যন্ত্রণায় নিজের বেদনার কথা ফেলল।কথাগুলো বলে সে মনে মনে লজ্জা পেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েই জো, দিয়ে বলে," আমি কালই আপনার বাকি টাকাটা দিয়ে আসবো।"
" তোমাকে আর টাকা দিতে হবে না মা।আর আমি তো তোমার কাকু,আমি নাহয় ভাইঝির জন্য এইটুকু করলাম। " বলেই রিকশ নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।
বাপ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল।

রিকশটাকে একপাশে রেখে একটা ঘুপচি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল নিমাইদা।সদ্য কেনা একখানা দেশি বোতলের ছিপিটা খুলতেই গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। হোটেল থেকে চারটে রুটি, ঘুগনি কিনে এনেছিল। সেসব দিয়ে আয়েশ করে ডিনারে মন দিল।

বৌ মারা গেছে বছর পাঁচেক আগে। দুই ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা তাদের বৌ সংসার নিয়ে আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে । ছোট ছেলে লরি চালায় আর বড়টা বাবুদের গোডাউনে কাজ করে ।মেয়েটিরও বিয়ে দিয়েছে রেল কলোনিতে। আলাদা হয়েও নিমাইদার বৌ তিন বছর বেঁচেছিল। তারপর অজানা জ্বরে সেও চলে গেল।মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের জন্য মনটা খারাপ লাগে।দেখা করতে যায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে।

একাকীত্বের এই সংসারে জীবনটা বড় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সারাদিন অনেক লোকের মাঝে থাকলেও রাত্রিবেলাটা বড় একা লাগে, ফাঁকা লাগে। তখন নেশা তাকে সঙ্গ দেয়। নিজের একমাত্র মেয়ের কথা মনে পড়ল। তার কথা ভাবতে ভাবতেই মল্লিকার মুখটা ভেসে উঠল।

ক্রমশ
সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments