জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /ত্রয়োদশ পর্ব/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
ত্রয়োদশ পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
  
অতঃপর নিদাঘ নির্মল সেই পূর্বাহ্নে চারিজনা কাহার বাহিত সুসজ্জিত পালকিমধ্যে ততোধিক সুসজ্জিতা অষ্টম বর্ষীয়া তারা শ্বশুরালয় সমভিব্যাহারে যাত্রা করিল। পথিমধ্যে ইতস্তত আম্রকানন,ধান্যক্ষেত্র,নাব্য শস্পভূমি,পুষ্করিণী পড়িল;মৃদুমন্দ বায়ুর মৃদুল হিল্লোল, বৃক্ষশাখা মধ্যে সতত সঞ্চরণশীল বিহগ দম্পতির সপ্তসুরের কাকলী কলতানে নববধূর স্বামী সন্দর্শনের সুপ্ত ইচ্ছাকে অভিনন্দিত করিতে লাগিল। সেই প্রথম এক একাকিনী গ্রাম্য কন্যা অপরিচিত বহির্বিশ্বের সহিত পরিচিত হইতে হইতে নিরতিশয় পরম বিস্ময়ে গন্তব্যের পথখানি অকুতোভয়ে অতিক্রম করিল।
…এককালে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন বিরজাসুন্দরীর প্রিয় লেখক। ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে সাধুভাষা ব্যবহার করতেও খুব ভালোবাসতেন। আজও রোগশয্যায় শুয়ে সেই যাত্রাপথটির সুখরোমন্হনে সাধুভাষায় লেখা এমনই কোন এক জলছবিই যেন আঁখিপাতে ভেসে উঠলো। আপনমনে হেসে উঠলেন।ভাবলেন,বিপদ আঘাত তো আকস্মিকই আসে,পূর্বাভাস না দিয়েই। এবং এলে তা যত অসহই হোক না কেন, সহ্য করার শক্তিও মানুষ অর্জন করে ফেলে,কারণ জীবন যে অনিন্দ্য! 

তাই, পরে পরে যত অঘটনই ঘটুক না কেন, সেদিনও
 কিন্তু ছোট্টো মেয়েটি অবাক আনন্দে পালকির ছন্দে দুলতে দুলতে চারিদিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে পথ চলেছিল;এবং চৌধুরী বাড়ির পালকি তাদের নতুন বৌকে নিয়ে ঠিক সময়েই বাড়ির উঠোনে পৌঁছেছিল,মা আর খুড়িমা একসঙ্গে এসে আদর করে শাঁখ বাজিয়ে, গৃহদেবতা রাধামাধবের মন্দিরে প্রণাম করিয়ে তাকে ঘরে তুলেছিলেন। খুড়িমার মেয়ে কাত্যায়নীও সেই সময়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। বয়সে খানিক বড়ো হলেও তারা ছিল প্রায় সমবয়সী, ননদ-ভাজে ভাব হতে তাই বেশি সময় লাগেনি। তারপর সেবার, যতদিন ছিল, সারাদিন শুধু বকবক আর বকবক!... 
নতুন বাড়ি, নতুন মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাপের বাড়ির কথা ভুলেই গিয়েছিল তারা। 

বিয়ের সময়ে,যখন প্রথম এসেছিলো ঐ বাড়িতে, একগাদা লোক লস্কর ছিলো, তাই কারো সঙ্গে তেমন আলাপ পরিচয়ই হয়নি। 
সেবার বাড়িতে শুধু বাড়ির লোক। তাই দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পরে, ননদ ভাজে গল্প জুড়েছিল; নতুন জীবন, পুতুল, বন্ধু, কাজকর্ম শেখার দৌড় কার কতোটা…
ইত্যাদি ইত্যাদি। 
তবে ঐ;গল্প শুরু হওয়ার খানিক পরেই বিয়ে হওয়া সব মেয়েদের গল্পেই তো বর এসে পড়ে;কাত্যায়নীর কথাতেও তার বরের কথাই বেশি ছিল। কিন্তু তারার তো সে সৌভাগ্য তখনও হয়নি, তাই সে শুনছিল শুধু, আর মনে মনে অপেক্ষা করছিল, কবে যে তারও এমন রঙিন সব গল্পের ঝুলি উপুড় করার সৌভাগ্য হবে!... 
এখনও মনে পড়লে  শীর্ণ গালদুটিতে বোধহয় রঙ লাগে;আনমনে হঠাৎ লাজলজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ঠাকুরঝিকে, 
-’হ্যাঁ লা ঠাকুরঝি, তোর দাদা কি আসেনি?’ 
-’এয়েছে তো! কেন! তোর সঙ্গে দেখা হয়নি?’
মুখ নীচু করে জবাব দিয়েছিল প্রোষিতভর্তিকা, 
-’না’। 
🍂

 অতঃপর  ননদের বুদ্ধিতে তাদের দেখা হয়েছিল। দাদাকে পান দেওয়ার ছলে সে তার বৌদিদিকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে গিয়ে উপস্থিত হয়। 
দিগগজ মশাই তখন বাগানের আমগাছের তলায় যথারীতি নিরিবিলিতে বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে, নব শ্যামল পত্রপল্লবঘন আমগাছটি মুকুলে মুকুলে সুগন্ধিত, কোকিল ডাকছে বিজন মধ্যাহ্নে…
তারা দুই সখী পা টিপে টিপে কাছে গেল, কাত্যায়নী মৃদু স্বরে ডাকলে, 
-’দাদা!’
বোনের ডাকে একবার মুখ তুলে তাকিয়েই চমকে উঠল ছেলে;
-’এমা! তোরা এখানে কেন?’
-’নতুন বৌ ঘরে এয়েচে, তুমিই বা দেখা করনি কেন!
-’সত্যি দাদা! সে ভারী অন্যায় তোমার। বৌদিদি এসেছেন, আর তুমি এখনও গাছতলায় বসে বসে বই পড়ছো!’
অন্য কোন পুরুষ কন্ঠ শুনে এক গলা ঘোমটা টানলে বিরজা; কাত্যায়নী তো হেসেই কুটোপাটি… 
ইতিমধ্যেই যে আরও একজন তাদের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, লক্ষ্য করেনি তারা! 
তারপরে, সেই গাছতলায় দুটি বিবাহিত সদ্যতরুণ এবং দুটি নিতান্তই গ্রাম্য বালিকা দম্পতির যে আনন্দময় খুনসুটি চলেছিল, আজকালকার প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে তা একান্তই কল্পনাতীত। শুধু মনে পড়ে, কথায় কথায় তার দিগগজ বর বলেছিল, 
-’বুঝলি বোন, বৌদিদির কাছে লেখাপড়া শিখে নে এইবেলা!’
জামাই ঠাকুর চোখ কপালে তুলে বলেছিলেন, 
-’আপনি পড়তে জানেন বৌদিদি!’
-’শুধু বাংলা নয়, ও ইংরেজি ফার্স্টবুকও পড়েছে।’

বলতে বলতে কী যেন এক উজ্জ্বল আলো খেলা করছিল তাঁর মুখে;ঘোমটার আড়াল থেকে চোখ তুলে বড়ো লজ্জায়, বড়ো ভালোলাগায় তাকিয়েছিল তারা।

ঠাকুর জামাইও অবাক চোখে তাকিয়েছিলেন, ঠাকুরঝি মুখে হাত চেপে শুধিয়েছিল,
-’ও বৌ! সত্যি তুই পড়তে জানিস? শেখাবি আমায়!’ 

ছোট্টো মেয়েটি মুখ নামিয়েছিল। লেখাপড়া শেখাতে আপত্তি তো তার ছিলনা,বই তো তার ভালোবাসার জিনিস। তবু সময় হয়নি তাদের একসঙ্গে পড়তে বসার;কারণ,জীবন তাদের দুজনের সখীত্বের স্বীকৃতি দেয়নি,এবং পারস্পরিক জীবনের অভিমুখও ছিল ভিন্ন।

অনেক অনেক দিন পরে, চারছেলের মা কাত্যায়নীর সঙ্গে যখন দেখা হয় বিরজার,বিধবা ভাতৃবধূকে সে ঠোনা দিয়ে শুনিয়েছিল,
-’কি লাভ হলো এতো লিখে পড়ে? ভগবান তো কোলে কাঁখে মারলে তোকে। চাট্টি টাকা ছাড়া আর কি আছে তোর?’ 
অবশ্য শুধু তো ননদিনী নয়, জীবনভর আরও অনেকেই তার দুর্ভাগ্যের জন্য বইপড়াকেই দায়ী করেছে বা করেছেন।
কথা বিরজা ভালোই জানেন, মুখরা বলে কুখ্যাতিও আছে;অল্পবয়সী বিধবার নিজেকে রক্ষা করতে, নিজের ন্যূনতম প্রাপ্তি বুঝে নিতে মুখের ঝাল তো রাখতেই হয়। 
শুধু এই ক্ষেত্রে বিষন্ন শুভ্রবস্ত্র পরিহিতা ব্যথা পেতেন,নিশ্চুপ থাকতেন, প্রতিবাদ করতেন না। তবে বইকে ছাড়েনও নি কখনও। 
কারন? 
সারা জীবন যখনই কোন বই হাতে নিয়েছেন বিরজাসুন্দরী,তাঁদের না-ফোটা সংসারের অযুত সুখ-অসুখের পারে কোন এক কাঙ্ক্ষিত মানুষের মুগ্ধ দৃষ্টি যেন সাদা পাতায় কালো কালো অক্ষরমালায় গেঁথে তাঁর কথাই মনে করিয়েছে।
মুখটি ভুলে গেছেন, তবু বইপ্রেমী এক তরুণের পত্নীগর্বে চমৎকারা স্বর আজও কানে বাজে… 
-’শুধু বাংলা নয়, ও ইংরেজি ফার্স্টবুকও পড়েছে।’
আপাত রিক্ত জীবনের পঙ্কে ফুটে ওঠা পঙ্কজিনীর মতো সেই আলো সেই স্নিগ্ধতা তাঁকে প্রেমাধিক জীবনোত্তরনে সাহায্য করেছে।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments