জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /পঞ্চম পর্ব /মলয় সরকার

কাঠের আকাঙ্খা পত্র( Ema)

উদয়ের পথে
পঞ্চম পর্ব
মলয় সরকার

এখানে এই উয়েনো পার্কে পুরানো দিনের মন্দিরের স্মৃতিচিহ্নরূপে আজও রয়েছে একটি দীঘি, যার নাম Shinobazu Pond।
এ ছাড়া এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম, যেমন টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম,ন্যাশয়াল সায়েন্স মিউজিয়াম, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ওয়েস্টার্ণ আর্ট, টোকিও মেট্রোপলিটান আর্ট মিউজিয়াম ইত্যাদি। এছাড়া গেট দিয়ে ঢোকার মুখেই চোখের উপর ঝিলিক মারবেই একটি বড় দর্শনীয় চিড়িয়াখানা Ueno Zoo, যা চলছে সেই ১৮৮২ সাল থেকে। এইটিই জাপানের সবচেয়ে পুরানো চিড়িয়াখানা, যা প্রায় ৩৫ একর জমির উপর দাঁড়িয়ে আছে।

তবে আমাদের যেহেতু সময় কম ছিল, তাই আমরা কোন চিড়িয়াখানা বা মিউজিয়ামেই ঢুকতে পারি নি, যদিও আমার নিজের ধারণা, মিউজিয়াম না দেখলে, সেই দেশটাকে ঠিক ঠাক জানা হয় না।কি আর করি,  বাধ্য হয়ে শুধু পার্কেই কিছুটা ঘুরলাম।এখানে সব ঠিক ঠাক দেখতে গেলে প্রায় একসপ্তাহ লাগবে বলেই আমার ধারণা, সেটা  তো আর সম্ভব নয়।

এ ছাড়া ঝিরঝিরে বৃষ্টিও এসে গেল। তার মধ্যেই ছাতা নিয়ে ঘুরছিলাম। 

এরই মধ্যে ঢুকলাম একটি শিন্টো মন্দিরে , যার নাম Tosho Gu। এখানে যে মুর্তি টি আছে তার নাম Tosho Daigongen। আসলে এটি বুদ্ধের আর একটি রূপ, যে রূপে উনি সৃষ্টিকে রক্ষা করেন এবং শান্তি দেন।খুব সুন্দর এবং শান্ত মন্দিরটি। এমনকি এর ঢোকার যে পথটি তাও বড় সুন্দর।সমস্ত পথগুলিই বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা, যেন মমতাময়ী মায়ের শান্ত আঁচলের তলায় লক্ষ্মী ছেলের মত শুয়ে রয়েছে। এখানে এরকম এবং এটি ছাড়াও বেশ কিছু ছোট খাট মন্দির রয়েছে।
শিন্টো মন্দির তোশো গু (Tosho Gu)

পার্কটি একটি পাহাড়ী মত, অনেক উঁচু -নীচু বা ঢাল রয়েছে।আমরা মন্দিরের যাওয়ার রাস্তায় সারি দিয়ে অনেক বড় বড় ব্রোঞ্জের দাঁড়ানো লণ্ঠন দেখেছিলাম। যেগুলি বড় বড় ধনীরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দিয়েছেন।

এখানে দেখলাম, একটি বড় কাঠের স্ট্যাণ্ডে ঝোলানো রয়েছে অসংখ্য কাঠের প্লেটের ছোট ছোট টুকরো। এরকম অবশ্য আমরা আগে বা পরেও অনেক জায়গায় দেখেছি। একে বলা হয় এমা(Ema)। এর গায়ে পেন দিয়ে জাপানী ভাষায় কিছু লেখা।একজন জাপানী ভদ্রলোক জানালেন, এগুলি মানুষের সুপ্ত বাসনা পরিপূর্ণ হওয়ার কামনায় দেওয়া। এ ব্যাপারটা পৃথিবীর সব দেশেই আছে, কোথাও পাথর বাঁধা, কোথাও কাপড়ের টুকরো বাঁধা, কোথাও তালা চিবি। এখানে দেখছি কাঠের টুকরোয় লেখা।ব্যাপারটা একই। মানুষের বাসনারও শেষ নেই, পূর্ণও কখনও হয় না, সেটা সব ধর্মের মানুষেরই। আসলে এটা ধর্মের উপর নির্ভর করে না বোধ হয়। করে মানুষের চির অতৃপ্তি আর , আরও পাওয়ার আকাঙ্খার উপর।কাজেই এটা পৃথিবীর সব জায়গাতেই আছে।

এই মন্দিরের একটি বিশেষত্ব রয়েছে। 

আমরা জানি, ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট পৃথিবীর প্রথম আনবিক বোমা পরে জাপানের হিরোসিমায়, এবং দ্বিতীয়টি নাগাসাকি তে ৯ই আগষ্ট।এই উয়েনো শোগু শ্রাইনের ভিতরে একটি অনির্বাণ শিখা জ্বলছে, যেটি সেদিনের হিরোসিমার বোমার ফলে যে আগুন জ্বলেছিল, সেই আগুনের থেকে নেওয়া এবং অপরটি নাগাসাকিতে তৈরী করা, এই দুই শিখার মিশ্রণে তৈরী। এটি আসলে শান্তির প্রতীক । বোঝাতে চাওয়া হয়েছে, যে, ওইরকম ধ্বংসলীলা যেন পৃথিবীতে আর কখনও না হয়।
🍂

তবে মন্দিরটি নাকি অনেক সময়েই বন্ধ থাকে। তাই ভিতরে ঢোকা গেল না। তবে বাইরে থেকেই এটির কারুকাজ, ও পারিপার্শ্বিক দৃশ্য শান্ত পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা আমাদের মন ভরিয়ে দিল।


এখানে একটি বাগান রয়েছে,, যার নাম Peony garden। পিওনি একটি বড় সুন্দর প্রায় থোকা গোলাপের মত বড় রঙীন ফুল। এগুলি নানা রঙের হয়।এই বাগানে না কি প্রায় পাঁচ শ’র উপর পিওনি গাছ আছে। এখানে বছরে দুবার , জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী ও এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত পিওনি উৎসব হয়।এই পিওনি বাগানটি চীন ও জাপানের মৈত্রীর স্মৃতিচিহ্ন। এর প্রথম কিছু গাছ চীন থেকে আনা হয়েছিল। তবে এর ভিতরে ঢোকা খুবই মূল্যসাপেক্ষ । তাই বাইরে থেকেই যা দেখা গেল , তাই অল্প দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম।

 এখানে আশেপাশে বেশ কিছু বিভিন্ন ধরণের ছোট বড় মন্দির ও তাতে নানা ধরণের দেবতাদের মূর্তি দেখা গেল। আকাশ আবার মেঘলা হয়ে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি নামল।সঙ্গে সঙ্গে সবার হাতের ছাতা যন্ত্রের মত উন্মুক্ত হল।
এ এমনই বৃষ্টি, বিশেষ কাজের ক্ষতি হয় না, তার মধ্যেই সব কাজ চলে।আমরা তার মধ্যে বসলাম, এক পাতাওয়ালা গাছের তলায়। দুপাশে দেখতে লাগলাম, ওই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি আর অল্প হাওয়ার সাথে বাতাসে উড়ছে পাখীর পালকের মত অজস্র চেরী ফুলের পাপড়ি। বড় সুন্দর দৃশ্য।মনে হল এক কবিতা বা গানের কি স্বপ্নের জগতে বসে আছি। ভাবুন তো  একবার মনে মনে চোখ বন্ধ করে, পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছি, কোন কাজ নেই, ঝিরিঝিরি বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বাতাসে উড়ছে চেরী ফুলের পাপড়িরা , তৈরী করছে স্বপ্ন দৃশ্য, মাটিতেও পড়ে রয়েছে ফুলের পাপড়িরা এক শ্বেতশুভ্র আস্তরণ , আশে পাশে কোন শব্দ বা ভিড় নেই–।এর পর কি আর কিছু লাগে? আমার তো মনে হয় এর অনুভবই কবিতা বা সঙ্গীত।প্রাণভরে সেই সঙ্গীত উপভোগ করতে লাগলাম চোখ বুজে।

 দূরে দেখা যাচ্ছে চিড়িয়াখানার বন্ধ দরজা ও দু একটি মিউজিয়ামের গেট। সামনে প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা। বেলা পড়ে এল। 

এগোতেই হল বাইরের দিকে।এটা ঠিক, দেখা হল না বিশাল উয়েনো পার্কের অনেকখানিই। তবু যা রইল অধরা, থাক না। সব কিছুই কি ধরা দেয় আমাদের কাছে। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা ধরা দেয় আমাদের কাছে।কবিগুরু তাই অধরা মাধুরী কে ধরতে চেয়েছেন তাঁর ছন্দের বাঁধনে, সুরের জালের মধ্যে।

এখান থেকে বেরোনোর মুখে সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি রূপ নিল অবিশ্রান্ত তুমুল বৃষ্টির।বুঝলাম, কেবল ঝিরঝিরেই নয়, প্রবল বর্ষণও হয় এই চেরী ফুলের দেশে।

বাধ্য হয়ে বহুক্ষণ দাঁড়াতেই হল এক বিশাল অডিটোরিয়ামের তলায়। লক্ষ্য করলাম , যাঁরা ছাতা হাতে আসছেন, কেউ ছাতা নিয়ে ঘর জলে জলময় করে ফেলছেন না। সবাই ছাতা স্ট্যাণ্ডে ছাতা রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সেখানে ঢুকছেন। বুঝলাম, কারোর ছাতা কারোর তুলে নিয়ে যাওয়ার বা ছাতা না এনে অন্যের ছাতা নিয়ে চলে যাওয়ার মত , আমাদের দেশীয়,মনোভাব হয়ত ওদের নেই।
( এই ব্যাপারটা আমাদের এখানে এতই প্রসিদ্ধ যে, কেউ কোথাও চটি জুতো কি ছাতা বাইরে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে যেতে সাহসই পাবেন না। ছাতার ব্যাপারে অনেকেই পরের জিনিসকে নিজের জিনিস ভাবতেই বেশ অভ্যস্ত)।

 তবে এটা যে সম্পূর্ণ সত্যি , তা ঠিক মনে হয় না, কারণ কোনো কোনো জায়গায় ছাতা লক করে রাখার ব্যবস্থাও দেখেছি। তবে অনেকে বলেন, এই যে ছাতাগুলো ওরা ব্যবহার করে এগুলো ভিনাইলের সস্তা ছাতা। যদি কেউ দামী ছাতা ব্যবহার করে সে অবশ্যই চুরির ভয় করে বা তার জন্য আলাদা সাবধানতা নেয়। তবে শুনেছি, জাপানে যত মানুষ , তার থেকে ছাতা বিক্রী বেশি হয়, অর্থাৎ একজন মানুষ একের বেশি ছাতা কেনেন।
আর ছাতা পর্বে যখন এলামই, একটু দেখে নেওয়া যাক এখানের ছাতার কথা। কারণ জাপান বলতেই আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে এক জাপানীসুন্দরী সেই কিমানো পরা আর হাতে জাপানী ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
এই ছাতারা প্রথম জাপানে আসে চীনের হাত ধরে( কেউ বলেন কোরিয়া),সেই প্রায় ১৫০০ বছর আগে।সে সময় ছাতা তৈরী হত কাঠের ফ্রেমের উপর সিল্ক দিয়ে।তাই এর নাম ছিল 'সিল্ক ছাতা' বা কিনুগাসা (Kinugasa)।এগুলো বেশ বড় হত এবং রাজারা বা উচ্চ অভিজাতবর্গই এই ছাতা ব্যবহার করতেন।
এর পর সাধারণের জন্য ছাতা আসে ১১৮৫ সাল নাগাদ।তখনও এগুলো বেশ বড় ছিল এবং সাধারণের জন্য ব্যবহারের বেশ অসুবিধা ছিল।

ইদো রাজত্বের সময় (১৬০০-১৮৬৮) এটি সকলের হাতে উঠে এল।এটি অনেক হাল্কা ছোট ও সকলের ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠল।এটি তৈরী হত বাঁশ, কাঠ, তৈলাক্ত কাগজ ইত্যাদি দিয়ে ।এটি তৈরী করাও খুব সহজসাধ্য ছিল না।তবে এটি বেশ টেকসই ছিল।এর নাম ছিল ওয়াগাসা, Wagasa । জাপানী সৌখিন ছাতা বলতে এই ওয়াগাসাকেই বোঝায়।
উয়েনো চিড়িয়াখানা

পরে মেইজি রাজত্বের সময় (১৮৬৮-১৯১২) ইউরোপীয়ান ছাতার প্রচলন হওয়ায় ওয়াগাসার চাহিদা কমতে আরম্ভ করে।
জাপানে লাল ছাতার অর্থ আলাদা। এই লাল রঙ সাধারণতঃ বিয়ের সময় ব্যবহার হয়।এই রঙ প্রাণশক্তি ও অশুভের থেকে রক্ষা করার প্রতীক। তাই কনেকে এই ছাতা দিয়ে আড়াল করা হয়।
আজকাল বেশিরভাগ ছাতাই স্বচ্ছ কাপড়ের তৈরী এবং তা মাথা মুখ ঢেকে যায়।আসলে, ছাতা ঢেকেও যাতে ব্যস্ত রাস্তা দেখে পথ চলতে অসুবিধা না হয়, তাই এই ব্যবস্থা।

আমরা ট্যাক্সি ডাকলাম। হাজির হলেন এক সুন্দরী, স্যুটেড বুটেড টাই পরিহিতা।এখানে এই এক সুন্দর ব্যবস্থা ,সমস্ত ক্যাব ড্রাইভারই ,সে ছুঁড়ী কি বুড়ী, ছোঁড়া কি বুড়া সবাই,সুন্দর স্যুট প্যান্ট টাই পরিহিত। এখানে যা ট্যাক্সি চলে তা বেশীর ভাগই DiDi, বা Go Taxi, কি Uber চলে। আরও দু একটা চলে নানা ধরণের। রাস্তায় সাইকেলও অনেক চলে। হাতে টানা রিক্সাও কয়েকটা দেখলাম।সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তাও আছে।পাড়ার ভিতরে অনেক জায়গাতেই ফুটপাথ রাস্তার থেকে উঁচু নয়। একটা সাদা দাগ দেওয়া আছে রাস্তার দু’ ধারে, সেটাই ফুটপাথ।
আজকের মত ঘোরা শেষ হল। বাড়ি এলাম যখন ,বৃষ্টি নেই আকাশে। পাড়া শান্ত।লক্ষ্মীছেলের মত যেন ঘুমিয়ে আছে।

চলুন পরের দিন যাব অন্য জায়গায়। সঙ্গে থাকুন–

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments