সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩২
গৌতম বাড়ই
বাবা যে অঙ্কুশের কথাই তুলবেন অভিকাকুর কাছে তা বসন্তসেনা আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন। সুশোভন বললেন-" শোন অভি, হাসনুমায়ের খুব প্রিয়বন্ধু অঙ্কুশ । বলতে পারিস নিজের রক্তের সম্পর্কের বাইরে এক অতি প্রিয় মানুষ। আমাদের সময়ে আমরা অতি সহজে এই সম্পর্কটিকে প্রেম বলে মান্যতা দিতাম। ওরা তো ইনিয়ে- বিনিয়ে শ'কথা বললেও প্রেম বলে স্বীকার করবে না। আমি বলেছি হাসনুকে, যদি অঙ্কুশকে গভীরভাবে পছন্দ করে তবে ব্যাঙ্গালোরে জব নিয়ে চলে গিয়ে একসাথে সেটেলড্ করতেই পারে। আমার কোনও আপত্তি নেই।আর আমিও চাই , শুধু আমার কথা ভেবে এখানে পড়ে থাকতে হবে না। আমার তো জীবনের কোটা ছোট হয়ে আসছে, ওর রয়েছে বিস্তীর্ণ এক জীবন। আর অঙ্কুশের কাছ থেকেও সম্প্রতি এরকম এক প্রস্তাব এসেছে হাসনুর কাছে। আমি এই হাসনুমায়ের সামনে বসেই তোর থেকে কিছু মতামত চাইছি। "
বসন্তসেনা অভিকাকু কিছু বলার আগে বলে উঠল- " না কাকু কিছু বলবে না। আর কাকু কী অভিমত দেবে? আমি এখন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, ওই যাকে বলে মনেপ্রাণে একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ তথা নারী। সবকিছু সময়ের ওপর ছেড়ে দাও বাবা। আমি তোমাকে একা- একা এইমুহূর্তে ছেড়ে অন্যকোথাও বা অন্যশহরে যাব না। সময় সব ঠিক করে দেবে। কোনটা ভাল বা কোনটা মন্দ? সময়ই বলবে। না কাকু, তুমি কিছু বলবে না। "
তার অভিকাকু বলে- " বুঝলি মা, তোর মা দীপশিখা বেঁচে থাকলে আজ তোর বাবাকে এ ধরণের কথাই বলতে হতো না। তোর জীবনের এখন প্রতিটি মুহূর্তের ওঠাপড়ার প্রতি তোর বাবার দায়িত্ববোধ জাস্ট দ্বিগুণ বেড়েছে। এ বাস্তব তোকে মেনে নিয়ে স্বীকার করতেই হবে। তাই হয়ত শোভন আমাকে কাছে পেয়ে কথাগুলো বলেছে। এতে ওর কোনো দোষ কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না। ঠিক আছে তুই তো ওকে বলেছিস তোর নিজস্ব কথা। এবার ওদিকে আমরা আর যাচ্ছি না। অন্য গল্পগুজব আবার শুরু করি। কী বলিস শোভন?"
অভিজিতের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনেই একসাথে হেসে ওঠাতে, পরিবেশটা আবার লঘু হয়ে আসে। তারা তিনজন এবার অন্য কথায় মেতে ওঠে। আদতে এই অভিকাকু যখনই তাদের বাড়িতে আসে এমনিতেই তাদের বাড়ি আলোতে ঝলমল করে ওঠে যেন।আদতে এরকমটি প্রায় অনেক বাড়িতেই হয়, একজন লোকের আগমনেই সারাটাঘরে যেন আলোকময় দ্যুতিতে ভরে যায়। গোটাবাড়ির জড়বস্তুরাও হয়ত কথা বলে ওঠে পরস্পর তার আবির্ভাবে।
সুশোভনবাবু বললেন- " এইজন্যেই তো তিনজনে সামনাসামনি বসলাম। অভি, হাসনুমা বড় হয়েছে, ওর প্রত্যেকটি মতামতের গুরুত্ব আমার কাছে আছে। আজ পর্যন্ত ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন জোর করেনি। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বুঝিয়েছি, আমরা বাবা- মা উপদেশ দিয়েছি , তারপর সবটা মিলিয়ে একটা সিদ্ধান্তে এসেছি। হাসনুমা এইভাবেই বড় হয়ে উঠেছে। আমার কাছে তো পরিষ্কার হল ওর এই মুহূর্তের ভাবনা- চিন্তাগুলো আরও। আজ সত্যি আমরা ওদিকে এই বিষয়টা নিয়ে আর এগোচ্ছি
না। তবে হাসনুমা তুই কি সামনের শুক্রবার আর শনিবার অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবি ? তাহলে তিনদিনের একটা মাঝারি ছুটি পাওয়া যাবে।
🍂
- " কেন বাবা? তোমার মাথায় নিশ্চয় কলকাতার আশপাশে কোথাও বেড়ানোর পরিকল্পনা আছে?
সুশোভন আনন্দে জোরে কথা বলে উঠলেন-" ই---য়া-স! এই না হলে আমার মাইয়া। একদম ঠিক। আমার পুরো প্রোগাম আগেই সাজিয়ে ফেলেছি। একটা সারপ্রাইজ দেব বলে তোদের জানাইনি। এবার অভিকে সহজে ছাড়ছি না। তুই মা অফিসে গিয়ে কাল জানাবি, ছুটি পাক্কা কিনা? তারপর আগামীকাল রাতের জন্য বাদবাকি চমকটা জমা হয়ে থাকল। "
বসন্তসেনাও আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল-- " উফ্ফ্ বাবা আমার তো আর তর সইছে না। তুমি ধরেই নাও শুক্রবার থেকে আমার ছুটি। আমার অফিস ছুটি না দিলে, আমি ওদের ছুটি করে দেব। তুমি প্লীজজ্ বল--লো!"
সুশোভনবাবু বললেন- " না, একদম না। কমিটমেন্ট ইজ আ কমিটমেন্ট। বৎস ধৈর্য ধরো আগামীকাল রাতেই হবে ঘোষণা। "
অভিজিৎ বলেন-- "আনন্দে তো আমারও সেই আমাদের ছেলেবেলাটি মনে পড়ছে, তোর বাপ শোভন চিরকাল এইরকম সাসপেন্সে রেখে কথা বলতে ভালবাসে। কী রে শোভন ঠিক কি মিছেকথা কইলাম? তোরা কালকে সকালে কাজে বেরিয়ে গেলেই আমি পান্নাকে দিয়ে একটা মেনু তৈরি করাব। দরকার হলে ওর সাথে লেগে পড়ব রসুইঘরে। তবে কী সেটা ? এটাও কিন্তু সাসপেন্স! "
-- " হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। তোর কেরামতি যতোসব ওই মাংসটাংস রান্নায়। তুই কিন্তু খবরদার বাজার করতে যাবি না। পান্নাকে আমি আচ্ছা করে বলে দিয়ে যাব ফ্রিজে রাখা পাকারুই দিয়ে ও যেন কালিয়াই রাঁধে। "
বসন্তসেনা হাসতে হাসতে বলে- " না কাকু তুমি বেহালার পাঠকপাড়া ইকবালের দোকান থেকে রেওয়াজি খাসি নিয়ে এসো তো। আমি মাটন খাব। বাবাটা যেন আজকাল সাধুবাবা হয়ে যাচ্ছে। এক পক্ষকাল বা তারচে বেশি খাইনি মনে হচ্ছে। "
-" শোভন মা যখন খেতে চেয়েছে, তখন আমায় আর পায় কে? হাসনুমা কাল রাতে মাটন আর পরোটা হবে, তাহলে।" সুশোভনের দিকে তাকিয়ে মুঠো শক্ত করে উঁচু করে ধরল।
ওই মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকিয়ে সুশোভনবাবু বললেন- " মেজরিটি মাস্ট বি গ্রান্টেড। "
তারপর শুক্রবার খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লেন তারা তিনজন
তাদের গন্তব্য ছিল বোলপুরে শান্তিনিকেতনে। রাঢ়ের মাটি স্পর্শ করতেই বসন্তসেনার মনে উঠে আসে রাজকন্যা সুসীমার কথা। ঐতিহাসিক ভাবে এর খানিকটা তো সত্যি। তাহলে এই বীরভূমে একদিন নিশ্চয় পড়েছিল রাজকন্যা সুসীমার পদচিহ্ন। গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশের আসনে সে বসেছে। বাবা আর তার অভিকাকু পেছনের দুই জানালায়। বর্ধমানের শক্তিগড়ে গাড়িকে সামান্য বিরতি দিয়ে ল্যাংচাময় স্থানে অবশ্যই ল্যাংচা সহযোগে সকালের জলখাবার হল। বসন্তসেনার এই মিষ্টিটি যদিও পছন্দের নয় খুব একটা। না বিরাট কোনও স্বাদে বা চেহারায়, ভীষণ অপছন্দেরই বলতে হবে- সে বলে। তারপর শক্তিগড় ছাড়াতেই বসন্তসেনা গেয়ে উঠল- এই শহর থেকে আরও অনেকদূরে, চলো কোথাও চলে যাই-------। পিছনে বসে তার বাবা ও অভিকাকু গলা মেলাল তার সঙ্গে আর বলতে লেগেছে, এইসব গান এখন কী আর পাবি হাসনুমা? প্রথম কদম ফুল ছবিতে মান্না দের কন্ঠে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানে, সুরারোপ করেছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত, আজ কোথায় এইসব গান? গানে সত্যি তাই পুরাতন- মহারতন। বেশ সুন্দর আনন্দময় এক জগত যেন আজ অনেকদিন পর তৈরী হল সেই মুহূর্তে। কোনও একজন বিখ্যাত মানুষ বলেছিলেন, " আমাদের জীবনে আনন্দের মুহূর্ত খুবই কম, জীবনের বেশিরভাগটাই নিরানন্দের আর সুখহীন।" আমরা তাই বারবার আমাদের ফেলে আসা আনন্দের মুহূর্তগুলো স্মরণ করি । আর বারবার ফিরে পেতে চাই ঐ মুহূর্তগুলি। জানি এ জীবনে তা কখনও সম্ভব নয়। তাই নতুন কোনো আনন্দমুহূর্ত গড়ি।
সুশোভনবাবু ঠিক দুদিনেই সমস্তকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছেন। গাড়িতে বসেই বললেন- "আরো একটি চমক তোমাদের দুজনের জন্যে আছে। সেটি রিসোর্টে গিয়েই বুঝতে পারবে। "
মার্চের শুরু , ভরা ফাল্গুন। গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে দোল বা বসন্ত উৎসব প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। রাস্তায় পলাশ , শিমূল, অমলতআস আর বাবলার ঝোপঝাড়। কোথাও মাদারগাছে রাঙাফুলে প্রকৃতির অপূর্ব শোভা। বেলা সাড়ে এগারোটায় এসে সোনাঝুড়ির বনের মধ্যে রাম-লখনের ভিলেজ রিসোর্টে এসে গাড়ি থামলো। ড্রাইভারের রুম থেকে তাদের রুম সব বন্দোবস্ত করে সুশোভনবাবু এসেছে। তিনটে রুম নেওয়া হয়েছে। রিসোর্টের কেয়ার টেকার এসে দোতলায় নিয়ে গিয়ে একটা রুম খুলে দিয়ে গেলেন। লাগেজগুলো দুজন লোক এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কেয়ারটেকারকে বললেন সুশোভন- " ম্যানেজারকে বলো একটু বাদেই আসছি। রেজিষ্টার রেডি করতে। "
বসন্তসেনার বাবার ওপর খানিকটা অভিমান হল, বললে- " এই একটা রুমে আমরা তিনজনে থাকব? আমার জন্যে একটা আলাদা রুমের ব্যবস্থা করতে পারলে না? "
সুশোভনবাবু বললেন- " কে বলেছে তোমায় আমাদের সাথে থাকতে? পাশের দুশো সাতে টোকা মারো, ওটা তোমার । "
বসন্তসেনা অবাক হল -" যদি আমারই হয় তবে ভেতর থেকে বন্ধ কেন? কে আছে ভেতরে? "
- "আহা ডোরবেলটা বাজাও না! "
বসন্তসেনা বেল বাজাতেই অবাক, দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে আলোমাসি। বসন্তসেনা ঝাঁপিয়ে মাসির বুকে পড়ে বলল- " ও মাসি! বাবাটা কী পাজি বলো, একবারও বলেনি তুমিও আসবে এখানে। আমি আর তুমি থাকব এই ঘরে! "
আলোমাসি তার সেই হাসিমাখা মুখে বলল, "আরও একটু চমক আছে! ২০৮ নাম্বারে তোমার ভালোমামা আর মামি আছেন। ওনারাও আজ সকালে দুর্গাপুর থেকে এসে উঠেছেন। এ সব তোমার বাবার কীর্তি। যাও পাশের ঘরেরও বেল বাজাও। "
ভালোমামা- মামী আর আলোমাসি এবং বাবা আর অভিকাকু মিলে তাদের ছয়জনের এক জমজমাটি টিম হাসি হুল্লোর গল্পে এরপর মেতে উঠল। পুরো রিসোর্টটাই সুন্দর। সবুজ ঘাসের লন। প্রাকৃতিক বাঁশ, মাটি, কাঠ, দিয়ে তৈরি ঘরের আসবাব, সাজসজ্জা সব। প্রকৃতির মাঝেই গড়ে উঠেছে এ আধুনিক অতিথি নিবাস। রাম- লখনের প্রাথমিক মুহূর্ত আজ অনেকদিন পর তার কাছে একগাদা সতেজ বাতাস। আজ যেন ভেতরের বদ্ধপাখিটা ডানামেলে উড়ল অনেক অনেকটা দিন পর।
ক্রমশ
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments