জ্বলদর্চি

কচুরিপানা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব - ১২
কচুরিপানা

ভাস্করব্রত পতি

ধ্বংস করো এই কচুরিপানা!
(এরা) লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা॥ (ধুয়া)      
ইহাদের সবংশে করো করো নাশ,      
এদের দগ্ধ করে করো ছাই পাঁশ,
(এরা) জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস,
(এরা) দৈত্যের দাঁত, রাক্ষসের ডানা –         
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) ম্যালেরিয়া আনে, 
আনে অভাব নরক,
(এরা) অমঙ্গলের দূত, ভীষণ মড়ক!
(এরা) একে একে গ্রাস করে নদী ও নালা।
(যত) বিল ঝিল মাঠ ঘাট ডোবা ও খানা।         
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(এরা) বাংলার অভিশাপ, বিষ, এরা পাপ,
(এসো) সমূলে কচুরিপানা করে ফেলি সাফ!
(এরা) শ্যামল বাংলা দেশ করিল শ্মশান,
(এরা) শয়তানি দূত দুর্ভিক্ষ আনা।         
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া)
(কাল) সাপের ফণা এর পাতায় পাতায়,
(এরা) রক্তবীজের ঝাড়, মরিতে না চায়,
(ভাই) এরা না মরিলে মোরা মরিব সবাই
(এরে) নির্মূল করে ফেলো, শুনো না মানা।         
ধ্বংস করো এই কচুরিপানা॥ (ধুয়া) ---

১৯৩৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর বেতারে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা উপরের 'কচুরিপানা' গানটি সম্প্রচারিত হয়েছিল। যা তাঁর 'শেষ সওগাত' কাব্যগ্রন্থতে ঠাঁই পেয়েছিল। এই গানটির মাধ্যমে কচুরিপানাকে চিহ্নিত করা হয়েছে দুর্দশা আনয়নকারী উদ্ভিদ হিসেবে। এর ধ্বংসাত্মক চরিত্রের জন্য এর নাম দেওয়া হয়েছে 'বিউটিফুল ব্লু ডেভিল'। এছাড়াও 'জার্মান পানা'ও বলা হয়ে থাকে। আর বাংলার বুকে পরিচিত 'Terror Of Bengal' নামে। 

পানা জাতীয় গাছকে সংস্কৃতে বলে কুম্ভিকা, বারিপর্ণী। হিন্দিতে কাই, জলকুম্ভী, গুজরাটিতে জলকুম্ভী, কন্নড়ে হীম্বলং, মারাঠিতে জলমণ্ডবী, ওড়িয়াতে দল এবং তেলুগুতে তুটিকুর বলে। সাধারণত তিন ধরনের পানা দেখা যায়। টোকাপানা, ইন্দুরকান্দিপানা এবং ক্ষুদেপানা। কচুরিপানা হল টোকাপানা জাতীয়। প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এটি বিদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা উদ্ভিদ। আর এখন বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। এর ইংরেজি নাম Water Hyacinths। এটি Pontederiaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কচুরিপানার বিজ্ঞানসম্মত নাম Pontederia crassipes। এছাড়াও কচুরিপানার আরও যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল --
Pontederia crassicaulis Schltdl.
Pontederia elongata Balf.
Piaropus mesomelas Raf.
Eichhornia crassicaulis Schltdl.
Heteranthera formosa Miq.
Eichhornia cordifolia Gand.
Piaropus crassipes (Mart.) Raf.
Eichhornia speciosa Kunth
Eichhornia crassipes (Mart.) Solms
জলাশয় জুড়ে কচুরিপানার ফুল

বাংলায় পদার্পণ করার আগে এই কচুরিপানার আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ আমেরিকা। জানা যায়, জনৈক স্কটিশ পাট ব্যবসায়ী জর্জ মরগ্যান বাংলায় এনেছিলেন ব্রাজিলের আমাজনের এই উদ্ভিদটিকে। ঘটনাটি ১৮৯৪ নাগাদ ঘটেছিল। আবার কারোর কারোর অভিমত যে, অস্ট্রেলিয়া থেকে নাকি এই কচুরিপানার বাংলায় আগমন ঘটেছিল। এরপর ১৯০০ সালে বাংলা জুড়ে রাজত্ব করতে শুরু করে এই কচুরিপানা। ভারতে এসেই বাংলার পুকুর ডোবা নদীনালায় ভরপুর উপস্থিতি। খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে এই গাছ। জলের ওপর ভেসে থাকে গুচ্ছাকারে। একটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত থাকে নরম কাণ্ড দ্বারা। এর বেগুনি রঙের ফুলগুলি অসাধারণ। একটা নয়নাভিরাম দৃশ্য তৈরি করে জলাশয়ে। একটি পুষ্পবৃন্ত থেকে ৮ - ১৫ টি আকর্ষণীয় ৬ পাঁপড়ি বিশিষ্ট ফুলের থোকা তৈরি হয়। এদের পুষ্পবিন্যাসকে বলা হয় Tristylous। এদের পাতাগুলি বেশ মোটা, চকচকে এবং ডিমের মতো। উল্লেখ্য, দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের প্রাদেশিক ফুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এই কচুরিপানাকে। 

জানা গিয়েছে, ১৯১৪ নাগাদ বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের চেম্বার অফ কমার্স কচুরিপানার বিরুদ্ধে সুর চড়ায়। তারা ইংরেজদের কাছে নালিশ করে এই সাধারণ উদ্ভিদটির বিরুদ্ধে। আসলে তখন যত্রতত্র কচুরিপানা বিস্তার লাভ করে জলাশয়ে। ফলে খালে বিলে জলযান যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। নৌ চলাচলে বাধাবাধার ফলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধান, চাল, পাট সংগ্রহে লক্ষ্যপূরণ হচ্ছিলনা। তাঁদের দাবি ছিল, অবিলম্বে জলাশয় থেকে কচুরিপানার ঝাড় না মুক্ত করলে রাজস্ব আদায়ে টান পড়বে। সেইসাথে ভাটি এলাকার ধানচাষেও কচুরিপানার জন্য ব্যাপক সমস্যার উদ্রেক তৈরি হয়েছিল। প্রায় ১৫-২০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন, কচুরিপানার কারনে যে মহা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার জেরে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল। সেইসাথে বর্ষার জলে যখন ঘাস মিলতোনা, তখন কেবল কচুরিপানা খেতে বাধ্য হত গবাদিপশুরা। যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন। ফলে চাষাবাদের কাজে মিলতোনা গবাদিপশু। এক অনভিপ্রেত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল সেসময়। তাছাড়া জলাশয়ের উপরিস্তরে কচুরিপানা ঠাসা অবস্থায় থাকায় জলের ভিতরে অক্সিজেনের অভাব তৈরি হয়েছিল। ফলে প্রচুর মাছের মৃত্যুও ঘটতো। ফলে যাবতীয় সমস্যার মূল আসামি হিসেবে কচুরিপানাকেই চিহ্নিত করা হয়। সেসময় ইনফ্লুয়েঞ্জা, কলেরার মতো বিভিন্ন জলবাহিত রোগ এবং ম্যালেরিয়ার প্রকোপের পেছনে কচুরিপানাই দায়ী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এমনকি এটি ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহনকারী অ্যানোফিলিস মশার জন্য অনুকূল আবাস তৈরি করতেও সক্ষম বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। শুধু বাংলায় নয়, কচুরিপানাকে কেন্দ্র করে উদ্ভুত সমস্যা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতিটি দেশের সরকার ব্যস্ত কচুরিপানা নিধন কর্মসূচি সফল করতে। 

১৯১৬ সালে পূর্ব বাংলার কৃষি বিভাগের উপ পরিচালক তথা ওয়াটার হায়াসিন্থ কমিটির সেক্রেটারি কেনেথ ম্যাকলিন ঢাকা এগ্রিকালচারাল ফার্মে, কচুরিপানার রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা করে জানিয়েছিলেন কচুরিপানার মধ্যেকার উচ্চমাত্রার এবং উচ্চ মানের জৈব সারের মূল উপাদান পটাশ, নাইট্রোজেন এবং ফসফরিক অ্যাসিডের উপস্থিতির কথা। তিনি সরকারকে তা জানিয়ে পরামর্শ দেন এই কচুরিপানাকে গবাদিপশুর খাদ্য কিংবা উচ্চমানের জৈব সার তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। রাসায়নিক সারের অন্যতম বিকল্প হবে এই জৈব সার। 

কচুরিপানার তাণ্ডবে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল ১৯২০ নাগাদ। সমস্ত নদী নালা খালবিল ভরপুর হয়ে উঠেছিল বেগুনি রঙের ফুল সমৃদ্ধ কচুরিপানার অবাধ বিস্তারে। কচুরিপানার নির্মুলীকরণে ১৯২১ সালে বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকে সভাপতি করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। মোট সাত দফা বৈঠকের পর যে প্রতিবেদন পেশ করা হয় তাতে বলা হয় এরা মানুষের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছে। আপাতত এর ওপর গবেষণার ধারা লাগাতরভাবে চালিয়ে যেতে হবে। 
মহিষাদলে বিখ্যাত ওড়িশা কোষ্ট ক্যানেল ভরে গিয়েছে কচুরিপানায়

এরপর ১৯৩৬ সালে 'কচুরিপানা বিধি'ও জারি করে সরকার। এই বিধি মোতাবেক নিজ জমি বা দখলিকৃত এলাকায় কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ। সেইসাথে দেশের জনগনকে সরকার পরিচালিত কচুরিপানা হঠাও অভিযানে অংশগ্রহণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। তখন অবশ্য বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এ কাজে হাত লাগায়। আর ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতের মানুষ দেশপ্রেমের অঙ্গ হিসেবে কচুরিপানা পরিস্কার কর্মসূচিতে নিজেদের যুক্ত করেছিল। ১৯৪০ সালে কচুরিপানা নির্মূলীকরণের জন্য 'Bengal Water Hyacinth (Amendment) Act', নামে একটি আইন পাশ হয়েছিল। তখন নির্বাচনের প্রাক্কালে নেতাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে এই কচুরিপানা ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হত। ১৯৩৭ এর নির্বাচনে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। বাংলাদেশে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে জয়লাভ করার পর তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহার অনুযায়ী তা পূরণ করতে কচুরিপানা ধ্বংস করতে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৩৯ সালে পল্লী সংগঠক বিভাগের উদ্যোগে কচুরিপানা ধ্বংস সপ্তাহ পালন করা হয়েছিল। অভিনব বলে মনে হতেই পারে এখন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ইফতেখার ইকবাল এই কচুরিপানার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি তাঁর ‘ফাইটিং উইথ আ উইড: ওয়াটার হায়াসিন্থ অ্যান্ড দ্য স্টেট ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল’ গবেষণায় উল্লেখ করেছেন কচুরিপানার তাণ্ডবে কৃষি জগতে ভীষণ প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ইতিহাস ফুটে উঠেছে তাঁর বিস্তৃত গবেষণা পত্রে। যার ছত্রে ছত্রে বিধৃত কচুরিপানাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত যন্ত্রনাময় পরিস্থিতির কাহিনী। 

কচুরিপানার পাতা আর মূলের মাঝে ফাঁপা অংশটিতে চাপ দিলে সশব্দে ফেটে যায়। যা ছোটবেলায় ছেলে মেয়েদের খেলার উপকরণ ছিল। এটি অবশ্য জলাশয়ের দূষিত জল থেকে পারদ, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, সীসা, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট এবং বিভিন্ন ভারী ধাতু অবলীলায় শোষণ করতে পারে। এদের গুচ্ছাকারে থাকা মূলগুলি বেশ রোমশ হয়। সামান্য বাতাসে এরা জলাশয়ের একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করতে সক্ষম। সাধারণত পাখিদের দ্বারা এদের বংশ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। বেগুনি রঙের ফুল এদের রূপের ছটা বাড়িয়ে দেয়।

কচুরিপানা কিন্তু একেবারেই ফেলনা নয়। ইদানীং এর নরম ডাটা শুকনো করে নানা ধরনের ঝুড়ি, দড়ি, কাগজ, টব, আসবাবপত্র, হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদি গেরস্থালির সৌখিন সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। অনেক মানুষের গ্রাসাচ্ছাদনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ক্ষতিকর কচুরিপানা। বর্তমানে গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবে গ্রামাঞ্চলে 'জাউলি সেদ্ধ'তে কচুরিপানা কুচিয়ে দেওয়া হয়। যা খুব উপাদেয় এবং পুষ্টিকর বলে বিবেচিত।

🍂


Post a Comment

0 Comments