জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (আমেরিকা)হনুমানের ফলাহার /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (আমেরিকা)
হনুমানের ফলাহার

চিন্ময় দাশ

পেদ্রা মিনা পাহাড়ের নাম কে না জানে! দুনিয়া ঝেঁটিয়ে লোকজন যায় পাহাড়টা দেখতে। মানুষের ভীড় লেগেই থাকে সারা বছর।
তো, সেই পাহাড়ের উলটো দিকে একটা ফলের বাগান। পাহাড়তলি এলাকা। এপার ওপার চোখ যায় না, এতোটাই বড় বাগানখানা। 
বাগানটা ফলের। দুনিয়ার হেন ফল নাই, যা সেই বাগানে পাওয়া যায় না। আর তাতেই, ফলের লোভে হাজারো জীব জন্তু হাজির হয় বাগানটাতে। সে বাগানে ফল খাওয়ায় মানা নাই কারও। মন যে ফলটি চায়, সেটাই খাও। কারও কোন আপত্তি নাই। 
তবে, নিয়ম আছে ফল ভোজনের। একটা নয়, দুটো নয়। গুনে গুনে তিন-তিনখানা নিয়ম। নিয়ম একঃ গাছের সামনে গিয়ে মাথা ঝুঁকাতে হবে। 
নিয়ম দুইঃ যে ফলটি খাবার ইচ্ছে, সেই গাছের সামনে গিয়ে, নির্ভুলভাবে গাছের পুরো নাম ধরে, সম্বোধন করতে হবে। নাম ছোট বড় যাই হোক না কেন, গাছের পুরো নামটাই বলতে হবে। 
নিয়ম তিনঃ গাছটার নাম ধরে বলতে হবে—গাছভাই, গাছভাই! দয়া করে, তোমার কয়েকটা ফল খেতে দেবে আমাকে? এই “দয়া করে” কথাটা বলতেই হবে। 
ধরো, কারও ডুমুর খাওয়ার সাধ হয়েছে। ডুমুর গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে, বলতে হবে—ডুমুর ভাই, ডুমুর ভাই! দয়া করে, তোমার কয়েকটা ফল খেতে দেবে আমাকে? 
তবে হ্যাঁ, নিয়ম কানুন সব মান্য করে, গাছে চড়ে বসলাম। তার পর খেতে আরম্ভ করলাম। তাই বলে যত ইচ্ছে খাবো ছড়াবো, সেটি কিন্তু চলবে না। নিজেই সব খাবো, বা ছড়াবো—তা বললে চলবে কেন? 
আমিই যদি সব সাবাড় করে দিলাম, তাহলে পরের জন এসে কী খাবে? সবারই তো পেট আছে। সাধ বলো, আহ্লাদ বলো, সেও তো আছে সবারই। তাই না?
আরও একটা কথা আছে, যা তার চেয়েও বড়। গাছে গাছে কিছু ফল যদি থেকে না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে? নতুন গাছ জন্মাবে কেমন করে? নতুন গাছ না জন্মালে, বাগানটাই তো একদিন সাবাড় হয়ে যাবে। 
তবে, সুখের কথা, বনের সবাই মেনে চলে নিয়মগুলো। কেউ অমান্য করে না। 
এ বনে অনেক দিনের একটা পুরাণো গাছ আছে। একেবারে দূরের একটা কোণে আছে গাছটা। সেই কেবল মাথায় বড়, তা কিন্তু নয়। বড় হল তার নামটাও। বড় বলে বড়। ইয়াব্বড় একখানা নাম। তার উপর, তেমনি শক্তও নামখানা। মনে রাখাই দায়। সহজে মনে থাকে না কারুরই।
🍂

গাছটা যেমন লম্বা, তেমনি দেখতে সুন্দর। আরও সুন্দর তার ফলগুলো। ডালে ডালে ঝুলে থাকে ফলগুলো। পাক ধরলে, লালচে আভা ফুটে ওঠে ফলের গায়ে। দেখলেই লোভ হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে ফল খাওয়া কারুরই হয়ে ওঠেনি। গাছটা বড়, উঠতে পারে না কেউ, ফল খাবে কী করে? তা কিন্তু আদৌ নয়। আসল কথা হোল, গাছের নামটা বেশ বড়সড়। তাই তো নামটাই মনে রাখতে পারে না কেউ। তাই ফল খাওয়াও হয়ে ওঠেনি কারও। 
হনুমানের কথাই ধরা যাক। বড় গাছ বলে, তার তো কোন অসুবিধা নাই। যত বড় গাছই হোক না কেন, একেবারে মগডালে চড়ে বসতে ওস্তাদ সে। তারও খাওয়া হয়ে ওঠেনি ফলটা। কারন? কারণ হোল, গাছের অতো বড় নামটা কিছুতে মনে রাখতে পারে না সে।
বনটার একেবারে উলটো দিকে থাকে এক বুড়ি। বেড়ার গায়ে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর তার। অনেক কাল ধরে আছে এখানে। বনের সব গাছই তার চেনা। সব গাছেরই নাম তার জানা। এমনকি সেই বড় গাছটার নামও জানে সে। 
বনে এমন কোন জীব নাই, যে বুড়ির কাছে গিয়ে,বড় গাছটার নাম জেনে নেয়নি। কিন্তু নাম জানলেই তো আর হোল না। গাছের কাছে পৌঁছে, ঠিকঠাক ভাবে বলতে হবে নামটা। কিন্তু বুড়ির কুঁড়ে থেকে গাছেটা এতোখানি দূরে যে, পৌঁছতে পৌঁছতেই নাম ভুলে যায় সবাই। মনে করতেই পারে না। 
নাম মনে করতে পারে না। তাই দ্বিতীয় নিয়মটা মানা হয় না। আজ পর্যন্ত ফলও খাওয়া হয় না তাই কারও। 
একটা হনুমান ছিল বনে। তার ভারি আফশোষ। ফলটা খাওয়া হয়ে ওঠেনি, তার মতো গেছো জীবের কাছে এটা বেশ লজ্জারও ব্যাপার। ভারি মন উস্খুস করে হনুমানের। খেতেই হবে ফলটা। যে করেই হোক। 
একদিন একটা ফন্দী এলো হনুমানের মাথায়। অনেক দিনের একটা গিটার ছিল তার। সেটা বের করে, টুং-টাং বাজিয়ে পরখ করে নিল। না, ঠিকই আছে জিনিষটা। 
মনে ভারি আনন্দ। গিটার বগল দাবা করে বুড়ির বাড়ি গিয়ে হাজির হোল হনুমান। বেশ গদগদ গলা করে বলল—বুড়িমা, বুড়িমা! ঐ বড় গাছটার নামটা বলো না আমাকে। একবার দেখি চেষ্টা করে।
সব গাছের নামই বুড়ির ঠোঁটে। ইয়াব্বড় নামটাও বলে দিল অবলীলায়। হনুমান ভালোই জানে, এত বড় নামটা তার পক্ষে কিছুতেই মনে রাখা সম্ভব নয়। সেজন্যই গিটারটা এনেছে বগলদাবা করে। 
গাছের নাম শুনে, নামটা মুখে বলতে লাগল, আর গিটারটাও বাজাতে লাগল নামের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে। মুখে বলছে, আর গিটার বাজাচ্ছে। গিটার বাজাচ্ছে, আর মুখে বলছে। বুড়ি কখনও দেখেনি এমনটা। হাঁ করে চেয়ে আছে হনুমানের দিকে। 
মহড়া চালাতে চালাতে, বড় গাছটার নীচে পৌঁছে গেল হনুমান। ফন্দী খেটে গিয়েছে ঠিকঠাক। একেবারেই ভুলে যায়নি গাছের লম্বা নাম। কী আনন্দ, কী আনন্দ!
পর পর তিনটা নিয়ম। মাথা ঝুঁকিয়ে, গাছের নাম ঠিকঠাক বলে, হনুমান বলল— দয়া করে, আমাকে তোমার কয়েকটা ফল খেতে দাও, গাছভাই। কথা শেষ করেই লম্বা লাফ। উঠে পড়ল বড় গাছটার একেবারে মগডালে।  
বেশ গর্ব হচ্ছে হনুমানের। আজ পর্যন্ত বনের কোন জীবই ফল খাওয়ার জন্য এই গাছে আসতে পারেনি। এমনকি, কোন পাখিও না। নাম মনে রাখতে পারে না কেউই। আসবে কী করে? মনের পুলকে, চোখ বুজে আসছে হনুমানের।
বেছে বেছে বড় দেখে একটা পাকা ফল পছন্দ হোল। আহা, কী বর্ণ সেই ফলের! ফল খাবে কী, জিভের জলেই মুখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। 
ফলটা এখন হাতে ধরা। একটা ডালে ঠেস দিয়ে বসেছে হনুমান। দাঁত বসাবার আগে, দু’হাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে ভালো করে। এমন ফল। দেখেই মন ভরে যায়। বাইরে যার এমন মন ভোলানো রূপ, ভেতরে কতোই না মিষ্টি স্বাদ! এমন রূপ, এমন সুবাস কোন ফলেই দেখেনি জীবনে। 
আর দেরি সইছে না। দিল এক কামড় বসিয়ে। কচর-মচর করে চিবিয়ে, প্রথম গ্রাসটা গিলেছে, আর যায় কোথায়? বমি উঠে আসবার জোগাড়। 
যেমন ভয়াণক তেতো, তেমনি ব্জ্র টক স্বাদ ফলটার। তেতো আর টক—মিলে মিশে একেবারে বিচ্ছিরি আর বিদ্ঘুটে স্বাদ। গলায় যাওয়া মাত্র, গলা কেটে যাবে যেন। পেটের ভিতর বমি চাগাড় দিয়ে উঠছে। মাথা ঘুরছে বন বন করে। 
গড়িয়ে পড়েই যাচ্ছিল। কোন রকমে সামাল দিল একটা ডাল আঁকড়ে ধরে। ফলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে বেজায় রাগে।
সেদিন থেকে গাছটার নাম ভুলে যায়নি হনুমান। ভুলে যায়নি ফলের বিদ্ঘুটে স্বাদটাও। তবে, ভুল করেও ঐ গাছের ছায়াটিও যে মাড়ানো যাবে না, মনে রেখেছে সেটাও। 
যে দিন নিজে বোকা বনেছে, সে দিন থেকে হনুমানের ভারি ইচ্ছা, বনের অন্য জীবদেরও একই দুর্দশা হোক। ফলটায়  কামড় বসিয়ে, তাদের মুখের চেহারা কেমন হয়—এটা দেখবার ভারি সাধ তার। 
একদিন একে ধরে, আর একদিন ওকে ধরে। গাছের গোড়ায় পৌঁছে, নামটাও বলে দেবে—এমন প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তার কথায় রাজি হয়নি কেউ আজও।
হবে কেন? বনের বাকিরাও জেনে গেছে ফলটা বিস্বাদের। মুখ দেওয়া চলে না ওটাতে। 
আসলে, একটা ম্যাকাও পাখি সেদিন বসে ছিল বড় গাছটায়। নিজের চোখে হনুমানের দুরবস্থা দেখেছে সে। সেদিনই সারা বনে ঘুরে ঘুরে, বনের সক্কলকে বলে দিয়েছে, বড়গাছের ফল আর হনুমানের দুর্দশার কথা। সেদিন থেকে, সবাই সাবধান। কেউ সেই দুর্ভোগে পড়তে চায় না হনুমানের প্রলোভনে।


Post a Comment

0 Comments