জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৩ /বিজন সাহা

ভোলগার মাছ ধরুয়া

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৩ 

বিজন সাহা 

লেনিন মিউজিয়াম 


পরের দিন সকালে আমরা গেলাম লেনিনের হাউজ মিউজিয়াম দেখতে। কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়ল প্রচণ্ড সুন্দর এক গির্জা। নীল–সাদা মাঝে সোনালী গম্বুজ একেবারেই অন্য রকম লাগছিল। আর আকারেও ছিল দশাসই। ব্যস্ত চৌরাস্তার মোড়ে ও যেন হাত নাড়িয়ে ডাকছিল আমাদের। আমি সাথে সাথেই দেমিদকে বললাম গাড়ি থামাতে। বেঁকে বসল দিলীপ। ও কিছুতেই নামবে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল আমি কয়েক মিনিটের জন্য নেমে ছবি তুলে ফিরে আসব। এটা ছিল স্পাসো-ভজনেসেনস্কি কাফেদ্রালনি সাবর। জানি না দিলীপ না নেমে কিছু হারিয়েছে কিনা, তবে এতে যে ওর কোন লাভ হয়নি সেটাও সত্য। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০ বছর আগে হেরাক্লিট বলেছিলেন একই নদীতে দুইবার নামা অসম্ভব। আমার ধারণা শুধু তাই নয়, একই বই দুই বার পড়া অসম্ভব, যেমন অসম্ভব একই শহরে দুইবার আসা, একই কাজ দুইবার করা। কেন? কারণ প্রতিটি মুহূর্তে বদলায় পারিপার্শ্বিক অবস্থা। আমার বেশ কিছু প্রিয় ছবি আছে। কিছু মস্কোয় তোলা, কিছু দুবনায়। অনেক বার চেষ্টা করেছি সেসব ছবি নতুন করে তুলতে, মূলত অপেক্ষাকৃত ভালো ক্যামেরা যখনই হাতে এসেছে। কিন্তু একটি ছবিও এমনভাবে তুলতে পারিনি যাতে সেটা অবিকল আগেরটার মত হয়, সেটা হয়েছে একেবারেই নতুন ছবি। কারণ একটাই - শুধু পারিপার্শ্বিক অবস্থাই বদলায় না, বদলায় মানুষ নিজে। কিছু প্রিয় বই একাধিকবার পড়েছি, বিশেষ করে দস্তইয়েফস্কির লেখা। প্রতিবারই নতুন করে সেসব বই উপলব্ধি করেছি। তাই যখন কোথাও যাই, চেষ্টা করি সীমিত সময়ের মধ্যেও যত বেশি সম্ভব দেখার জন্য, জানার জন্য। শহর তো শুধু ইট কাঠ আর পাথর নয়, মানুষের মত শহর, গ্রাম, জনপদ সবই জীবন্ত। এমনকি নির্জন রাস্তাঘাট সেটাও জীবন্ত। কারণ সেখানে বদলায় মেঘের রূপ, বদলায় আকাশের রং। ক্রম পরিবর্তনশীল এই মহাবিশ্বে প্রতিটি মুহূর্তই অনন্য, প্রতিটি জায়গাই অনন্য। কোন কিছুই আর ফিরে আসে না। কিন্তু দিলীপকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। এই এক সমস্যা। অনেকের কাছে চার্চ বা যেকোনো উপাসনালয় শয়তানের সামনে ক্রেস্ট বা ভূতের সামনে তুলসি পাতার মত কাজ করে। কেন যেন খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে। যদিও খুব ইচ্ছে ছিল ভেতরে গিয়ে দেখতে, কিছু ছবি তুলতে, তারপরেও বাইরে থেকে খুব দ্রুত কয়েকটি ছবি নিয়ে ফিরলাম গাড়িতে। দিলীপের মুখ থম থম করছে। আমি তখন কিছু বললাম না। তবে ঠিক করলাম এখান থেকে তলিয়াত্তি যাবার পথে হাতে যে কয়েক ঘণ্টা সময় পাব তখন এ নিয়ে কথা বলব। 

ভোলগা তীরে বরফের রৌদ্র স্নান

লেনিনের বাড়ি - এ নামেই পরিচিত উলিয়ানভস্কের লেনিনের হাউজ মিউজিয়াম। এটা রাশিয়ার প্রথম লেনিন মিউজিয়াম। উলিয়ানভ পরিবার ১৮৭৮ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সিমবিরস্কের এই বাড়িটির মালিক ছিল। বর্তমানে উলিৎসা লেনিনা ৬৮ বা ৬৮ লেনিন স্ট্রীটে অবস্থিত সেই বাড়িটি লেনিন মিউজিয়াম। এখানেই সিমবিরস্ক এলাকার শিক্ষাবিদ লেনিনের পিতা ইলিয়া উলিয়ানভ বসবাস করতেন। এখানেই কাটে ভ্লাদিমির ইলিচের স্কুল জীবন। আট থেকে সতের বছর পর্যন্ত এটাই হয় তাঁর বাসস্থান। উলিয়ানভরা ১৮৭৮ সালে এই বাড়িটি ক্রয় করেন। আইনগত ভাবে বাড়ির মালিক ছিলেন লেনিনের মা মারিয়া আলেক্সাদ্রভনা। লেনিন ১৮৭০ সালে সিমবিরস্কে জন্মগ্রহণ করেন অন্য বাড়িতে। ১৯৭০ সালে লেনিনের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যে বাড়িতে লেনিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটার সংস্কার করা হয় ও সেখানে স্মারক চিহ্ন স্থাপন করা হয়। তবে ভ্রমণের সময় আমরা সেখানে যাইনি। যাহোক, ফিরে আসি লেনিন মিউজিয়ামে। এখানেই পরিবারের সন্তানেরা শিক্ষা লাভ করে, তাদের সন্ধ্যা কাটে দাবা খেলে বা সাহিত্য আলোচনায় অথবা বিভিন্ন ধরণের হাতের কাজ করে। এই বাড়িতেই তারা লেনিনের বড় ভাই আলেক্সান্দারের স্বর্ণপদক পাবার সংবাদ পান। এই বাড়িতেই ১৮৮৬ সালে ইলিয়া উলিয়ানভ ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। এক বছর পরে এখানেই তারা খবর পান জার হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আলেক্সান্দার উলিয়ানভের ফাঁসির খবর। ১৮৮৭ সালে এই বাড়িটি বিক্রি করে উলিয়ানভ পরিবার সিমবিরস্ক ত্যাগ করেন। ১৯২৩ সালে এই বাড়িতে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নামে ঐতিহাসিক-বিপ্লবী মিউজিয়ামের উদ্বোধন করা হয়। ১৯২৮ – ১৯২৯ সালে বাড়িটি খুব যত্ন সহকারে সংস্কার করা হয়। মিউজিয়াম তৈরির কাজে লেনিনের ভাই ও বোনেরা আন্না, দ্মিত্রি ও মারিয়া ও তাদের সমসাময়িক অনেকে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই বাড়িটি সেই সময়ের মফঃস্বল শহরের স্থাপত্যের সুন্দর ও বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ। বর্তমানে এই মিউজিয়াম বিভিন্ন ক্লাব ও শিশুদের সংগঠনের সাথে সহযোগিতা মুলক কাজকর্ম করে। উলিয়ানভস্ক এলাকার তরুণ ও যুব সমাজের সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করে লেনিন মিউজিয়াম।          

🍂

মিউজিয়ামের মূল এক্সপোজিশন একটা দোতলা বাড়ি, পেছনে বেশ কিছুটা জায়গা বাগান মত, টিউব ওয়েল, ছোট্ট এক রাস্তা আর তার দুই ধারে পপলার গাছের সারি, আর ছোট ছোট কিছু ঘর। আমাদের দেশের মধ্যবিত্তদের বাড়ির মত। সেখানে হাস্নাহেনার মত একটি গাছ দেখে কর্মরত মহিলাদের প্রশ্ন করলাম, জানলাম ইন্ডিয়া থেকে ওগুলো আনা। আমাদের দেখে বেশ গল্প জুড়ে দিলেন। বুঝলাম আজকাল আর বিদেশীরা খুব একটা এদিকে আসে না। সরকার থেকে কিছু আর্থিক সাহায্য থাকলেও মিউজিয়াম মূলত চলে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির অর্থ সাহায্যে। পার্টি নেতারা নিয়মিত এখানে আসেন। লোকজন যে আসে না তা নয়, তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা বদলে গেছে। তবে এখনও অনেকেই উলিয়ানভস্ক এলে এখানটা বেড়িয়ে যায়। শত হলেও লেনিন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের একজন আর তার বাড়ি উলিয়ানভস্কের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান। মূল মিউজিয়ামে বেশ কয়েকটি ঘর। লেনিন যেখানে ঘুমাতেন, যেখানে পড়াশুনা করতেন এসব তেমনি রয়ে গেছে। আছে বেশ কিছু পারিবারিক ছবি। হয়তো সোভিয়েত আমলে এলে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অন্যরকম আবেগ কাজ করত, মনে হত তীর্থ দর্শনে এসেছি। এখন তেমন কিছু ছিল না, তবে কোন রকম অশ্রদ্ধাও ছিল না। 

অস্তগামী জাহাজ

কোন জায়গা সম্পর্কে মানুষের ধারণা গড়ে ওঠে সেই এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় স্থানের ইতিহাসের উপর। মানুষের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটে। যেমন আগ্রা সম্পর্কে কথা বললে প্রথমেই মনে আসে তাজমহলের কথা, যদিও আগ্রার গোড়াপত্তন হয় অনেক আগেই আর আকবরের তৈরি দুর্গ কম দর্শনীয় নয়। মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে আমার প্রতিক্রিয়ার কথা। এর আগে আমি তাঁকে পাকিস্তানবিরোধী নেতা হিসেবেই জানতাম, জানতাম বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে। কিন্তু যখন অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ে জানলাম অবিভক্ত ভারতে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা ছিলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার ধারণা, এটা যদি আত্মজীবনী না হয়ে অন্য কোন বই হত, সেসব বিশ্বাস করতে আমার বেশ কষ্ট হত। একই কথা বলা চলে উলিয়ানভস্কের ক্ষেত্রে। সোভিয়েত আমলে আমার ধারণা ছিল উলিয়ানভস্ক লেনিনের জন্মভূমি বলেই এত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই পর্ব লিখতে গিয়ে ইতিহাস ঘেঁটে জানলাম লেনিন জন্মের অনেক আগে থেকেই ভোলগা তীরের অন্যান্য অনেক বড় শহরের মত রুশ সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা ও বানিজ্যে সিমবিরস্ক দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটা ঠিক যে অক্টোবর বিপ্লব ও পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে লেনিনের জন্মস্থান হিসেবে উলিয়ানভস্ক বিশেষ সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু সেটা কোন মতেই বিপ্লব পূর্ববর্তী সিমবিরস্কের গুরুত্ব ম্লান করে না। 

ঘণ্টা খানেক মিউজিয়ামে কাটিয়ে এলাম বাইরে। রাস্তাটা মনে হয় আগের মতই আছে। বাড়িঘর কাঠের তৈরি। মনে হয় অধিকাংশ বাড়িঘর শত বছরের পুরানো। লেনিনের পারিবারিক ডাক্তারের বাড়িও এই রাস্তায়। আরও কিছু পরিবারের বাড়ি যারা উলিয়ানভ পরিবারের সাথে বিভিন্ন ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। হয়তো এসব কারণেই এই রাস্তায় নতুন কোন বাড়িঘর তৈরি হয়নি। তবে যা আছে সবই সাজানো গোছানো। আমরা বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম নয়টার একটু পর পর। মিউজিয়াম ও আশেপাশের ঘরবাড়ি দেখে যখন সামারার দিকে রওনা হলাম তখন এগারোটা বাজে। 

লেনিনের বাড়ি 

https://youtu.be/QvxgKjox-j8

সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments