আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
দশম পর্ব
-’তারা! ও তারা! কি করছিস লো! তা আমায় আবার ডেকেছিস কেন রে!’
চৈত্রের শেষ। ঘাটের পৈঠায় নিজের প্রিয় জায়গাটিতে দুপুরবেলা একাই বসেছিল বিরজা,বাড়ির সবাই দিবা নিদ্রায় মগ্ন।
হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার মতো পিঠ ছাপানো কোঁকড়া চুল দুলিয়ে এসে পৌঁছলো কুমু। আঁচল ভরা টোপাকূল। মা নেই, বাবার কাছে মানুষ। বাবা তো আদর দিয়েই খালাস, বাড়িতে মেয়েলিপনা শেখাবার কেউ নেই, তাই মেয়েটি স্বভাবেও খানিক ডাকাবুকো।একা একাই বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, একমাথা ঝাঁকড়া চুলে অধিকাংশ দিন তেল পড়ে না,সারাদিন ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়ায়, নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। তাই পাড়ার মা-ঠাকুমারা একেবারেই তাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু বয়সে খানিক বড়ো হলেও সে ছিল বিরজার বন্ধু। দুটি বিপরীতধর্মী কন্যা কিসের যেন মোহে পরস্পরকে ভালোবাসতো ঢের।
অবশ্য বন্ধুত্ব ছিল নামেই, কুমু কথা
বলতো, বিরজা শুনতো। পাড়ায় কার ঘরে কি হচ্ছে,কোন বনে কি ফল পেকেছে, কার সঙ্গে কার ঝগড়া…কতো কি জানতো কুমু;এর’ম দুপুরে বা এলোমেলো সময়ে হঠাৎই সে এসে পৌঁছতো,গুষ্টির খবর এবং ফল-পাকুড় যা থাকে সব দিয়ে আবার তেমনই পালিয়ে যেত, বাড়ির কেউ জানার আগেই।
পাড়ার লোকজন যে তাকে পছন্দ করতো না,তা সে জানতো,তাই সচরাচর আসতো না। বিরাজও জানতো সব, তবু জেদি মেয়েটি মিশতো বন্ধুর সঙ্গে, হয়তো দুই মাতৃহারা কন্যে পরস্পর পরস্পরের ব্যথা বুঝতো বলেই…
এবার অবশ্য বিরজা নিজেই ডেকেছিল তাকে,সবার সামনেই।
চার পাঁচ দিন হলো বাপের বাড়ি এসেছে,বন্ধুরা সবাই দেখা করতে এসেছে, কাঁচের চুড়ি,সেমিজ দেখে মনে মনে ঈর্ষা করেছে হয়তো;কিন্তু একমাত্র সে আসেনি। হয়তো ভেবেছিল, বিয়ে হয়েছে, তাই তাকে ভুলে গেছে বিরজা।
🍂
কিন্তু আসলে তো তা নয়;জীবনভ’র কখনও বিরজা কাউকে ভোলেন নি, আর কুমু তো প্রিয় বন্ধু তার। মনে মনে ভেবে রেখেছে দুগাছি সৌখিন কাঁচের চুড়িও ওকে দেবে; চাইলে ফিতেও। কিন্তু ও তো আসছেই না…
একা একাই বসে বসে, এসব কথা ভাবছিল তখনই কুমু এসে বসলো পাশটিতে, কি মনে করে হাতে রাখলো হাত।
কেন কে জানে! হু হু করে উঠলো বিরজার মন, কি যেন এক বিয়োগব্যথা হাওয়ায় হাওয়ায়, দুজনের চোখের তারায় ভাসতে লাগলো।
টলটলে জল চোখে নিয়ে কইলে,
-’আসিসনি কেন এ্যাদ্দিন!’
-’এই তো এলাম!’
-’’ডাকতে হলো;তোকেও! তবে তো…’
হঠাৎ গলা জড়িয়ে কান্না চেপে কুমুর বিকৃতস্বর শুনলো বিরজা,
-’যদি কেউ কিছু বলে! তুই যে এখন বড়ো বাড়ির বৌ!’
সেই প্রথম ছোট্টো মেয়েটি বুঝল, সামাজিক অসাম্য সম্পর্কেও কতোখানি ছায়া ফেলে!
পরে পরে সারাজীবন এটিকেই টেনে নিয়ে যেতে হয় মানুষকে, ভালোবেসে অথবা না বেসেও…
গতকাল বেলা গড়িয়ে গেলে,জ্যাঠাইমার সঙ্গে গাজন মেলায় গিয়েছিল বিরজা, নিজের সঙ্গে সঙ্গে কুমুর জন্যও খেলনা বাটি নিয়ে এসেছে কুমোরকাকার কাছ থেকে, তারপরে বিন্তির হাতে খবর পাঠিয়েছে কুমুকে,দেখা করার জন্য,তারপরে এই দেখা।
ছোট্টো থেকে একা-একাই বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় গেলেও এবার বিয়ে হয়েছে বলেই জ্যাঠাইমা একা যেতে দিলেন না, নিজে নিয়ে গেছেন। তাছাড়া সে নাকি এখন বড়ো বাড়ির বৌ; তাই তার এখন থেকে একা একা কোথাও যাওয়া মানা;এমনকি বন্ধুদের সঙ্গে দিনরাত হুটোপুটিও নাকি কমাতে হবে।
চিরকালের জেদি, এমন সব নিয়মকানুন ভালো লাগে না মেয়েটির, তবু বড়োদের কথা শুনতে হয় বলেই ছোটবেলায় শুনতো বিরজা।
পরে পরে, জীবনের অদাক্ষিন্যের দায় তার ওপরে যতো চেপেছে, প্রিয়জনেরা সম্পর্কে, বিয়োগে যতো তাকে ছেড়ে গেছে, সে এসব শৃঙ্খল ভাঙতে শিখেছে।
কিছু কিছু নিয়ম কানুন অমান্যও করেছে করার প্রয়োজন ছিলো বলেই, তবে শেষ শয্যার আতুর দিনগুলিতে এসে ইদানীং যেন পরিনত মনে বৃদ্ধার অনুভূতিতে জাগে,নিয়মের সৃষ্টিই তো লয়ের জন্য, জন্মের শেষ যেমন মৃত্যু। তারও মধ্যে থাকে মায়া এবং মোহ, সব না পাওয়া জীবনকেও যা জড়িয়ে রাখে, ভরিয়ে রাখে। তা নইলে জীবন যে চলেনা।
এমন সব ব্যতিক্রমী দিনে, পাতা ওড়ানো উতল বাতাসে অথবা ঝরোঝরো বর্ষার রাতে,অপর্যায়বৃত্ত ঘটনাবলীর মধ্যেও যেমন প্রকৃতি পর্যায়বৃত্তের ইতিবৃত্ত লিখে রাখে, তেমনই কি যেন এক অকারণ মন কেমন ভেসে বেড়ায় ইতিউতি, বুকটা খালি খালি লাগে, মনে পড়ে যায় অন্য কোন জন্মের, অন্য কোন ঘটনার কথা ; দুঃখ-সুখের দোলাচল…
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments