জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (চতুঃপঞ্চাশত্তম পর্ব)/ শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত  ( চতুঃপঞ্চাশত্তম পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

লোখা আকাশপাতাল ভাবে। হায়! সে কি তবে ভুল কোরলো বলে। কেমন করে মাস্টারকে স্বান্তনা দেবে সে। এই নিশ্চুপ পাথরের মতো বসে থাকার ধরণ তার মোটেই ভাল লাগে না। যদি কিছু হয় মাস্টারের! সে তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। হাটতলার পশ্চিম কোণায় দাঁড়িয়ে আছে রথ। দোকানের আলোর আভায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রথের গায়ে আঁকা দেবদেবীদের চোখের তারা জ্বলজ্বল করছে। সন্তোষী পূজায় রথ টানা হয় হাটতলা থেকে দুলাপাতার মাঠে। বহুদিনের এই রথ।  আগে খুব জমজমাটি মেলা হত। এখন তেমন ভিড়ভাড় হয় না। হাট তলার পাশেই ডোমপাড়া। ডোমেদের ব্যান্ডপার্টি,ব্যাঞ্জোর দল আছে। রথে তারা বিনা পয়সায় বাজায়। এটা তাদের পূর্বাপুরুষ থেকে কৌলতি। লোখা মাস্টারের কাছ থেকে একটু সরে আসে। খগেন মাস্টারের চোখ তখনও স্থির হয়ে আছে কাঁসাইয়ের জলের দিকে। লোখা রথের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়। হাতজোড় করে বিড়বিড় করে,
– মা গ তুই মেস্টারের মুখের দিকে এট্টু তাকা। মানুষটার যেন কুনু ক্ষতি না হয়। মাধুর বরের যেন কিছু না হয়।তোর রথে পাঁচ কেজি বাতাসা ছড়াব মা গ।
বলেই নাক কান মুলে প্রণাম ঠুকে কপালে। মনের ভিতরটায় বাদুড়ের মতো ঝটপটানি শিরু হয়। আর চুপ থাকতে পারে না সে। ধীর গলায় বলে,
— কি হোলো গ মেস্টার? তুমি যে এগবারে নিচুপ মেরে গেলে! কেনে এত চিন্তা করঠ। কিচ্ছু হবেনি। এখন ঘরকে চল দিখি।
আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস লোখাকে থামিয়ে দেয়। তারপর  আনমনেেই যেন মাস্টারের মুখ কলকলিয়ে ওঠে,
– চ রে – চ। অনেক রাত হয়ে যাচ্চে। আমি কুনু চিন্তা করিনি রে। মোর কিছু হবেনি। কার জন্যে, কেনইবা চিন্তা কোরবো বল দিখি। শুধু নিজের ভাগ্যটাকে লিয়ে ভাবি, জানু। তরা মোদের অই মন্দিরের রাক্কসিটাকে মা মা বলে হরদম মাথা ঠুকু নি। তাকে জিয়ে এগদিন জিগ্যাস কোরবি দিখি। বোলবি মোদের মেস্টারের কপালে আর কত কষ্ট লিখেছে সে!
লোখা স্পষ্ট বুঝতে পারে মাস্টারের কান্না জড়ানো গলার স্বর। এই হল পুরুষ মানুষের বিড়ম্বনা।তাকে কাঁদতে নেই। বুকের ভিতরে যতই হাহাকার করুক, বাইরে তা প্রকাশ করা যাবে না। কান্না মেয়েদের অলঙ্কার,পুরুষদের নয়। চোখের জল নাকি পুরুষত্বকে ছোট করে দেয়। লোখা মনে করে এমন পৌরুষের দম্ভকে ধিক! মাস্টারের মনের যে যন্ত্রণা,হয়তো কাঁদলে একটু কমতে তো পারে। ভিতরের চাপা কষ্ট কথা বললে, কাঁদলে একটু হাল্কা হয়। বাপ মারা গেল। মায়ের সেকি আছাড়বিছাড় খাওয়া। চিৎকার করে সেকি কান্না। জেঠি-খুড়িরা থামাতে গেলে রাধু জেঠা বল্লে,
– তমরা বউমাকে থামাও নি। অকে এট্টু কাঁদতে দাও। মানুষটার শোক ভুলা ত সজা লয়। এট্টু কেঁদে লিলে মনের যন্তনা খানিকটা উপশম হবে। কাঁদু উ, থামাও নি।
সেই থেকে লোখা জানে চোখের জলের গুণ। নোনা জল অন্যের মনকে জয় করে নিতে পারে। নিজের মনকেও শান্ত করতে পারে। মাস্টারের এখন কাঁদা খুব জরুরী। কিন্তু ওই ঠুনকো একটা পুরুষত্বের দোহাই দিয়ে চোখের জলকে জোর করে আটকে রাখবে সে। মাস্টারের বাঁ হাতটা জাপ্টে ধরে লোখা বলে,
— তমাকে সেই নেংটাবেলা থিকে চিনি। মোর কাছে লুকানা অত সজা নয় গো মেস্টার। তমার মনের ভিতরে কি হয়ঠে এখন তা শুদু আমিই জানি। কুন্তু অত ভেঙে পড়নি। সব ঠিক হই যাবে। এখন চল দিখি ঘরকে।

ঢোল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। সারাদিন খাটাখাটনির পর শরীর বিছানা চায়। আবার সকাল হলেই তো পুরুষদের বেরিয়ে পড়তে হবে গামছা কাঁধে। সবার তো আর জমি নেই। থাকলেও তাতে সব্জি চাষের জো কোথায়! সব তো জলা জমি। জন মজুর খাটাই শেষ সম্বল। যেই সকাল হল টিফিনকারিতে পান্তাভাত নিয়ে গামছাটা কাঁধে ফেলে হাঁটা শুরু। মোহন সাঁতরা,নন্দ ভূঁঞ্যা, লক্ষ্মণ ঘাঁটিরা মাটি কাটার দল করেছে ইদানিং। দূরদুরান্তে ঝড়া- কোদাল নিয়ে সাইকেল হাঁকিয়ে চলে যায়। ধান রুয়া আর কাটা- ঝাড়ার কাজ ঠিকায় করে। জগা, পেত্যবা, গোদোরা তো সারাবছর সারেঙ জাল টেনে পেট চালায়। ভাত মুড়ি ছাড়া কি আর জোটে তাদের। তার উপরে কাজ ফেরত মদ গিলে প্রায় সকলেই। শরীর কত আর অত্যাচার সইবে। ঘরে ফিরে এক ঝমক খিস্তিখেউড় করে, চাট্টিখানি খেল কি খেল না করেই লুটি পড়ে বিছানায়। লোখার ফিরতে দেরি দেখে ময়না জেগেই ছিল। বিছানায় শুয়ে সে  ছটপট করেছে অনেক রাত অব্দি। সাতপাঁচ চিন্তা চোখের পাতাকে কিছুতেই এক হতে দিচ্ছিল না। ময়না ঘুমের ঘোরেই একবার জিগ্যেস করেছিল তাকে,
– কেনে ছটপট করঠ? শরীল খারাব লাগেঠে নাকি?
— তুই ঘুমি যা। কিছু হয়নি মোর।
লোখা ময়নাকে বলতে চায় না মাস্টারের কথা। দাদু তার ছড়া কেটে বোলত, আহাম্মক নম্বর নয়/ যে গোপন কথা বউকে কয়। লোখা বউ জাতকে কিছুটা অন্য চোখে দেখে। কোনকিছুতেই পুরাপুরি সে বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু মাস্টারের জন্য সে সব কিছু করতে পারে। রাতে একা মানুষটা ঘরে কি করছে এই চিন্তায় তার চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায়। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রা আসে। কিন্তু বাগদি পাড়ার ঘুম ভাঙে কাকাভোরে। তারা ঘুমোতে যায় আগে।ঘুম থেকে জাগেও সবার আগে। তবে তাদের আগে জেগে যায় পোষ্য পশুপাখিরা। সাগরীর হাঁস - মুরগী খুঁদি থেকে চিলচিৎকার শোনা যায। জগার ছাগল ভেড়ার পাল গুঁতাগুঁতি করে। চিতন গাই-বাছুর টেনে নিয়ে যেতে যেতে আনাধুস খিস্তিখেউড় করে। ময়না প্রতিদিনের মতো ভোরেই শাঁখ বাজায়। পাড়ার মেইয়া- বউড়িরা ভোরের লাতা ঝাটা দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। চারদিকের গজগজ আওয়াজে লোখার ঘুম উবে যায়। বিছানায় ওলট পালট খায়। এম্নিতে সে বিছানায় জেগে শুয়ে থাকতে পারে না। উঠেই মাঠ বিল কালিতলা আর নদীবাঁধ হয়ে এক চক্কর দিয়ে আসে। আজ যেন শরীরের জোর পাচ্ছে না। হঠাৎ ময়না ঝড়ের বেগে ঘরে ঢোকে। কাত হয়ে শুয়ে থাকা লোখাকে ঠেলা দেয়,
– কী গ এখনো শুয়ে পড়ে আছ যে! উদিকে দিগার পাড়ায় কান্নাগুলি পড়েচে! উঠে দেখ না কী হোল! সবাই ছুটে যায়ঠে।
দিগার পাড়ার কথা শুনতেই ধড়ফড় করে উঠে পড়ে লোখা। লুঙ্গিটাকে ভাঁজ করে এঁটে, দুয়ারের বাঁশ থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে খরখর করে হাঁটা দেয়। কোথায় পাউড়ি পড়ছে তার সেইদিকে হুঁশ নেই। কালিতলার কাছে গিয়ে দেখে বটতলার চাথালে মুখ নিচু করে বসে আছে খগেন মাস্টার। পাশে বসে আছে ভব মন্ডল, শিবা জানা, ঝন্টু কপাট আর মাধুর বাপ সুবল দিগার। লোখার বুঝতে অসুবিধা হয় না, সে যা আশঙ্কা করছিল সেটাই হয়েছে। ধীর পায়ে তাদের পিছনে দাঁড়ায়। লোখাকে আসতে দেখে ভব মন্ডল বলে,
– চোলায় লোখু,বোস। 
লোখার নাম শুনতেই মাস্টার ঘাড় তুলে তার দিকে তাকায়। চোখাচোখি হতেই লোখার বুকটা ভিজা গামছা মোচড়ানোর মতো কে যেন একটা মোচড় দিয়ে দেয়। একমাত্র সে-ই তো জানে এই মুহুর্তে কী হচ্ছে মাস্টারের মনের ভিতরে। কিন্তু সবার সামনে নিজেকে কত স্বাভাবিক রেখেছে। কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চাইছে না। লোখাও মাস্টারের কথা ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চায়। ওদিকে সুবল পিয়নের চোখের জল কাছুতেই থামে না। থেকে থেকেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আর বলে,
—মোর মেইছেনাটার কপালটা ছোট থিকেই খারাব। নিজের মা'টা ত গেল অকালে। আর ইটা ত সারাক্ষণ দাঁতে চিবাত। বিয়া হয়েও শান্তি পাইনি মোর নিরীহ মেইছেনাটা। জানতম জামাইটা সনাবালা,রোজগার ভাল কুন্তু অমন মাতাল আর চরিত্তহীন বলে জানতম নি! নাইলে উ রোগ হয়?
অন্য সময় হলে ঝন্টা গলাটাকে জেঁকে গম্ভীর স্বরে কথা বলত। কিন্তু এই দুঃখজনক সময়ে সে গলার স্বর স্বভাবিক রাখে,
– ইসব কথা এখন রাখ দিখি, সুবল'কা।  যা হবার ত হোয়ে গেছে। এখন মোদের চেষ্টা কোত্তে হবে মেইছেনাটার ভবিষ্যৎ কি কোরে ভাল হয়। তার উবরে একটা ছোট ছেনা আছে। নিজেরা এখন একটা আলোচনা কর। তারপর মেইছেনার শ্বশুর ঘরে জিয়ে বাকি কথা হবে। না কি বলঠ ভব'কা?
—ইটা ত তুই ঠিকই বোলচু। মড়ি ত দেশকে আনবেনি নাকি রে সুবল?
🍂

—মড়িকে ত আনবেই নি,তাবাদে মোর মেইছেনাটাকেও তাদের ভিটাকে এসতে দিবেনি বলে শুরিঠি।
লোখা এসব কথায় নিমিষে রেগে খঁচে যায়। কিন্তু আজকে কিছুটা নিজেকে সংযত রেখে বলে,
– ইটা আবার কুন দেশি কথা! মোদের মেইছেনার কি দোষ হয়ে গেল?
শিবা লোখাকে ঝাপট দেয়,
– তুই থাম দিখি এখন। কথাটা পকিত কেউ বোলেচে কিনা তার ত পমাণ নাই। উ শুনা কথার বুনা ধান। তারচে তুই এগবার এগি যা দিখি ভগী খুড়াকে ডেকে আনবি। আর খগেন, তুমি কিছু বল?
–হুঁ,বলো!
এমন করে উত্তর দেয় সে যেন কোন চিন্তার অতলে ডুবে ছিল। শিবা জানার কথায় তার চমক ভাঙে। কিন্তু তার চোখমুখ দেখে বোঝা যায় সে যেন পাই হারা হোয়ে গেছে। কিছু বলার মতো অবস্থায় সে নেই। সুবল পিয়ন মাধুর বাপ। জামাই মরেছে তার। অথচ তার চেয়েও যেন গভীর শোকের আগুন ধিকিধিকি করে মাস্টারকে পোড়াচ্ছে সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু সেই দহনের ক্ষতচিহ্ন কোনমতেই সে প্রকাশ করতে চায় না। মৃদুস্বরে বলে,
–সবাই ত আছ,চিন্তাভাবনা কর,কি করা যায়। আমি আর কি বোলবো।
সুবল কোনকিছু ভোলেনি। খগেন তার মেয়েকে ভালবাসত। দ্বিতীয় পক্ষের বউয়ের জেদে আর নিবজের সম্মানের কথা ভেবে মেনে নিতে পারেনি সেই সম্পর্ক। গ্রাম সালিশে তখনকার খগেনকে অসম্মানও করতে ছাড়েনি সে। কিন্তু মাঝে তো কেটে গেছে কয়েকটা বছর। মাস্টারের এই কথা শুনে তার মুখের দিকে চায় সে। আর ভাবে তাহলে এখনও কী রাগ পুষে রেখেছে খগেন। এরকম একটা শোকের দিনেও সে পুরানো দিনটাকে মনে রেখেছে! কিন্তু সুবল জানে বিপদ এখন তার মাথায়। তাকেই নত হয়ে এগোতে হবে। তাই সরাসরি খগেন মাস্টারকে উদ্দেশ্যে করেই বলতে থাকে,
— সবাই বোলতে ত খগেন তমারাই আছ। তমরা ছাড়া গেরামে কাকে আর পাব। এগবারটি সকলে চল। মোর মেইছেনাটা নাইলে জলে ভেসে যাবে এগবারে। লাতিটা যে মোর দুধের শিশু এখনো।
লোখা তখনও দাঁড়িয়েছিল। ভগী খুড়াকে ডাকতে যায় নি। সুবল পিয়নের কথা শুনে মনে মনে রাগে গরগর করে, 
— অ বেদাশালা কি যেন মধুমাখা কথা বলেঠে এখন। তখন ত খুব টেম্পার দেখিছিলি। মেস্টারকে পাঁোচজনের আসনে কাঁদিছিলি। সেদিন যেদি সব মেনে লিতু থাইলে আজগে ইসব ঘোটত! অর বউটা এখন কি করেঠে দেকলে হত! অই মড়াকান্না কাঁদেঠে লোক দেখানি। সব গুলান ঢেমনার গাছ।

Post a Comment

0 Comments