জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৫ / সালেহা খাতুন

পুত্রসহ অনিতা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৫ / সালেহা খাতুন 

বিশ্ববিদ্যালয়কে গুলে খাওয়া আর কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত ছুঁয়ে দেখার অন্যতম দোসর ছিল অনিতা। অনিতা নেগেল। পাকা গিন্নি। আমার জীবনের নানান পর্ব নির্মাণের কারিগর ও শিল্পীদের মধ্যে ও অনন্য। ওর নামের একটি মাহাত্ম্য ও রক্ষা করতো। সেটি হলো সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা ও খুব পড়তো আর হাওড়া স্টেশন থেকে কলেজস্ট্রিট যাওয়া আসার পথে আমাকে সব গল্প শোনাত। এক বন্ধু একটি বই পড়লে তা আলোচনা করে আমরা অন্যরা এভাবেই তখন ওয়াকিবহাল থাকতাম। মনে আছে মোনালিসা হর্ষ দত্তের নানান লেখা বিকর্ণ, ময়ূরাক্ষী তুমি দিলে প্রভৃতি পড়ে আমাদের কাছে তার রিভিউ দিত। আমাদের প্রতিযোগিতা চলতো কে কত বেশি বই পড়তে পারি। এই করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী থাকাকালীনই বনফুলের সমস্ত উপন্যাস পড়া হয়ে গিয়েছিল। আমাদের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে তখন কী সব রঙ টঙের কাজ হচ্ছিল তাই বইয়ের সেল্ফগুলি বাইরে রাখা ছিল আর আমরা মন ভরে বই চয়েস করে ইস্যু করে নিতাম। অন্নদাশঙ্করের রত্ন ও শ্রীমতি এভাবেই পড়ে ফেলি।

ছোটোদের পড়তে বললে এখন তারা রেগে যায় আর বড়োরা পড়তেই চায় না। শব্দে গাঁথা মণি-মালা পড়তে গিয়ে অনেকে হাঁপিয়ে উঠছেন। প্রশ্ন আসছে আর কটি পর্বের পরিকল্পনা আপনার আছে? কী আর বলি? আমিই কি এর কিছু জানি নাকি? কেউ কেউ আশ্বাস এবং উৎসাহ দিচ্ছেন একেবারে বই আকারেই পড়বেন। তাঁরা নাকি খেই হারিয়ে ফেলছেন। জানি সময় অমূল্য। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমি তাঁদের করেই ফেলি। সময় বাঁচিয়ে কী আর করবেন ভাই। সেই তো একই কক্ষপথে ঘোরা। 

ছেড়ে দিই। নিজের কক্ষপথেই ফিরে আসি। আসলে আমরা বন্ধুরা ছিলাম সৌরমণ্ডলের এক একটা জ্যোতিষ্ক। বেশিরভাগ জনই আমরা পড়াশোনাটাকেই পেশা করে নিয়েছি। বিতান, অনিতা,নমনা,পারমিতা, সুস্মিতা, রুমা আমরা সব জাঁদরেল দিদিমণি। অনিতা মনে হয় চিরকালের দিদিমণি। আমাকে বেশ শাসনেই রাখতো। খাওয়ার পর কুল্লি করতে হবে, ভালো করে হাত ধুতে হবে আরো কত কী! সেই সময় কলকাতায় আমার নিজের খুব বেশি আত্মীয়স্বজন ছিল না। আর থাকলেই বা কী! তারা না ডাকলে তাদের কাছে যাওয়া যায় না। অবারিত দ্বার খুলে কেউ অপেক্ষাও করতো না। কিন্তু অনিতার সঙ্গে ওর মামার বাড়ি বরানগরে বারকয়েক গেছি। বেকবাগানে ওর জ্যেঠতুতো দিদির বাড়ি গেছি। কলেজ স্ট্রিটেও একবার কার একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। মানিকতলা ই এস আই হাসপাতালে সেজো কাকিমা ভর্তি ছিল, রাস্তা চিনিয়ে ঐ নিয়ে গেছে। চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালেও গেছি। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের নাম হাওড়া থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও সঙ্গে ছিল। এখনকার মতো গুগুল ম্যাপ দেখে যাওয়ার সুযোগ আমাদের ছিল না।
সাঁকরাইলের ডেল্টা জুটমিল।

 আর একটি কাজ আমরা প্রায় দিন করতাম। একটা একুশের মেট্রো ধরে সেন্ট্রাল থেকে রবীন্দ্রসদন চলে গিয়ে নন্দনে দেড়টার শোয়ে সিনেমা দেখা। মনে আছে দেড়টার শোয়ে তনুজা আমি দুজনে বেবিজ ডে আউট দেখে বেরিয়েছি, দেখি বিতান বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে। হাতে পরের শোয়ের তিনটে টিকিট। ওর দিদি আর বোনের আসার কথা কিন্তু তারা আসেনি কী আর করা যাবে। আবার হলে ঢুকে পড়লাম। একই দিনে একই সিনেমা দুবার দেখলাম।

 অনিতার বাড়িতে এক অরন্ধনের দিনে আমরা সব বন্ধুরা নিমন্ত্রিত হয়ে গেলাম। কী যত্ন পেলাম ওর বাবা মা এবং পুরো পরিবারের কাছ থেকে। একই বাড়িতে ওর বাবার অন্যান্য ভাইরাও সবাই থাকতেন। নেগেল বাড়ি বেশ প্রতিপত্তি সম্পন্ন। বিরাট বিরাট দরজা। একেবারে অন্যরকম। শুনেছি বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজগঞ্জ জুটমিলের অনেক দরজা জানালা ওর পরিবার কিনে নেয়। সাঁকরাইলের চাঁপাতলায় নেমে ওর বাড়িতে যেতে হতো। সকাল দুপুর যখন খুশি ওর বাড়ি চলে যেতাম। বেশ কিছু পারিবারিক অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছি। বাড়িতে ওর তিন চারজন বৌদির সাথেও আলাপ চলতো। এক বৌদির অসম্ভব ধৈর্য দেখতাম। বিশেষ ভাবে সক্ষম এক সন্তানের মায়ের প্রকৃত সংগ্রাম কাকে বলে নিজের চোখে দেখেছি।

🍂

কেন ওর বাড়িতে এতো যেতাম? ভালোবাসার টান তো ছিলই। এই মুহূর্তে একটি বিশেষ কথাও মনে হচ্ছে। আচ্ছা নেগেল বাড়ির ঐ দরজাগুলিতে আমার পিতামহের স্পর্শ খুঁজতে যেতাম না তো? কেননা আমার নিরক্ষর পিতামহ রাজগঞ্জ জুটমিলেরই শ্রমিক ছিলেন। হয়তো তাঁর হাতের ছোঁওয়া কোথাও না কোথাও রয়ে গিয়েছিল। অবশ্য জুটমিল বিধাতা আমার কপালে লিখেই দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমি আমার পিতামহীকে অতিক্রম করতে পারি নি। তাঁর জীবনসঙ্গী যেমন জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন আমার সঙ্গীও ঐ জুট ইন্ডাস্ট্রিতেই ছিলেন। আর কী অদ্ভুত যোগাযোগ আমার হবুবরের সঙ্গে যেদিন ডেল্টা জুটমিলের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে যাই অনিতার বাবার সঙ্গেও সেদিন ওখানে দেখা হয়ে যায়। অনিতার বাবা ডেল্টা জুটমিলেই চাকরি করতেন। সালাউদ্দিনের কথা ওর বাবা অনিতাকে জানায়। তবে এ অনেক পরের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো অনিতার সঙ্গেই বেশি কাটতো কেননা আমরা দুজনেই এ সেকশনে পড়তাম। আমার পোয়েটিক্স বইয়ে অনিতার কলেজের মাস্টারমশাইকে দিয়ে আমার নাম লিখিয়ে নিই। ঐ স্যারের হাতের লেখা ছাপানো অক্ষরের সাথে একেবারে হুবহু মিলে যেতো। তিনি অনিতার স্যার। অনিতার বইয়ে নাম লিখে দিতে পারেন কিন্তু অপরিচিত আমার বইয়ে লিখতে যাবেন কেন? কী জানি অনিতাকে বকুনি খেতে হয়েছিল কিনা? অনিতা মুখ ফুটে তো কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু মানুষের মন পড়ার কিছুটা ক্ষমতা আমার ছিল। ওকে বললাম, স্যার তোকে বলেছেন না যে এবারের মতো লিখে দিলাম, এই শেষ আর প্রথম। আর কখনো এসব ঝামেলা আনবে না। অনিতা শুধু বলেছিল তুই খুব বুদ্ধিমতী। তবে বারেক আমার পাকাগিন্নি বন্ধু এম.এ.তে যাদবপুরে ভর্তি হয়েও  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে না হলে আজকের আমি অন্য আমি হয়ে যেতাম।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments