পঞ্চবিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল
গোবর্ধন থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে এই তীর্থস্থানগুলি মূল রাজ্য সড়কের বাঁ দিকে। স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশে আমাদের গাড়ি এই রাস্তাতে গেল না। অগত্যা আমাদেরকে পদব্রজে যেতে হল। প্রায় দেড় কিলোমিটার হেঁটে যাওয়ার পরে প্রথমে পড়ল রাধাকুণ্ড রাস্তার ডান দিকে, তারপরে বাঁদিকে ললিতাকুণ্ড এবং পুনরায় ডান দিকে শ্যামকুণ্ড। শ্যামকুণ্ড ও রাধাকুন্ড পাশাপাশি। এই শ্যামকুন্ড ও রাধাকুন্ডের অবস্থান এবং তাদের মহিমা দীর্ঘদিন জনগণ জানতেন না। ১৫১৫ খ্রিষ্টাব্দে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব বৃন্দাবন ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলের লুপ্ত তীর্থগুলি উদ্ধার করেন। রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনীটি হল এই আরিট গ্রামে বা আরিষ্ট গ্রামে শ্রীকৃষ্ণ বৃষরূপধারী অরিষ্টাসুরকে বধ করেছিলেন। একটু দূরে শ্রীরাধিকা তাঁর সখীগনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই যুদ্ধ দেখছিলেন। অরিষ্টাসুরকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার কাছে এসে তাঁর হাত ধরতে গেলে রাধারানী বললেন "তুমি বৃষরূপী অরিষ্টাসুরকে বধ করে গো-বধ হত্যার পাপী হলে। সর্বতীর্থের জলে স্নান না করে তুমি আমার হাত ধরবে না"। এই কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ ভূমিতে পদাঘাত করে একটি কুন্ডের সৃষ্টি করার পরে সেটি সর্বতীর্থের পুণ্যসলিলে ভর্তি হয়ে গেল। সেই কুণ্ডে শ্রীকৃষ্ণ এবং সখীগণসহ শ্রী রাধিকা স্নান করে শ্রীকৃষ্ণের হাত ধরে তীরে এসে রাসলীলা করেন। এই সময়ে শ্রীকৃষ্ণ গর্ব ভরে রাধিকাকে বললেন "দেখলে তোমার কথামত এক পদাঘাতে কেমন সর্বতীর্থের জলে পূর্ণ একটি কুণ্ড করে দিলাম"। এই কথা শুনে শ্রী রাধিকা বললেন " ভারীতো কুণ্ড, তার জন্য তোমার এত অহঙ্কার। আমি আমার হাতের কাঁকন দিয়ে এর থেকে বড় কুণ্ড করতে পারি"। এই কথা বলে শ্রী রাধিকা তাঁর সখীদের নিয়ে শ্যামকুণ্ডের পাশে হাতের কাঁকনের সাহায্যে মাটিতে আঘাত করে একটি কুণ্ড খনন করলেন এবং সখীদের বললেন "তোমরা মানসীগঙ্গার থেকে জল এনে কুণ্ডটি ভর্তি করে দাও"। সখীদের পরিশ্রমের কথা চিন্তা করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন "কষ্ট করে মানসীগঙ্গার জল এনে কুণ্ড ভরাট করতে হবে না। আমি সর্ব তীর্থের জল দিয়ে এই শ্যামকুণ্ডের সৃষ্টি করেছি। এখান থেকে জল এনে কুণ্ড ভরাট করে দাও"।
🍂
বর্তমানে রাধাকুণ্ডকে কেন্দ্র করে একটি শহর গড়ে উঠেছে। রাধাকুণ্ড যাবার পথে স্টেট ব্যাংকের একটি শাখা দেখতে পেলাম। সারা বছরেই তীর্থযাত্রীরা এখানে আসেন। বাজারের ভিতর দিয়েই রাধাকুণ্ডের পথ। কালীঘাট থেকে কাশী পর্যন্ত ভারতের যেকোন তীর্থক্ষেত্রের বাজারের সঙ্গে রাধাকুণ্ডের বাজারের বেশ মিল রয়েছে। সংকীর্ণ বাঁধানো পথের দু'ধারে সারি সারি দোকান। প্রতি বৎসর কার্তিক মাসের কৃষ্ণাষ্টমীর পুণ্য তিথিতে অগনিত পুণ্যার্থীর আগমন হয়ে থাকে এখানে। এই পুণ্য তিথির রাত্রিতে যারা রাধাকুণ্ডে স্নান করতে পারেন তারা সর্বতীর্থ স্নানের ফল লাভ করেন কারণ এই পুণ্য তিথির রাত্রিতেই রাধা-কৃষ্ণ সখীদের নিয়ে রাধাকুণ্ডে জলকেলি করে তীরে এসে রাসলীলা করেছিলেন। রাধা কুন্ডের তীরে মন্দিরে যেয়ে গর্ভগৃহে রাধারানীর মূর্তি, তার ডান দিকে শ্রীকৃষ্ণ এবং বাম দিকে নিত্যানন্দ পত্নী জাহ্নবী দেবীর মূর্তি দর্শন করলাম। জাহ্নবী দেবী এই মন্দির ও ঘাটের সংস্কার করেছিলেন বলে এই মন্দির এলাকাকে জাহ্নবী মাতার স্থল বলা হয়। এখান থেকে কয়েক পা এগিয়ে রাধাকুণ্ড ও শ্যাম কুণ্ডের মিলনস্থলে একটি মন্দির দেখলাম। মন্দিরের রত্নবেদীতে শ্রীকৃষ্ণের চরণচিহ্ন পূজিত হচ্ছেন। কাছেই রাধারানীর মন্দির এবং পঞ্চপান্ডব ঘাট। রাধাকুণ্ডের আট দিকে অষ্টসখীর কুঞ্জ। এছাড়াও জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি এবং মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের বৈঠক মন্দিরে শ্বেতপাথরের বেদীর উপরে শ্রীচৈতন্যদেবের চরণচিহ্ন রক্ষিত আছে। রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের আবিষ্কারের পরে মহাপ্রভু এখানে এসে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন। মহাপ্রভুর স্নানের পরে রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ডের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে ব্রজবাসীগণ অবহিত হন। এবং সমগ্র বৈষ্ণব সমাজে অচিরেই স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রী বৃন্দাবনের রাধাকৃষ্ণ নতুন করে সংস্থাপিত হলেন হিন্দু ভক্তগণের হৃদয় মঞ্চে।
রাধাকুণ্ড ও শ্যামকুণ্ড দর্শনের পরে আমরা গেলাম শ্রীরাধিকার জন্মস্থান বর্ষানাতে। মথুরা থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরত্বে বর্ষানা গ্রামের রাধাবাগে এই মন্দির স্থাপিত। প্রবাদ এখানের রাধারানীর মন্দির প্রায় পাঁচ হাজার বৎসরের প্রাচীন। শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্রনাভ প্রথম এখানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সেই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার পরে ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের শিষ্য নারায়ণ ভট্ট আকবরের রাজস্ব সচিব টোডরমলের সহায়তায় বর্তমানের মন্দির নির্মাণ করেন। পৌরাণিক আখ্যান অনুযায়ী নন্দবাবা ও বৃষভানু (শ্রীরাধিকার পিতা) দুই বন্ধু ছিলেন। গোকুলে নন্দরাজার প্রাসাদ এবং রাওয়াল গ্রামে বৃষভানুর আবাস ছিল। মথুরার রাজা কংসের ক্রমাগত অত্যাচারে নন্দরাজা নন্দগাঁও এবং বৃষভানু বর্ষাণায় তাঁদের বাসভবন স্থানান্তরিত করেন ভানুগড় পাহাড়ের উপরে এই বর্ষানা গ্রামে। বর্ষানা গ্রামের এই রাধারানীর মন্দির শ্রীজী মন্দির নামেও খ্যাত। লাল বেলেপাথরে ও শ্বেতপাথরে ইসলামী স্থাপত্যে নির্মিত খিলান ও স্তম্ভযুক্ত এই বাসভবনে পিতা বৃষভানু ও মা কীর্তিদার সাথে রাধারানী বাস করতেন। মন্দিরের শ্বেতপাথর ও লাল বেলেপাথরের অন্তর্নিহিত ব্যাঞ্জনা হল শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীর প্রেমের অভিব্যক্তিকে পরিস্ফুট করা। নিচের রাস্তা থেকে ১৮০টি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে আমরা উপরে যেয়ে যখন পৌছালাম তখন মন্দির বন্ধ ছিল। যেয়ে দেখলাম অসংখ্য পুণ্যার্থী সেখানে দর্শনের অভিপ্রায়ে সমবেত হয়েছেন। প্রায় আধঘন্টা অপেক্ষা করার পরে বিকেল পাঁচটায় মন্দির জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতে সারিবদ্ধভাবে সকলের সাথে আমরাও উপরে যেয়ে রাধারানী, বৃষভানু, কীর্তিদা, শ্রীদাম এবং ব্রহ্মার মূর্তি যুক্ত মন্দিরগুলি দর্শন করলাম। নাট মন্দিরে তখন উচ্চৈস্বরে রাধা কৃষ্ণের নাম সংকীর্তন হচ্ছে। এছাড়াও মন্দিরে শ্রীরাধিকার অষ্টসখীর বিগ্রহ আছেন। মন্দির চত্বর থেকে নিচে বর্ষানা গ্রাম ও সম্মিলিত অঞ্চলের সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মথুরা থেকে ৫১ কিলোমিটার দূরে বর্ষানা গ্রামের শ্রীজী মন্দিরের প্রধান উৎসব ভাদ্র মাসের রাধা অষ্টমী উৎসব অর্থাৎ যে তিথিতে রাধারানীর জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীতে। শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত রাধারানীকে এবং রাধারানী ব্যতীত শ্রীকৃষ্ণকে কল্পনাও করা যায় না। সেজন্য মন্দিরে যেমন জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয় তেমনি রাধাষ্টমী উৎসবও পালন করা হয়। জন্মাষ্টমী ও রাধাষ্টমীর দিনে মন্দির ও বিগ্রহসকল ফুল ও আলোকমালায় সজ্জিত করা হয় এবং এই দিনগুলিতে বিগ্রহকে ৫৬ প্রকারের ভোগ নিবেদন করা হয়।
মন্দির খোলা থাকে ভোর পাঁচটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত এবং বিকেল পাঁচটা থেকে রাত্রি নটা পর্যন্ত। ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে হোলি উপলক্ষে বর্ষাণার শ্রীজী মন্দিরের সামনে বিকেল বেলায় লাঠমার হোলি শুরু হয়। লাঠমার হোলিতে আবির ও রঙ নিয়ে প্রথমে সখীদের মধ্যে খেলা শুরু হয়। বর্ষণার মন্দিরে নারীরা রঙ ও আবীর খেলায় যখন ব্যস্ত থাকে তখন নন্দগ্রামের পুরুষেরা এসে তাদেরকে রঙ দিতে যান। সেই সময় নন্দগ্রামের সখাদের উপর বর্ষানার সখীরা লাঠি হাতে চড়াও হন। তারা তখন যেন আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের গোপ এবং গোপিনী। লাঠির আঘাত থেকে রক্ষা পেতে গোলাকার একটি পাত্র দিয়ে পুরুষেরা মাথা ঢাকা দেন। শ্রীজী মন্দির থেকে একটু নিচে যে রাস্তা নেমে গেছে সেখানে এই খেলা তারপরে ছড়িয়ে পড়ে। বহু তীর্থযাত্রী এখানে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন এই লাঠমার হোলি দেখার জন্য। চার পাঁচ ঘন্টা ব্যাপী এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিন অর্থাৎ দশমী তিথিতে নন্দগ্রামে এই লাঠমার হোলির আয়োজন করা হয়। সেখানে নন্দগ্রামের সখারা সখিরা যখন রঙ ও আবীর খেলায় ব্যস্ত তখন বর্ষানার সখিরা তাদেরকে রঙ ও গুলালে রাঙিয়ে দিতে যান। সেই সময়ে সখীরা লাঠি নিয়ে সখাদের আঘাত করে তাড়াতে যান। একেই বলা হয় লাঠমার হোলি। মথুরা, নন্দগ্রাম, বর্ষানা প্রত্যেকটি জায়গাতে এই লাঠমার হোলি খুব জনপ্রিয়। ৮৪ ক্রোশ ব্রজমন্ডলের অন্যতম আকর্ষণীয় উৎসব এই লাঠমার হোলি।
পরবর্তী অংশ ষড়বিংশতি পর্বে…………..
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments