জ্বলদর্চি

সেদিনও পৃথিবীই ঘুরছিল/ মিলি ঘোষ

সেদিনও পৃথিবীই ঘুরছিল
 মিলি ঘোষ

গলা তুলে কথা বললেই সত্য কখনো মিথ্যা হয় না। ছড়ি ঘোরালেও পৃথিবীই ঘুরছে। দাবিয়ে রাখলেও পৃথিবীই ঘুরছে। অথচ, মাত্র চারশ বছর আগেও মানুষ উল্টোটাই জানত। দু'হাজার বছর আগে অ্যারিস্টটল, টলেমি যা বলে গেছেন, তা'ই মানুষ আঁকড়ে বসে ছিল। সূর্যই নাকি পৃথিবীর চারপাশে ঘুরত।

স্রোতের অভিমুখে ভাসতে মানুষের চিরকালই ভালো লাগে। কেউ তলিয়ে দেখেননি সত্যিটা কী। শিক্ষিত মানুষের কিন্তু অভাব ছিল না। গ্যালিলিওর বহু আগে কোপার্নিকাস অবশ্য একটি বইতে লিখেছিলেন সূর্য স্থির। পৃথিবী তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু যাজক সম্প্রদায়ের ভয় তিনি বইটি প্রকাশ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ পেলেও বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আরও পরে এই অমোঘ সত্যটি উচ্চারণের ফলে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়। এই পরিণতির কথা ভেবে গ্যালিলিও মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছু শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে কোপার্নিকাসের মতকে সমর্থন করে তিনি জানালেন পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। এই মতের পেছনে অনেক যুক্তিও দেখালেন। প্রচলিত ধ্যান ধারণার ওপরে কুঠার হানলে যা হয়, তাই হলো। অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা যার শিরায় শিরায়, তাঁকে বাধ্য করা হলো জনসমক্ষে বলতে যে, তাঁর আবিস্কার ভুল!
মানুষ কত বড়ো নির্লজ্জ, মূর্খ ও পাষান হলে এই ঘটনা ঘটতে পারে। 

🍂

একটা লোহার বল আর একটা পালক সম্পূর্ণ বাতাসহীন জায়গায় একই উচ্চতা থেকে ফেললে একই সঙ্গে পড়বে, তাও গ্যালিলিও প্রমাণ করেছেন বহু জ্ঞানীগুণী জনের সামনে। সে ক্ষেত্রেও এক বিশাল সংখ্যক মানুষ তা মানতে চাননি। 

কেউ কোনও প্রশ্ন করলে অ্যারিস্টটলের কথা বলা হতো। সেটা ঠিক কী ভুল কেউ ভেবে দেখতেন না। সে যুগে চিন্তা ভাবনার কোনও প্রসার ছিল না। কিন্তু কেউ সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করলে তাকে দাবিয়ে রাখার সব রকম ব্যবস্থা ছিল। তবে, সবাইকে তো থামিয়ে রাখা যায় না। গ্যালিলিও ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ। শিক্ষকদের কথায় সন্তুষ্ট না হয়ে নিজের ছোট্ট বাড়িতেই গবেষণা করে দেখতেন, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। বাতাসের তাপমাত্রা মাপার থার্মোমিটার বানালেন নিজের হাতে। কম্পাস, যা দিয়ে তিনি বোঝালেন পৃথিবীর চুম্বকত্ব শক্তির কথা। জল তোলার জন্য উন্নত মানের লিভার বানালেন নিজের ক্ষুদ্র পরীক্ষাগারে বসে। টেলিস্কোপ আবিষ্কার করলেন। যদিও এক চশমার দোকানের কর্মচারী কাজ করার সময় একটা জিনিস তৈরি করেছিলেন, যা দিয়ে দূরের জিনিস দেখা যায়। এই ভাবনা থেকেই গ্যালিলিও টেলিস্কোপ আবিষ্কার করলেন। একটি বড়ো টেলিস্কোপ দিয়ে তিনি আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন। এই বিষয়ে কিছু প্রবন্ধও লিখলেন। আবিষ্কার করলেন শনির বলয়, জুপিটারের উপগ্রহ। এর ওপর ভিত্তি করে লিখলেন, SIDEREUS NUNCIUS.
অর্থ, সম্মান, খ্যাতির শিখরে তখন গ্যালিলিও। 

১৬১১ সালে শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে সূর্যের ওপর কিছু চিহ্ন দেখতে পেলেন গ্যালিলিও। চলল গবেষণা। অবশেষে কোপার্নিকাসের মতকেই সমর্থন করলেন। ব্রুনোর পরিণতির কথা ভেবে ভয় একটা ছিল। তবু তিনি ঘোষণা করলেন, সূর্য নয়। পৃথিবীই ঘুরছে সূর্যের চারদিকে। 
ব্যাস, যাজক সম্প্রদায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। 
বিচারকদের সামনে গ্যালিলিওকে বলতে বাধ্য করা হলো তিনি যা বলেছেন সব মিথ্যে।
বৃদ্ধ গ্যালিলিও ভয় পেয়েছিলেন। তাঁর শরীরীক ও মানসিক শক্তি তলানিতে ঠেকেছিল। দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এক তরুণ ছাত্রের সেবা যত্নে তিনি জীবনের বাকি দিনগুলো কাটান। ছাত্রের নাম ভিভানি। তিনিই গ্যালিলিওর জীবনকথা প্রকাশ করেছেন প্রথম।

একজন মানুষকে শেষ করে দেবার পক্ষে তৎকালীন যাজক সম্প্রদায় ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তারপর ? 
তারপরেও পৃথিবীই ঘুরছে।


Post a Comment

0 Comments