উদয়ের পথে
চতুর্থ পর্ব
মলয় সরকার
যদিও প্রথম কিমোনো পরার চল হয়েছিল ৭৯৪-১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে, তবু বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে শেষে মেইজির সময়ে (১৮৬৮-১৯১২) তেই এর বর্তমান রূপ লাভ করে।
রাস্তার শেষে আমরা এসে পৌছালাম মন্দির চত্বরে। এখানে রয়েছে এক বিশাল পাত্র যার মধ্যে জ্বলছে অসংখ্য মোটা মোটা ধুপ। তার ধোঁয়ার মধ্যে হাত মুখ যেন ধুয়ে নিজেদের পবিত্র করে নিচ্ছেন বেশ অনেক মানুষ।তাঁরা নিজেদের মঙ্গল কামনাও হয়ত করছেন ওই ধোঁয়ার কাছে।এই বিশাল বিশাল ধূপ জ্বালানোর ব্যাপারটা চীন ,জাপান ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ইত্যাদি বহু জায়গাতেই দেখেছি, বুদ্ধ মন্দিরে।
আর একটি জায়গায় দেখলাম, বহু মানুষ পয়সা দিয়ে তার বিনিময়ে কিছু একটা ঝাঁকাচ্ছেন এবং তার পর কিছু কাগজ পাচ্ছেন, যাতে হয়ত তাঁদের ভাগ্যফল লেখা আছে।এই ব্যাপারটা অনেক জায়গাতেই দেখেছি। তখন আমার মনে হল জাপানীরা অনেকেই বোধ হয় খুব ভাগ্যবাদী।ওঁদের মধ্যে, আমাদের মতই ধর্ম এবং ভাগ্যের উপর আস্থাটা ভালই আছে বলে মনে হল।
এখানে মূল যে মন্দিরটি ,তার আগের গেটটির নাম হোজোমন (Hozomon)। এটি দ্বিতল। ছাদগুলি সব ঐ নৌকার মত, সব শেষ প্রান্তের কানাগুলি বাঁকানো।প্রথম এটি তৈরী হয় ৯৪২ খ্রীঃ তে। তারপর শেষ বারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর ১৯৬৪ খ্রীঃতে শক্তপোক্তভাবে অগ্নিনিরোধক পদার্থ দিয়ে তৈরী করা হয়।এর দ্বিতীয়তলে অনেক মূল্যবান পুঁথিপত্র রাখা আছে।এই মন্দিরটিতে প্রধানতঃ লাল ও সোনালী রঙের ঔজ্বল্যের আধিক্য বেশী।
এখানে মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে উঠেই সামনে দেখা যায় একটি বিশাল লাল রঙের লন্ঠন।এই লন্ঠন ঝোলানো প্রধানতঃ বৌদ্ধ ও শিণ্টো মন্দিরগুলির একটি বিশেষত্ব। এটিকে একটি মঙ্গলজনক চিহ্ন হিসাবে ভাবা হয়। অনেকে বাড়িতেও ছোট ছোট লণ্ঠন ঝোলানো হয়।
আমরা এখানে দু- একটি ছোটখাট জিনিস কিনলাম। নানা ধরণের খাবার জিনিসও এখানে প্রচুর বিক্রী হচ্ছে দুপাশে রাস্তার দোকান গুলিতে।
মন্দির চত্বরেই রয়েছে একটি পাঁচ তলা টাওয়ার, যেটি অনেক বৌদ্ধ মন্দিরেই দেখা যায়।চত্বরটিও অনেক বড়।অনেক ফাঁকা ফাঁকা।বেশ বড় মন্দির, সিঁড়িও অনেক বড়, একসঙ্গে বহু মানুষ উপরে উঠতে পারেন। ভিতরে বুদ্ধের চারপাশ একটু কম আলোকিত। ছাদের সিলিংএও সুন্দর ভাবে রঙীন নানা চিত্রে চিত্রিত।
এখানে এসে মনটা ভরে গেল সকালের এই সুন্দর আবহাওয়ায়। এখান থেকে আমাদের যাওয়া হল কিছু দূরেই ,স্কাই ট্রীতে। দূরে গাছের ফাঁক আর বাড়ির মাথার উপরে দেখতেই পাচ্ছিলাম সেই জাপানের সর্বোচ্চ টাওয়ার স্কাইট্রি। এই স্কাই ট্রী আসলে সোলামাচি অঞ্চলের বা সোলামাচি বাজারের মধ্যে একটি সুউচ্চ টাওয়ার। এখানে যে ছাদঢাকা সুন্দর বাজারটি রয়েছে,সেটিও যথেষ্ট মনোগ্রাহী। নানা ধরণের দোকান রয়েছে। অনেক কিছু খাবার দোকান , ও বিভিন্ন জিনিসপত্রের এক বিশাল সম্ভার।নানা রকমের মাছও রয়েছে, কাঁচা কিংবা রান্না করা বিভিন্ন পদ সমেত।এখানে স্কাই ট্রীতে উঠতে গেলে আলাদা টিকিট করতে হয়।আমাদের আর আলাদা করে এই টাওয়ারে চড়ার ইচ্ছা হল না। এরকম টাওয়ার আমরা অনেক দেখেছি, সে সিয়াটেল টাওয়ারই হোক বা আইফেল টাওয়ারই হোক।তার বদলে আমরা ঘুরতে লাগলাম এখানের বাজারের দোকান গুলিতে। অনেক লিফট ও এস্ক্যালেটর সমৃদ্ধ এই বাজারে ঘোরাটাও একটা অভিজ্ঞতা। এখানে আছে প্রায় ৩০০ দোকান। ২০১০ সালে এটি জাপানের সর্বোচ্চ টাওয়ার রূপে গণ্য হয়।শুধু জাপানের নয় , এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ারও বটে, উচ্চতা ৬৩৪ মিটার।এখানে রয়েছে জাপানের ব্রডকাস্টিং স্টেশন।একোয়ারিয়াম , সুন্দর অডিটোরিয়াম সমেত এই বাজার বা মলটিতে গেলে মন হারিয়ে যাবেই এটা স্বচ্ছন্দে বলা যায়। এখানে আবার একটি ভারতীয় চায়ের দোকানও দেখলাম। খাওয়াও হল অল্প স্বল্প।
যদিও এই স্কাই ট্রীর রঙ চকচকে সাদাটে, রাত্রে কিন্তু এটি সুন্দর আলোকে সজ্জিত হয়ে ওঠে। এর আলো রোজই একরকম থাকে না,একদিন হয় নীলাভ আবার পরদিন হয় বেগুনী ধরণের। এই ভাবেই পরিবর্তিত হতে থাকে এর রঙ।
জায়গাটির আসল নাম সুমিদা হওয়াতে একে অনেকে সুমিদা টাওয়ারও বলে থাকেন।
🍂
চারপাশ দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি আর আমরা দেখছি বেশ অন্তত দুই তিনতলা উঁচু থেকে । কারণ এই টাওয়ার বা বাজারটি মাটির থেকে বেশ উঁচুতেই তৈরী এবং এটি ভূমিকম্প রোধক ব্যবস্থাসমেত তৈরী হয়েছে।
তবে একটা কথা বলি, জাপানের বাড়িঘর দেখে কিন্তু আমার খুব ভাল লাগে নি।তার কারণ এগুলি সব একেবারে বাক্সের মত, বিশেষ কোন গঠনবৈচিত্র্য নেই। বাড়ি দেখে বোঝা যাবে না, এটি আমেরিকার শহর না জাপানের।আমি জানি না , জাপান তো শিল্পীদের দেশ, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এদের শিল্প ভাবনার প্রতি। তবে কেন এমন! না কি, বর্তমান এগিয়ে চলা যান্ত্রিক সভ্যতার কোন শিল্পের দিকে তাকানোর সময় নেই! তা জানি না।আমরা যদি ভুটান হোক কি মরক্কো যেখানেই যাই , এ্কটা বিশেষত্ব চোখে পড়ে ঘর বাড়ির। এখানে কিন্তু তা মোটেই দেখছি না।আসলে এখন পাশ্চাত্য আধুনিকতার ছোঁয়া বোধ হয় সর্বত্রই।
আকাশে অল্প মেঘ। হাল্কা ঠাণ্ডা হাওয়া চলছে। তবে সব মিলিয়ে খারাপ লাগছে না। রাস্তায় কিন্তু প্রচুর মানুষের ভিড় এমনটা চোখে পড়ছে না।
বলে নিই , ভুলে যাব। এখানে প্রায় সময়েই তো বৃষ্টি হয়, যদিও আমাদের এখানের মত ঝড় বৃষ্টি সবসময় হয় না, কিন্তু ঝিরঝিরে বৃষ্টি , না বলে কয়েই দুষ্টু মেয়ের মত যখন তখন ঝাঁপিয়ে আসে। তাই এখানকার বাসিন্দারাও তৈরী থাকে। বেশিরভাগ মানুষের হাতে থাকে ছাতা। এই ছাতা গুলো প্রায় সময়েই লম্বা ছাতা । আমাদের দেশের মত বহুব্যবহৃত ফোল্ডিং ছাতা নয়। আর একটি কথা ছাতাগুলো প্রায়ই স্বচ্ছ কাপড়ের হয়, রঙ্গীন নয়। সমস্ত জায়গাতেই ঢোকার মুখেই আছে ছাতা রাখার বিশেষ জায়গা। সবাই সেখানে ছাতা রেখে দোকান কিংবা অন্যান্য জ্যাগায় ঢোকে। একটি শিশুদের স্কুল দেখলাম। সেখানে স্কুলে ঢোকার মুখেই বিশাল ছাতা রাখার জায়গা রয়েছে । সেখানে সুন্দর করে ছাতা রেখে, ঢুকেই জুতো রাখার জায়গা রয়েছে। সবাই জুতো খুলে ক্লাশে যাচ্ছে। আবার বের হওয়ার সময় যে যার ছাতা ও জুতো নিয়ে বাড়ি যায়।আমি জানি না, এতে ছাতা হারিয়ে যায় কি না বা ছাতা ওলটপালট হয়ে যায় কি না।সব ছাতাও তো একরকম দেখতে।
আর একটা জিনিস আমার খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সত্যিই ভাল জিনিসের তারিফ করতেই হয়। দোকান গুলোতেই হোক বা যেখানেই হোক, ওরা একহাতে কোন জিনিস কাউকে দেয় না। বিক্রীত জিনিসই হোক বা যাই হোক, ওরা দু হাতে ধরে, মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে ,হাসি মুখে ভদ্রতা ও সম্ভ্রম রেখে তা তুলে দেয় গ্রহীতার হাতে। বড় সুন্দর লাগল জিনিসটা। আমরা কেন এগুলো পারি না !আমি বুঝতে পারি, এগুলো ওদের আলাদা করে কোথাও ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করা হয় না বা শিক্ষা দেওয়া হয় না। এগুলো ওদের আশৈশব বা জন্মগত সংস্কার, যা আমাদের মত মানুষদের চোখে পড়বেই।
এখান থেকে আমরা চললাম উয়েনো পার্কের দিকে। এটি একটি বিশাল বড় পার্ক। তবে সাধারণ ভাবে পার্ক বললে যে ছবি আমাদের মনে ভেসে ওঠে তা কিন্তু এটি মোটেই নয়। এর ভিতর মন্দির, মিউজিয়াম চিড়িয়াখানা ইত্যাদি সব আছে। এ ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু চেরী গাছ ও অন্য গাছ, ঝকঝকে রাস্তা।
সোলামাচি বাজারে
১৮৭৩ সালে তৈরী এই পার্কটি আসলে প্রথমে ছিল ১৬২৫ সালে তৈরী বৌদ্ধ দেবতা কানেইজি (Kaneiji)র মন্দির।এই দেব মন্দিরটি ১৮৬৮ সালে এক যুদ্ধে নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এটি টোকিও শহরের সম্পত্তি রূপে গণ্য হয়।নানা উত্থান পতনের পর এটি একটি পার্ক রূপে আত্মপ্রকাশ করে ও সম্রাট হিরোহিতো একে জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।পার্কে ঢোকার মুখেই সেই যুদ্ধের এক যোদ্ধা সেনাপতির মূর্তি(Saigo Takamori) রয়েছে।পৃথিবীর প্রথম ন্যাশনাল পার্ক যদি আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক হয়, এটি তবে পৃথিবীর দ্বিতীয় ন্যাশনাল পার্ক।
এর ভিতরে রয়েছে প্রায় ৯০০০ (নয় হাজার ) নানা ধরণের গাছ। তার মধ্যে চেরী গাছই প্রধান।প্রায় একহাজার চেরী গাছ আছে এখানে। ফলে জাপানের প্রধান যে চেরী উৎসব, তা চলে এখানে প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে।কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য , ঠিক সময়ে গিয়েও এই চেরী বিশেষ দেখতে পাই নি। সমস্তই প্রায় বৃষ্টি ও অন্যান্য কারণে ঝরে গিয়েছে। এই ফুল যখন ঝরে, সেও এক দেখার মত জিনিস। চারিদিক উড়তে থাকে এর ছোট ছোট সাদাটে পাপড়ি। গাছ থেকে সেগুলি যখন মাটিতে পড়ে, মাটি বিছিয়ে এক ফুলের আস্তরণ তৈরী হয়।সে বড় সুন্দর দৃশ্য। হ্যাঁ একেবারে দেখিনি তা নয়, অনেক গাছেই ফুল ছিল, তবে তা অবশ্যই যে চেরী উৎসবের মত সাজানো, তা নয়। যেন ভাঙ্গা হাটের মেলা।
সঙ্গে থাকুন পরের পর্বের জন্য-
ক্রমশঃ-
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments