জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ /পর্ব-৪/স্বপন কুমার দে

এক মুঠো রোদ
পর্ব-৪

স্বপন কুমার দে

জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই মানুষকে নিত্য নতুন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। অতীতকে আমরা দেখেছি,ভবিষ্যত আমাদের অজানা,  কিন্তু বর্তমান আমাদের প্রত্যক্ষ পরীক্ষক। এখানে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই কত কঠিন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়। দমকা ঝড়ে বিপর্যস্ত হয় মানুষ। আবার উঠে দাঁড়াতে হয়।জীবন তো সরলরেখা নয়। কত ওঠা নামা,কত ভুলভ্রান্তি, কত বাধা পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।মাঝপথে হারিয়ে যায় কত প্রতিভা, কত মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। তথাপি পথ চলতে হয়। পরিক্রমা অন্তহীন।

এক একটা সময় আসে মানুষের জীবনে, যখন নিজের কর্তব্য, কর্ম কী হতে পারে, তা সে নিজেই ঠিক করতে পারে না।কখনও অপরের দ্বারা চালিত হয়, কখনও বা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। দিননাথ সামন্ত প্রাথমিক শোক কাটিয়ে উঠল, কিন্তু তারপর তার কী করা উচিত, ঠিক করতে পারল না। একবার ভাবল, এই অবস্থায় মেয়েকে একা বাড়িতে রেখে সে কীভাবে কাজে বেরোবে? তাহলে কি সে আবার বিয়ে করবে? কিন্তু বিয়ে করে যাকে ঘরে আনবে সে যদি মেয়েকে পর করে দেয়, তাহলে? দরকার নেই আবার বিয়ে করার। তাহলে মেয়েকে একা একা ঘরে রেখে কাজে বেরোনো-- সেটাও তো ঠিক নয়। তাহলে এক কাজ করা যাক, ট্রেনে হকারি ছেড়ে দিয়ে বরং পাড়ায় পাড়ায় খবর কাগজ বিক্রি করলে কেমন হয়? এতে মেয়ের কাছে কাছে থাকাও হবে আর কিছু রোজগারও হবে। এরকমভাবে চলুক না কয়েকটা বছর। মেয়েটা একটু বড় হলে তখন  না হয় বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।

মাকে অকালে হারানোর পরেই এক ধাক্কায় মল্লিকার বয়স যেন অনেকটাই বেড়ে গেল। মা চলে যেতেই তার মনে হল যে তার চোখের সামনেই তার সুরক্ষার দুর্গটা আচমকাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। বাইরের তাপ উত্তাপ থেকে রক্ষা করা,ঘর গেরস্থালির কাজ মেয়েকে করতে না দেওয়া মানুষটা কেমন অবিবেচকের মতো হুট করে চলে গেল। এরকম তো কথা ছিল না।মায়ের জন্য তার বুকের মাঝখানটা হাহাকার করে ওঠে। যে ছিল সমস্ত সত্তায় জড়িয়ে, সে কি এক নিমেষেই সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারে? এত টান, এত ভালোবাসা কোথায় গেল? অন্ধকার রাতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। নক্ষত্রের আলোয় মাকে খুঁজে বেড়ায়। কখনও কখনও চুপচাপ বসে থাকে।

মায়ের মৃত্যু মল্লিকার জীবন থেকে সরসতা কেড়ে নিয়েছে। দিনে দিনে সে কঠিন হয়েছে। বাইরের আচরণে এসেছে গাম্ভীর্য। যৌবনের প্রথম পদক্ষেপেই তার মধ্য থেকে প্রেম ভালোবাসার আবেগটাই মরে গেছে।এখন সে অন্য সাধনায় ব্রতী।সংসারের ঘানিটাকে সচল রাখবে কীভাবে? বাবা অনেকটাই অক্ষম, অসহায়।চোখের সামনে দেখছে মেয়ের লড়াই। যে বয়সে অন্য ছেলেমেয়েরা আনন্দে, আবদারে জীবনটাকে সুখে ভরিয়ে দেয়, সেই বয়সে তার মেয়ে  জীবনের আনন্দ, সুখবিলাস দূরে সরিয়ে রেখে নিজেকে লড়াইয়ের মাঠে নামিয়েছে। এ শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই নয়, বাবাকে বাঁচানো, নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। জীবনে সে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। সামনে পর্বত প্রমাণ বাধা। প্রধান বাধা দারিদ্র্য। সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়ার খরচ-- সব তাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।আরও অনেক বাধার মধ্যে রয়েছে বাবার অনিচ্ছা। বাবা চায় না মেয়ে আরও পড়াশোনা করুক। অসুস্থ বাবার একমাত্র চিন্তা, বেঁচে থাকতে থাকতে মেয়েটার একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে শান্তি। এই সমাজে মেয়েরা একা একা খুব অসহায়। তার কিছু একটা হয়ে গেলে মেয়েটার কী হবে? ওর মা যদি বেঁচে থাকত তাহলে কোনো চিন্তাই ছিল না। কিন্তু এখন তাকে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

কথাটা দু'একবার বলবার চেষ্টাও করেছে সে, কিন্তু ততবারই ব্যর্থ হয়েছে। মল্লিকা ঐ প্রসঙ্গটাকে পাশ কাটিয়ে অন্য রাস্তায় হেঁটেছে, গুরুত্ব দেয়নি। একদিন রাত্রিবেলায় বাবা নাছোড়বান্দা, আর মেয়ে কোনো কথা শুনতে চাইছে না। শেষে বাবা নিজেকে সংযত রাখতে পারে না,চিৎকার করে ওঠে, " তোর জ্বালায় কি ঘর ছেড়ে পালাতে হবে?" মল্লিকার মুখ থেকে হাসি উড়ে যায়।অদ্ভূত এক কাঠিন্য দেখা দেয় চোখে মুখে।সে মুখের দিকে চাইতে ভয় হয়।প্রখর গ্রীষ্মে তাপদগ্ধ পৃথিবী রুক্ষ, শুষ্ক, নীরস হয়,অন্তস্থ সরসতা নিমেষে উধাও হয়ে কঠিন মাটি ফেটে চৌচির হয়।তখন সেই মাটি থেকে দেহ শান্তির শীতলতা নেই। মল্লিকার চোখে শ্মশানের নীরবতা ও প্রতিজ্ঞার কঠোরতা দেখেছিল তার বাবা।
মল্লিকা সেই রাতে মাকে স্বপ্নে দেখল। কলতলায় এঁটো বাসন মাজছে। মল্লিকা পড়তে পড়তে দেখল আধ ভেজা আধ শুকনো কাপড় গায়ে মা কাজ করে চলেছে। পড়া ছেড়ে সে পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। মা বলছে, " ছাড়,ছাড়, আমার মেলা কাজ। পড়বি যা। সব সময় ফাঁকি।" মাকে কী যেন একটা বলেছিল সে,আর তারপরই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ মায়ের জন্য সে কাঁদল। মাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করল।

🍂

এভাবেই দিন, মাস, বছর কেটে যেতে লাগল। শোক দুঃখও ফিকে হতে লাগল। তবুও কখনও কখনও নিভৃত অবসরে বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে।পুরানো ক্ষতটা মাঝে মাঝে জেগে ওঠে। তথাপি জীবনটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়।


আজ রবিবার। সকালে ঘরের কাজ মোটামুটি সব সারা হয়ে গেছে। পরপর দুটো বাড়িতে টিউশন আছে। তাড়াতাড়ি করে সামান্য কিছু খেয়ে নেয়।বাবার জন্য খাবার ঢাকা দেয়, চা করে রাখে। বেরোনোর আগে নিজের টাকা পয়সা রাখার জায়গাটায় তল্লাশ করে দেখল গুটিকয়েক দশ,কুড়ি টাকার নোট পড়ে আছে । আগে যা ছিল, ডাক্তার দেখাতে গিয়ে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে একটা দশ টাকার নোট তুলে নিল। বাড়ি ফেরার পথে রিকশ্ কাকুকে দিতে হবে। আজ মাসের তিন তারিখ। নিশ্চয়ই টিউশন বাড়ি থেকে আজ টাকা পাওয়া যাবে।

বেরোনোর আগে বলে গেল, " বাবা! তোমার জন্য চা- জলখাবার রেখে গেলাম। সময় করে খেয়ে নিও।আমি সাড়ে দশটায় ফিরে রান্না করবো।"  বলেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অবাক দৃষ্টিতে বাবা চেয়ে রইল।

দিননাথের জীবনে এখন শুধুই অবসর। বাইরের কাজ সে করতে পারে না।ঘরকন্নার কাজে সে অভ্যস্ত নয়। কাজেই বাড়িতে বসে বসে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড করে সময়টা পার করে দিতে হয়। মল্লিকার জন্য তার খুব মায়া হয়। মা-মরা মেয়েটা রাতদিন কী পরিশ্রমই না করে চলেছে।এজন্য সে নিজেকে দায়ী করে।
" আমার ঘরে না জন্মে ও যদি অন্য ঘরে জন্ম নিত তাহলে ওর জীবনে এত দুঃখ, এত কষ্ট থাকত না। আমি বাবা হয়ে মেয়েকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারিনি,তার কঠোর পরিশ্রমের রোজগারে দু'বেলা খাচ্ছি। খেতে হচ্ছে।"
মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাজের চেষ্টা সে করেছে, যদি কম পরিশ্রমের কোনো কাজ পাওয়া যায়,কিন্তু সেটা হয়নি। এই অবস্থায় ভাঙতে থাকে শরীর ও মন।      ( ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments