জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নারায়ণ চৌধুরী /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নারায়ণ চৌধুরী 
  
নির্মল বর্মন

প্রাবন্ধিক নারায়ণ চৌধুরী  সঙ্গীত শিল্পী ও সাহিত্যিক। সাহিত্যিক অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লায়  জন্ম নিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক চৌধুরী'র সঙ্গীত শিক্ষা মূলত কুমিল্লা ও কলকাতা। নারায়ণ চৌধুরী স্কুল শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন, পরে রেডিও, সিনেমা ও  ছাপাখানা ইত্যাদি নানা প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে সুনাম অর্জন করেছিলেনন। ভারতের প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় চৌধুরী সাহেবের লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছে। নারায়ণ চৌধুরী পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রন্থ  রচনা করে বাংলার সারস্বত সমাজে পাকা স্থান দখল করেছিলেন। প্রাবন্ধিক নারায়ণ চৌধুরী আজীবন সাহিত্যকৃতির জন্য  "শিশির পুরস্কার " (১৯৭৭), "নজরুল পুরস্কার" (১৯৮০), "বিদ্যাসাগর পুরস্কার" (১৯৮২) এ ভূষিত হয়েছিলেন। নারায়ণ চৌধুরী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
🍂

           সাহিত্যিক নারায়ণ চৌধুরী'র প্রকাশিত পুস্তকাদি :- ''সঙ্গীত পরিক্রমা'', ''বাংলার সাহিত্য'', ''বাংলার সংস্কৃতি'', ''অম্লমধুর'', ''আত্মদর্শন'', ''আধুনিক সাহিত্যের মূল্যায়ন'', ''সাহিত্য ও সমাজ মানস'', ''সাহিত্যের গতি ও মিলনসাধনা'', ''লিও টলস্টয়: জীবন ও সাহিত্য'', ''উত্তর- শরৎ বাংলা উপন্যাস'', ''নজরুলের গান'', ''বাঙালীর গীতচর্চা'', ''সঙ্গীত বিচিত্রা'' ইত্যাদি।
   নারায়ণ চৌধুরী'র  " সঙ্গীত বিচিত্রা'' (১৯৮৬) বইটিতে ''ভারতীয় সংগীতের মূল আদর্শ'' শীর্ষক প্রবন্ধে 'সঙ্গীতপ্রীতি ও ভারতীয় সংগীতের নানান দিক' স্থান লাভ করেছে । বস্তুতঃ প্রবন্ধের 'সুলিখিত, ক্রম-পরম্পরায় বিন্যস্ত ও সংগীত রসিক' এর কাছে তা আকর্ষণীয়ও  শীর্ষস্থানীয়:-
১.''সুরই হল ভারতীয় সংগীতের মূল ভিত্তি বা আদর্শ''। এর মূল সুর ''উপকরণরিক্ত, আভরণবর্জিত, শান্তরসাস্পদ, বিশুদ্ধ''।
২. ''ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরসংগতি বা স্বরের ঐক্যের আদর্শ তার চূড়ান্ত উৎকর্ষের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।'' 
   বছরের পর বছর সুরকে কতখানি শুদ্ধ বা পবিত্র রূপে প্রকাশ ঘটানো যায়,তার বহুবিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা তৃতীয় বিশ্বের দেশে আলোচনা হয়েছে ।

৩.''ত্রিস্বর বিশিষ্ট বৈদিক সংগীত ধীরে ধীরে স্বরসংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে সপ্তস্বরে গিয়ে দাঁড়াল' এবং 'সপ্তস্বরে পরিণত হবার কালে ভারতীয় সংগীত দুটি সুস্পষ্ট ভাগে ভাগ হয়ে যায়-মার্গ সংগীত ও দেশি সংগীত''।

৪.''ভারতীয় মার্গসংগীতের কতকগুলি সুস্পষ্ট ধাপ বিদ্যমান-নিবদ্ধ গান, প্রবন্ধ সংগীত, আক্ষিপ্তিকা, ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠুংরী'' ইত্যাদি।
৫.. "খেয়াল ধ্রুপদ থেকে সৃষ্টি। ধ্রুপদের কাঠামোর মধ্যে নিবদ্ধ ও প্রবন্ধ গানের একাধিক অঙ্গ গ্রথিত হয়েছিল। অন্যদিকে খেয়াল জনসমাজে গৃহীত হবার আগে পর্যন্ত তা কাওয়ালি, গজল প্রভৃতির মধ্যে বর্তমান ছিল"।
৬. পাশ্চাত্য সংগীত ও ভারতীয় সংগীতের তুলনা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক নারায়ণ চৌধুরীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
      "ভারতীয় সংগীতের শান্ত-স্থির ধ্যানগম্ভীর রূপের পাশে পাশ্চাত্য সংগীতের সুরাদর্শকে স্থাপন দেখলে দুইয়ের পার্থক্য প্রকট হয়ে চোখে লাগবে, কানে বাজবে। পাশ্চাত্য সংগীতে ভারতীয় সংঘাতের সুর প্রশান্তি নেই, আছে সম ও বিরুদ্ধ স্বরের আঘাতে-সংঘাতে সৃষ্ট সুরের প্রাণচাঞ্চল্য সচল রূপ।" 
 প্রাবন্ধিক নারায়ণ চৌধুরী এই ভিন্ন দুই দেশের বস্তুগত অবস্থার মৌলিক ভিন্নতার কথা উল্লেখ করে সাহিত্যিক বোধ  প্রস্ফুটিত। সঙ্গে সংগীতের আলোচনা করার জন্য বিষয়টি নান্দনিক বোধে সমুজ্জ্বল । তথাপি ভারতীয় সংগীতের মূল সুর  যথেষ্ট স্বচ্ছভাবে উপস্থাপিত হলেও কালের অমোঘ নিয়মে প্রাবন্ধিক আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।


Post a Comment

0 Comments