ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭১
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ
চিত্রগ্রাহক - সুদীপ পাত্র
সম্পাদকীয়,
রঙ খেলার দিন আজ। এমন খুশির দিনে বুকাই ঠাম্মির কাছে গল্প শুনবে না তা কি হয়? সুমনা আন্টি এসে গেছে ভোজের গল্প নিয়ে। লাচুঙের রহস্য ভেদ করতে এসো আমরা শ্রীকান্ত আঙ্কেলের উপন্যাস পড়ে ফেলি। তোমাদের বন্ধু আকাশ রেল গাড়ি চেপে ঘুরতে যাচ্ছে। আর আমরা তো ছোটোবেলার পাতা খুললেই বাসবদত্তা আন্টির সঙ্গে হুস করে আমেরিকা চলে যাই। কি তাই তো? এবার শ্রীপর্ণা আর প্রবাহনীল দুটি মেয়ের ছবি এঁকেছে। আর সেই মেয়েকে নিয়ে ছড়া লিখেছে গৌতম আঙ্কেল। নীতা পিসি শত ব্যস্ততার মধ্যেও পাঠ অনুভূতি লিখে পাঠিয়েছে। এবার তোমরা রঙ খেলা হলে স্নান সেরে ছোটোবেলা পড়ে ফেল।, লিখে ফেল আর পাঠিয়ে দাও। রাঙিয়ে দাও আমাদের ছোটোবেলা সুদীপ আঙ্কেলের তোলা প্রচ্ছদের ছবিটার মতো। -- মৌসুমী ঘোষ।
ভোজ কয় যাহারে
সুমনা সাহা
দাদু, বাবা, মা হয়ে এবার গল্পের লাটাই ঠাম্মির হাতে। বুকাই হাত ধুয়ে ঘর থেকে বালিশটা নিয়ে চলল ঠাম্মির ঘরে। মিঠু বলল, “মা তোমার আজ ঘুম হবে না।”
“নাই বা হলো। দুপুরে ঘুমোলে রাত্রে ঘুমই আসে না। চল বুকু, আমার কাছে শুয়ে গল্প শুনবি। তারপর কিন্তু একটু ঘুমাতে হবে। নাহলে সন্ধ্যাবেলা তবলার আর আঁকার মাস্টাররা সব আসবেন, তখন তোমার হাই উঠবে।”
বুকাইয়ের বাংলা গল্পের বইগুলো ঠাম্মির ঘরে রাখা আছে, টুনটুনির বই, পাগলা দাশু, ঠাকুমার ঝুলি। ঠাম্মি মাঝে মাঝে পড়ে শোনায়।
বিছানায় আরাম করে বালিশ ঠেস দিয়ে বসে ঠাম্মি বলল, “পশুপাখিদের খাওয়াদাওয়া কেমন জানিস? যেমন পরিবেশে থাকে, সেখানে সহজে যা পাওয়া যায়, ওরা তাই খায়। তবে সবারই তো বিশেষ পছন্দের খাবার থাকে। যার কাছে অন্য সব আলুনি। এই যেমন শেয়াল। চতুর প্রাণি বলে লোকে। বোকা বাঘ মামা আর চালাক ভাগ্নে শেয়ালের কত গল্প আছে, তোকে আগে বলেছি না? শেয়াল এমনি তো ছোটখাট প্রাণির মাংস খায়, এই যেমন খরগোশ, ইঁদুর, হাঁস, মুরগি। মরা পশুর মাংসও খায়। কিন্তু কাঁকড়া খেতে সবচেয়ে ভালবাসে। কাঁকড়ার গর্তে লেজ ঢুকিয়ে বসে থাকে। কাঁকড়াগুলো লেজটাকে চেপে ধরে। তখন শেয়াল করে কি? লেজটা গর্ত থেকে তুলে মাটিতে আছাড় মেরে মেরে কাঁকড়াগুলোকে লেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে কচরমচর করে।”
“আচ্ছা ঠাম্মি, তুমি সেই যে শিয়াল আর সারসের গল্প বলেছিলে—শেয়াল সারসকে নেমন্তন্ন করল, থালায় করে পায়েস খেতে দিল। সারস ওর লম্বা ঠোঁট দিয়ে থালার পায়েস খেতে পারল না, আর শেয়াল সব চেটেপুটে খেয়ে নিল। তারপর সারস শেয়ালকে নেমন্তন্ন করল ওর বাড়িতে আর কলসিতে করে পায়েস খেতে দিল। শেয়াল কলসির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে পায়েস খাবে ভাবল, কিন্তু ও কলসীর মধ্যে মাথা গলাতে পারল না। সারস কলসির ভিতরে ওর লম্বা ঠোঁট ডুবিয়ে পায়েস খেয়ে নিল। শেয়াল আর সারসেরা কি পায়েস খেতে ভালোবাসে?”
“ওটা তো নীতিকথার গল্প দাদুভাই! শেয়াল তো বনে জঙ্গলে থাকে আর সারস থাকে জলাভূমিতে। ওদেরকে পায়েস রান্না করে খাওয়াবে কে? তবে পেলে খাবে কিনা, সেটা বলতে পারবো না। শেয়াল কিন্তু পেলে সবই খায়। আসলে কি জানো, প্রাণীদের মধ্যেও আমিষ-নিরামিষ এই বাছবিচার আছে। কোন কোন প্রাণী শুধু ফল, ফুল, পাতা, বীজ এসবই খায়। বড় প্রাণীদের মধ্যে হাতি, ঘোড়া, গরু, ছাগল, হরিণ, জেব্রা, জিরাফ থেকে শুরু করে বাঁদর, কাঠবিড়ালি, প্রজাপতি, শামুক এরা হলো নিরামিষাশী। আর বাঘ, সিংহ, হায়না, শেয়াল, নেকড়ে এরা জঙ্গলে থাকে। হিংস্র প্রাণী। অন্য পশু শিকার করে তাদের মাংস খায়। আর আশপাশে সব সময় যাদের দেখতে পাও— কুকুর, বেড়াল, ইঁদুর, ব্যাঙ, টিকটিকি এরাও আমিষাশী প্রাণী। মানে এদের থেকে আকৃতিতে ছোট প্রাণীদের মেরে খায়। সমুদ্রে, নদীতে, পুকুরে, মাছ ও আরো সব জলের প্রাণীদের মধ্যেও কেউ লতাপাতা খায়, কেউবা মাছ, মাছের ডিম, শামুক, ঝিনুক এসব খায়। আবার কিছু প্রাণী আছে, তারা আমিষ, নিরামিষ সবই খায়, তখন যেটা পায়। কাক, কুকুর, শিয়াল এরা এই দলে পড়ে।”
“সেই যে তুমি গল্প বলেছিলে, বোকা কুমির আর শিয়াল পন্ডিতের? কুমীরটা ওর সাতটা বাচ্চাকে পড়াশোনা শেখানোর জন্য শিয়ালের কাছে পড়তে পাঠালো। শিয়াল রোজ একটা একটা করে বাচ্চা খেয়ে ফেলত আর বলতো, ‘কানা খানা গানা ঘানা/কেমন লাগে কুমির ছানা?’ আর কুমীর যখন দেখতে আসতো বাছারা কেমন পড়াশোনা শিখছে, তখন চালাকি করে এক একটা বাচ্চাকে দুবার তিনবার করে দেখিয়ে সাতবার দেখাতো আর কুমীর খুশি হয়ে চলে যেত। তারপর যখন সবগুলো কুমীরছানা খাওয়া হয়ে গেল, তখন শিয়ালটা ওখান থেকে পালালো। তার মানে ওরা কুমীরের বাচ্চাও খায়?”
“শিয়াল মহা দুষ্টু আর পাজী। হিতোপদেশের সব গল্পেই শিয়ালের এইসব চালাকির গল্প আছে।”
“তাহলে কুমীর কি খায় ঠামি?”
“কুমীর কি খায়? নদীর কুমীর তো নদীর মাছ খায়। আমরা ছোটবেলায় গল্প শুনেছি, নদীতে চান করতে নামলে কুমীর নাকি চুপি চুপি এসে পা টেনে ধরে, তারপর আস্ত গিলে খায়।”
“সত্যি?”
🍂
“হ্যাঁ রে! মার কাছে গল্প শুনেছি। মা আবার তার দিদিমার কাছে শুনেছিল। দিদিমার এক বান্ধবী নাকি বিয়ের পর ওর বরকে নিয়ে জামাইষষ্ঠীতে বাপের বাড়ি এসেছিল। দুপুরে খাওয়ার আগে জামাই গেল নদীতে স্নান করতে আর তাকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেল! আমার মায়ের দিদিমা তো বাংলাদেশের মেয়ে। বাংলাদেশে অনেক নদী-নালা-খাল-বিল। ধান খেতে জল আনার জন্য নদী থেকে খাল কেটে আনা হত। নদী থেকে কুমীর খালে চলে আসতো আর খাল পাড়ে বালির উপর মরার মত পড়ে থাকতো। ওখানে ঘাস খেতে যেসব গরু ছাগল আসতো, তাদের মধ্যে থেকে প্রায়ই একটা না একটা কুমিরের পেটে যেত। শিকার ধরে কুমিরটা পালিয়ে যেত নদীতে। তা, দিদিমার সেই বান্ধবীর বরকে নাকি কুমিরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই মেয়েটার বাবা ছিল খুব শক্তিশালী। বিশাল চেহারা ছিল। মুগুর ভাজতো। খবর পেয়ে একলাফে চলে গেল খালের ধারে। লাফিয়ে পড়ল জলে, ‘আমার জামাইকে নিয়ে যাওয়া? আজ দেখে নেব তুই কত বড় কুমির?’ ওপারে গিয়ে দ্যাখে, কুমিরটা বালির উপর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। পেটটা ফুলে আছে। দিদিমার বান্ধবীর বাবা, পাড়ায় তাকে লোকে সেজকর্তা বলতো, সে এক লাফে গিয়ে কুমিরটার পিঠের উপর দাঁড়ালো। তারপর নাকি কুমিরের নিচের চোয়ালে এক পা রেখে দুই হাতে উপরের চোয়াল ধরে কুমিরটাকে চিরে ফেলল। পেটের মধ্যে থেকে টেনে বের করল জামাইয়ের আস্ত দেহ। সেটা তখন চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।”
“বেঁচে ছিল লোকটা?”
“আর বাঁচে? মরে গেছে। কুমির তো চিবিয়ে খায় না। আস্ত গিলে ফেলে।”
এটা কি সত্যি? না গল্প, ঠামি?”
“কি জানি! সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। মায়ের দিদিমা বলতো, সেজকর্তা নাকি খালি হাতে বাঘও মেরেছিল! তখনকার দিনে গ্রামের চারপাশে জঙ্গল ছিল। জঙ্গল থেকে প্রায়ই বাঘ বেরিয়ে গ্রামের ভেতর চলে আসতো। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি এসে হাঁস-মুরগি বাছুর গলা কামড়ে জঙ্গলে নিয়ে চলে যেত। সেই সেজকর্তা একবার পটি করতে জঙ্গলে গিয়েছে। অনেকদিন আগে ঘরের ভিতর পায়খানা থাকতো না, বাইরে জঙ্গলে ঝোপে-ঝাড়ে গিয়ে লোকে পটি করে আসতো। সেজ কর্তার তখন জ্বর। একটা কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘরের পিছন দিকে জঙ্গলে পটি করতে গেছে। হঠাৎ চোখ তুলে দেখে, সামনে একটা কেঁদো বাঘ জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে! সেজকর্তা গায়ের কাঁথাটা ছুঁড়ে মারল বাঘের মুখে। বাঘটা কিছু বুঝতে ওঠার আগেই সেজকর্তা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বাঘটাকে জাপটে বগলে চেপে ধরল। বাঘ যতই ছটফট করে, সেজকর্তা ততই জোরে চেপে ধরে। চাপের চোটেই নাকি বাঘ বাছাধন প্রাণ হারিয়েছিল। এসব সত্যি, নাকি বাড়িয়ে বলা, বলতে পারব না। তবে আগেকার দিনের লোকের গায়ে সত্যিই খুব জোর ছিল।”
“তাহলে ঠাম্মি, কুমির যদি সব আস্ত গিলে খায়, ও তো শিয়ালকেও খেতে পারে?”
“তা তো পারেই! শেয়ালের বাচ্চা পেলে কুমির খেয়ে ফেলবে। তবে কি জানিস বুকু? দুনিয়ায় সবকিছুরই ব্যতিক্রম থাকে। কেরালায় পদ্মনাভ স্বামীর মন্দিরের পুকুরে নাকি একটা কুমির থাকতো। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তাকে আদর করে বাবিয়া বলে ডাকতো আর ঠাকুরের প্রসাদী ভাত মেখে থালার করে খাওয়াতো। পুকুরে অনেক মাছ থাকা সত্ত্বেও বাবিয়া নাকি এতই সাত্ত্বিক প্রকৃতির ছিল যে, কখনো মাছ খেত না, শুধু ভাতই খেত!”
“তুমি কি করে জানলে ঠামি?”
“আমি কেমন করে আর জানবো? খবরকাগজে পড়েছি। ছোটবেলায় আমরা বাবা-মার কাছ থেকে শিখি, আমাদের যারা পড়ায় সেই সব মাস্টারমশাই দিদিমণিদের কাছ থেকে শিখি। বড় হয়ে আমরা বই পড়ে অনেক কিছু জানতে পারি। তারপর আশেপাশের ঘটনা দেখেশুনেও আমরা কিছু শিখি। তুই যেমন শিখছিস বাবার কাছে, মা-র কাছে, আমার কাছে গল্প শুনে শুনে, স্কুলে গিয়ে টিচারদের কাছে শুনছিস। বইয়ে পড়ছিস। তারপর পাড়ায় কুকুর, বিড়াল, পাখি, কতরকমের প্রাণীদের দেখছিস। ঘরে দেখছিস টিকটিকি, মাকড়সা, মশা, মাছি। সেসব লক্ষ্য করেও তো কত কী শিখছিস। তবে রোজ রোজ অনেক কিছু দেখেও আমরা শিখি না, বা শেখার ইচ্ছে জাগে না। মানুষ কখন জানতে চায়, জানিস? যখন তার প্রয়োজন হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ‘প্রয়োজন’ মানে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ। বাঁচা কিভাবে হয়? নিজের দেহটাকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষাও করতে হবে, আবার দেহের পালনপোষণও করতে হবে, তাই না? আদিম মানুষ শীতে কষ্ট পাচ্ছিল। ওরা দেখল যে, ভেড়ার গায়ে অনেক লোম, ওরা কনকনে শীতেও দিব্যি আছে। ওদের গা থেকে লোম নিয়ে পোশাক তৈরি করি, তাহলে আমাদেরও শীতে কষ্ট হবে না। তখন ভেড়া পুষতে আরম্ভ করল। কারণ ভেড়ার লোম আমাদের কাজে আসবে। তখন আমাদের জানতে হবে ভেড়া কি খায়, কিসে ও ভাল থাকবে। আবার যেসব প্রাণিরা আমাদের ক্ষতি করে, তাদের সম্বন্ধেও জানতে হবে। ওরা কোথায় থাকে, কি খায়, কিসে ভয় পায়, যাতে করে আমরা ওদের আক্রমণ ঠেকাতে পারি। টিকটিকি তোর খুব একটা ক্ষতি করছে না, উপকারও করছে না। তাই তুই ওর সম্বন্ধে জানতে চাইছিস না। কিন্তু জগতে যত প্রাণি আছে, সবাই কোন না কোনওভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশে একটা প্রাণির সংখ্যা খুব বেড়ে গেলে বা খুব কমে গেলে, সমস্ত ইকোসিস্টেমের উপর তার প্রভাব পড়বে।”
“ইকোসিস্টেম কি?”
“তোদের বুঝি এখনও ইকোসিস্টেম পড়ায়নি? ইকোসিস্টেমকে বাংলায় বলা হয় বাস্তুতন্ত্র। ওটা আরেকদিন বলব। তুই হাতি ঘোড়া পুষবি বলছিলি না? তাদের খাওয়ার কথা তো বলাই হলো না! এখন একটু বিশ্রাম করে নে। কালকে আবার বলব’খন।”
(চলবে)
ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে (পর্ব-চল্লিশ )
শ্রীকান্ত অধিকারী
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কী করে দীপকবাবু অনুভব করেন, তার খুব কাছে একেবারে ঘাড়্বের কাছে কেউ একজন এসে পড়েছে। দীপকবাবু কাঠ হয়ে ঘাড় সোজা করে যেমন ছিল তেমনই থাকেন। তবু বুকটা যে কেঁপে উঠল না তা নয়। একবার শুধু একবার, বাড়ির কথা মনে পড়ল। ফিরে কি যেতে পারবে?
সেরগিল সাহেব প্লানটা খোলশা করে না বললেও মালবাহী লেপচা লেবারদের কথাবার্তায় আকার-ইঙ্গিতে যেটুকু বোধগম্য হয়েছে তাতে খুব যে ভালো কিছু ঘটবে না তা হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত। আর বার বার সেরগিল সাহেব অটোমেটিক যন্ত্রের কথা স্মরণ করাতেই সন্দেহ পাকা হয়ে গেছিল। কিছু একটা ঘটবেই। কিন্ত এত তাড়াতাড়ি যে ঘটবে বুঝতে পারেন নি। হঠাৎ একটা মেয়েলি কণ্ঠ ফিসফিস করে কাটা কাটা বাংলায় বলেন,- নেকড়ের দাঁত দেখেছেন। দীপকবাবু?
এমনিতেই হতভম্ব হয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, রাইফেলটা চেপে ধরে সামনের দিকে তাক করে রেখেছিলেন, তার ওপর এমন ভয়ঙ্কর কথাতে প্রায় আঁতকে উঠেছিলেন দীপকবাবু। তবু সাহসে ভর করে ডান পাশে তাকাতেই অন্ধকারের মধ্যেও শবনম ম্যাডামকে চিনতে অসুবিধে হল না।
দীপকবাবু ভাবেন জীবনে কোনদিন খোলা অবস্থায় নেকড়ে দেখিনি তো নেকড়ের দাঁত! দীপকবাবু ফ্যাসফেসে গলায় বলেন,-আপনি?
শবনম ম্যাডাম এর উত্তর না দিয়ে আস্তে আস্তে বলেন,-ওয়েট করুন দেখতে পাবেন। কপাল ভাল আছে। এই ওয়েদারে পচা মাংসের লোভে ওরা আসবেই। তারপর নিজের মনেই বলেন,-যদি থাকে!
-কিন্তু যতদূর শুনেছি নেকড়েরা পচা মাংস খায় না। জ্যান্ত ধরে শিকার করে।
-ওরা সব খায়। জ্যান্ত শিকারের মাংস রেখে দেয় পাহাড়ের গর্তে কিংবা গুহার মত ছোট ছোট লম্বা গর্তে যেখানে ওরা থাকে। খাবারের জন্য পাহাড়ের মধ্যে এরা অ্যাট এ টাইম টানা ফর্টি এইট কিলোমিটার পার আওয়ার ট্রাভেল করে। আই মীন ছুটতে পারে। আমেরিকান কান্ট্রিগুলোতে যেখানে ক্যারিয়ান পড়ে থাকে তাকে পিকআপ করার জন্য নেকড়েদের টানা হয়।
দীপকবাবু চুপ করে শবনম ম্যাডামের কথা শোনেন।
শবনম ম্যাডাম আবার বলেন,-ক্যারিয়ান বুঝলেন না তো। ক্যারিয়ান মতলব লাশ। ক্যারিয়ান-ইটার হল কাক শকুন বাজপাখি তাসমানিয়ান ডেভিল …।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন শবনম ছেত্রী ম্যাডাম। কিন্তু তার আগেই দীপকবাবু সামনের দিকে তাকিয়েই বলেন,- মানে স্ক্যাভেঞ্জার!
-ইয়েস! উইন্টার সিজিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইয়োলস্টোন ন্যাশানাল পার্কের কাছে লামার উপত্যকায় এইভাবে উলফদের নিয়ে আসা হয়। মাংসের গন্ধ ওরা তিন চার কিলোমিটার দূর থেকেই পায়।
-আর এই ঘন অন্ধকারে এত দূর থেকে দেখতে পায়?
দীপকবাবু নিজের এই প্রশ্নে নিজেই লজ্জা পায়। বন্য জন্তুরা এমনিতেই রাতে বেশ ভালো দেখতে পায়। কিন্তু তবু কেন যেন মনে হল এই দুর্বোধ্য এলাকায় কোনো প্রাণী কি মৃত পচা ক্যারিয়ানদের ট্রেস করতে পারবে? কিন্ত আবার বলেন।– কিন্তু ওরা তো একটা দুটো থাকবে না, যত দূর শুনেছি ওরা দল বেঁধে থাকে।
শবনম ম্যাডাম এবার খিক খিক করে হেসে ওঠেন। স্যার আপনি ভুলে গেছেন হয়তো, এই লাচুঙে সে রকম দলের কোনো রিপোর্ট নেই। তবে এগুলো সব ইম্পোর্টেড অ্যান্ড ফার্মিং। ইদানিং রিপোর্টে উঠে আসছে।
বলতে বলতে বাম করে একটা ঢিল এসে দীপকবাবুর সামনে এসে পড়ে। জিনিসটা কি দেখতে টর্চ অন করবে কিনা ভাবছেন ঠিক তখনই বড়মামা চাপা স্বরে বলেন,- দীপকবাবু ! দীপক বাবু!
আর একই সঙ্গে পাহাড় জঙ্গল উপত্যকার গভীর নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বর ভেসে আসে-কু কুউউউউ—খ্যাক খ্যাক খ্যাক ক্কক ক ক -।
হার্টে ফেল হওয়ার জোগাড়! এক মুহুর্তে দীপকবাবু বড় মামার দিকে তাকিয়ে দেখে বড় মামা ছোট একটা পাথরকে চেপে ধরে ডান হাতে কিছু একটা উঁচিয়ে আছে। বাঁ পা’টাকে পিছিয়ে সামনের দিকে হেলে আছে। আর মাঝে মাঝে দুলছে। ভয়ে না আক্রমণের ভঙ্গিতে দীপকবাবু ঠিক বুঝতে পারলেন না। শুধু শুনতে পেলেন পাশ থেকে শবনম ম্যাডাম বলছেন,- রেডি ফর ফাইট। সাবধান, গায়ে যেন ঝাঁপিয়ে না পড়ে। একবার ঝাঁপালে ইউ ফিনিসড!
বৃষ্টি ধরে এসেছে। লেবারের দল শিকারীর মত উন্মুখ হয়ে উঁচু পাহাড়ের দিকে মুখ করে চেয়ে আছে। এই বুঝি শিকার ধরা পড়েছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে লম্বা বানপক আর তির ধনুক।
বড়মামা বলে, দু’রকম জানোয়ার আছে।
শবনম ম্যাডাম মাথা নাড়েন,- উলফ অ্যাণ্ড হায়েনা।
সেরগিল সাহেব মুখে আঙুল দিয়ে ঈশারা করেন- চুপ!
শ্রীপর্ণা ঘোষ
দশম শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর
সেই মেয়েদের ছড়া
গৌতম বাড়ই
(১)
কোথায় গেলিরে ও তুলতুলি?
তুলতুলি গেল শেওড়াফুলি।
শেওড়াফুলির ট্যাশগোরুটা
ঢি-স-স্ মারলো তার পেটে ।
এ্যা এ্যা মেয়ে কাঁদছে দেখে,
মা দিল খেতে ক্ষীরের পিঠে।
পউশ পাবণের পিঠে-পুলি,
বেজায় খুশি তুলতুলি।
আর যাবে না শেওড়াফুলি।
(২)
মিষ্টি করে তাকায় মেয়ে
মিঠি বলেই সবাই ডাকে ।
মিষ্টি মোয়া হাতেই পেয়ে
মিঠে হাসি ফোকলা মুখে ।
মিঠি হাসির চারটে দাঁত
মিষ্টি যেন চাঁদের হাট।
মিঠি হেসে উঠলো রাতে
চাঁদ এসে এ ঘরে মাতে।
দশম শ্রেণি, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, মেদিনীপুর
ঈশ্বরের সৃষ্টি
আকাশ সরকার,
দশম শ্রেণী, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন।
লম্বা দুটি রেলপথ
হাতে হাত ধরে
হেঁটে গেছে - ততদূর
যতদূর চোখে পড়ে।
অবিরাম চলে ট্রেন রেলগাড়ি
কু-ঝিকঝিক কু-ঝিকঝিক
হাজার লোকের হয় সমাগম
দেশ-বিদেশে তারা দেয় পাড়ি।
কামরায় শুরু হয় গল্প
বাড়ে বন্ধুত্বের নিবিড়তা-
ছোট হয়ে আছে যাত্রা
অভিজ্ঞতা - টক, মিষ্টি, নোনতা।
হকার বলে "চা খাবেন?"
অপূর্ব এক সুবাস -
ঘুগনি ও শালপাতার
নৈসর্গিক এক নির্যাস।
লাল, কালো, হলদে লজেন্স
'চেন না টানার আবেদন',
টুংটাং হাতলের সুরতান
উৎসাহী যাত্রীদের গুঞ্জন।
কিন্তু - সবই সাময়িক
ও কামরাতেই সীমাবদ্ধ
বাইরে নামতেই ছন্দটা
একেবারে জব্দ।
কাগজের মোড়া কাপ,
দুমড়ানো শালপাতার বাটি;
ফিকে হয়ে আসে টানগুলো
যেন - জুতোর তলার মাটি।
লালবাতি জ্বলে গেছে দিগন্তে
গন্তব্য ওই যে আসছে,
ঝড়-জলে ভেজা, রোদে পোড়া
দুটি রেলপথ মিটিমিটি হাসছে।
ধারাবাহিক উপন্যাস
উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে বাসবদত্তা কদম
পর্ব ১৭
ওয়াশিংটন ডিসি আমেরিকার বর্তমান রাজধানী। স্বাভাবিক ভাবেই এখানেও রয়েছে আমাদের দেখার জন্য অনেক কিছু। যার মধ্যে কিছু আমরা লিস্টে রেখে নিলাম প্রথমদিকে। দাদা আগেই বলেছিল ওয়াশিংটনে গাড়ি পার্কিং এর অসুবিধার কথা। এইদিনও আমরা এক্কেবারে সকাল সাতটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম কিং অব প্রাসিয়া থেকে কারন দূরত্ব কিছু কম নয় পেরোতে হবে দুশো কিলোমিটারের উপরে রাস্তা। আমাদের লিস্টে যেসব জায়গা ছিল সেগুলো আমরা রাখলাম এইভাবে- মার্কিন প্রেসিডেন্টের আবাস হোয়াইট হাউস, ওয়াশিংটন মনুমেন্ট, লিংকন মেমোরিয়াল, ন্যাশনাল ওয়ার্ল্ড ওয়ার (২) মেমোরিয়াল আর দেখার মধ্যে রেখেছিলাম কয়েকটি মিউজিয়ম ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়ম, হিস্ট্রি এন্ড সায়েন্স মিউজিয়ম, আফ্রিকান আমেরিকান মিউজিয়ম।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট যে বাড়িতে থাকেন সেটি অজস্রবার টিভির পর্দায় দেখেছি তাই সামনে থেকে দেখে চিনতে কোনো অসুবিধাই হলো না এই সেই হোয়াইট হাউস বলে। ফিলাডেলফিয়া থেকে আমেরিকার রাজধানী যখন ওয়াশিংটন ডিসিতে স্থানান্তরিত হয় সেই সময় থেকে এটিই প্রেসিডেন্টের আবাস এখনো পর্যন্ত। হোয়াইট হাউস যে রাস্তায় তার নাম পেনসিলভেনিয়া স্ট্রিট। সম্ভবত পেনসিলভেনিয়ার স্মৃতিতেই এই রাস্তার নাম। এই বাড়ির ভেতরে ঢোকা যায় কিনা জানি না, আমরা অন্তত ঢুকতে পারিনি।
শুনলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ওয়াশিংটন শহরেও। এখনকার ঝকঝকে বিল্ডিং দেখে এইসব কথা ভাবাও অসম্ভব মনে হয়।
চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা
হোয়াইট হাউসের এর সামনের রাস্তায় দেখলাম অজস্র মানুষ। সেখানে প্র্যামে বাচ্চা নিয়ে বাবা মা থেকে বুড়ো মানুষ পর্যন্ত সবাই আছে। এরা সম্ববত আমাদের মত ট্যুরিস্ট। এই বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে একটি পার্ক। সেখানে অজস্র গাছে তখন ফল আর কাঠবেড়ালির খেলা চলছে; তার মধ্যেই বেশ কিছু মানুষ বসে আছেন হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে। শুনলাম এভাবেই এখানে প্রতিবাদী মানুষেরা দিনের পর দিন সেখানে বসে থাকেন নিঃশ্বব্দে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। অজস্র সেন্ট্রি হোয়াইট হাউসের গেটের ভিতরে বাইরে কিন্তু কাউকেই তাড়িয়ে দিচ্ছে না দেখলাম। বেশ ভয়ে ভয়ে ক্যামেরা তাক করেছিলাম। ধমক খেতে হবে নাকি! কিন্তু কেউ কিছুই বললো না দেখলাম, তখন সাহসী হয়ে হোয়াইট হাউসকে ক্যামেরায় ভরলাম।
এরপর চলে গেলাম এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়মে। এই মিউজিয়মটি ১৯৪৬ সালে তৈরী। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে সমস্ত মিউজিয়মে সব থেকে বেশি ট্যুরিস্ট যান তার প্রথম কয়েকটির মধ্যে পড়ে। প্রথমেই যে ঘরটিতে ঢুকলাম সেখানে রাখা আছে এপোলো ১১ এর মডেল। মিউজিয়মে রাখা বিশাল বিশাল প্লেন দেখলে অবাক হতে হয়। এখানে দেখলাম রাইট ভাইদের বানানো প্রথম এরোপ্লেন থেকে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বর্তমান সময়ের এরোপ্লেনের জন্ম পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বেশ কিছু যুদ্ধ বিমান। প্রতিটি জিনিস বুঝিয়ে দেবার জন্য গাইড রয়েছেন। মিউজিয়মে ঢুকতেও কোনো টিকিট লাগেনি বলেই মনে পড়ছে। ফ্রি এন্ট্রি পাস পাওয়া গেছিল।
এরপর গেলাম হিস্ট্রি এন্ড সায়েন্স মিউজিয়ম। এখানেও ছিল ফ্রি এন্ট্রি পাস। ঢুকতেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল ম্যামথ। অবশ্যই ম্যামথের রেপ্লিকা। সেই কত হাজার বছর আগেকার ম্যামথের সাইজে তাকে বানানো হয়েছে। কিন্তু দেখলে মনে হচ্ছে এই বুঝি এলো তেড়ে।
প্রত্যেকটি মিউজিয়মে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে একাধিক শো চলছে। শোয়ের সময় অনুযায়ী যে কেউ ঢুকে বসতে পারে চেয়ার খালি থাকলে। আলাদা কোনো টিকিট লাগে না।
(ক্রমশ)
পাঠপ্রতিক্রিয়া
(ছোটোবেলা ১৭০ পড়ে নীতা রায় যা লিখলেন)
প্রতিবারের মতো ছোটোবেলা ১৭০ পড়লাম ।
জাপান ভ্রমণের বর্ণনা খুব ভালো লাগলো।
কালো ডিম সম্পর্কে সুন্দর ভাবে বোঝানো হয়েছে।
চীনে সেঞ্চুরি এগ হয় কালো।
লাচুঙের নেকড়ে, পিছনের এপিসোড গুলোর সব কটি মনে করতে পারছি না।
একটু হিংসুক মনে হচ্ছে, বাচ্চাদের পক্ষে।
বাসবদত্তা র লেখা খুব ভালো লেগেছে।
0 Comments