জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমিও ভূমা আলোচনায় / স্বপন কুমার দে

কীলক লিপিতে ভূমিও ভূমা
আলোচনায় 
স্বপন কুমার দে
(কবি, লেখক)

কবিরা ভাবেন বেশি, বলেন কম, লিখেন আরও কম।তিনি বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করান। পাঠকের সমস্যা হল ঐ বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুকে আবিষ্কার করা। কাজেই কবির কাজ যতটা কঠিন, পাঠকের কাজ তার চেয়েও কঠিন। বিশেষত ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কবিতা পর্যালোচনা করতে গিয়ে এই দিকটি ভাবিত করে।

কবির মনে নিরন্তর ভাব-অভাবের খেলা চলছে। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে অনন্ত জিজ্ঞাসা এবং তার দরুন কখনও শূন্যতাবোধ, অন্তর্বেদনা, কখনও বা কাল্পনিক স্বপ্ন বিহার মনকে ক্রমাগত দোলায়িত করে। এই দোলাচলতা জীবনের ধর্ম, মননশীলতার ধর্ম। পূর্ণতার সন্ধানে চির অভিযাত্রী মানুষ। চিত্ত তুষ্টির অপরিপূর্ণতার বেদনাই তাঁকে চঞ্চল করে, দোলাচল করে। কিন্তু কবিরা আশাবাদী (optimist)। তাঁরা নিজেরা বেদনা বিষে জর্জরিত হন কিন্তু পৃথিবীকে দেখতে চান বিষমুক্ত। কবিমনের এই সাধনা প্রতিনিয়ত চলমান। আত্মানুসন্ধান তাঁর নিষ্ঠা, জগৎ নির্মাণ তাঁর ব্রত।

ঋত্বিক ত্রিপাঠী-র কবিতা বা কাব্য পর্যালোচনা করতে গেলে একটু সতর্ক থাকতে হয়। তিনি যে ধরনের কবিতা লেখেন, তা বুঝতে গেলে তাঁকে বারবার পড়তে হয়। তারপর চুপ করে ভাবতে হয়। শব্দের প্রয়োগ এবং তার অনুষঙ্গ ব্যবহারে কবি যেমন সাবধানী আমাদের বোধশক্তি তেমনই সতর্ক থাকা উচিত। রূপের আধারে যে অরূপ রতন আছে তাকে খুঁজে পেতে ডুব দিতে হবে অভিজ্ঞ ডুবুরির মতো।

' কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা'—এই কাব্যের নাম কবিতাটি একেবারে শেষ কবিতা। কীলক বা কিউনিফর্ম লিপি নিয়ে অনেক সম্মানীয় পণ্ডিত ব্যক্তিই অনেক কথা বলেছেন। আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি বরং অন্যভাবে শুরু করি।

সুপ্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার অতি প্রাচীন লিপি এখানে রূপকের আধারে পরিবেশিত আর ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুষ্কোণ প্রভৃতি হল প্রতীক। প্রকৃতপক্ষে মানব সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে উৎপন্ন এবং কালক্রমে বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত বহুব্যাপ্ত চিন্তারাশি মানব সভ্যতার সংগঠক তাই এখানে বিবেচ্য।

বস্তুজগৎ এবং ভাবজগৎ এই দুই জায়গা কবি-মানসের বিচরণ ক্ষেত্র। কবিরা যেহেতু সামাজিক তাই সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও আছে। জাগতিক যন্ত্রণা আছে কিন্তু যন্ত্রণা মুক্তির উপায় নেই। মানুষ আর মানুষের প্রতিবিম্ব। একটার ছায়ায় আরেকটা ঢেকে যায়। 'আত্মস্বীকার' কবিতায় কবি যখন বলেন, "আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দু'হাতে ঢেকে রাখা", তখন নিজেদের দিকে তাকানো ছাড়া আর কীই বা থাকতে পারে? এ এক অমোঘ সত্য। বিজ্ঞাপনের ঝলকানিতে আসল নকল হারিয়ে যায়।

'আশ্চর্য নততল' কবিতায় কবি আমাদের দাঁড় করিয়েছেন সেই জায়গায় যেখানে মানুষ বীতস্পৃহ, বীতকাম, নির্বিকার এক সত্তা মাত্র। অতীতের স্বপ্ন মাখা কৈশোর যৌবনের সিঁড়ি ' ওপর থেকেও যা, নীচ থেকেও তাই।" সেকারণেই "কোনও দুঃখই দুঃখ নয়, এখন আমার।"

সংগ্রহ করতে পারেন 👇
কবির ভাবনায় এসেছে সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতিক চিত্র- ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ, সমকোণ, বৃত্ত, কেন্দ্র, -- এসেছে ছেদ, যতি, ইত্যাদি। এগুলোর দ্বারা জীবনের বৈচিত্র্য বোঝানো হতে পারে।

'মহাকবির ব্যঞ্জনা ' কবিতাটি আমার কাছে একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।
"হতে পারে তিন বাহু তিন সত্তা।
ত্রিভুজের মধ্যে বৃত্ত। বৃত্তের কেন্দ্র একটাই।"

এক দেশীয় দেশপ্রেমের মধ্যে যে অসম্পূর্ণতা আছে, মানবপ্রেমের মধ্যে তাই পূর্ণতার সন্ধান করে। দেশ, মহাদেশ ছাড়িয়ে পূর্ণ বিশ্বপ্রেমের সাত্ত্বিকতায় শুদ্ধ হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতাবোধ। এই কবিতায় দারুণভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে অভিধা, লক্ষণা, ব্যঞ্জনা।

বিশ্ব মানবতাবোধ কবিমনে অতি যত্নে রক্ষিত। দেশভেদে মনুষ্যত্বের তো আলাদা আলাদা সংজ্ঞা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটা হয়ে থাকে। কবি কিন্তু 'সংজ্ঞার বিপরীতে' হেঁটেছেন, "চেয়েছি বলেই দেশ নইলে তো একটাই পৃথিবী হয়।" কী অসাধারণ অভিব্যক্তি।

কোনও কোনও কবিতায় পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, গ্রহ, গ্রহাণু, নক্ষত্রপুঞ্জের লক্ষ কোটি সম্ভারে পূর্ণ বিশ্বসৃষ্টি সমকোণ দূরত্ব বজায় রেখে চির গতিশীল। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে নোয়াম চমস্কি এবং আনন্দবর্ধনের কথা। কাব্যের আত্মা নির্মাণে ধ্বনি না রস প্রাধান্য পাবে তা নিয়ে বিতর্ক চলুক কিন্তু কাব্য হোক জীবনময়, জীবন রসে রসাক্ত।

এরকম আরও অনেকগুলি কবিতার সংকলন এই গ্রন্থ। বইটির আকৃতি ছোট হলেও এর ব্যাপ্তি বিশাল। সময় নিয়ে পড়তে হয়। এটি অবশ্যই একটি সংগ্রহযোগ্য গ্রন্থ।

🍂


Post a Comment

0 Comments